
আইপিএল এক যুগান্তকারী সিস্টেম, যা ক্রিকেট পাগল দর্শককে মনোরঞ্জন দেয়, আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেয়। তাই তারা ক্রিকেটীয় দিক থেকে উন্নততর বিবিএল বা অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের থেকেও বেশি জনপ্রিয় এবং বাজারপ্রিয়। কিন্তু আইপিএল যে মডেলের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেই এনবিএ-র পেশাদার সংস্কৃতির সমমানের হতে এখনও বহু দিন বাকি। তার অন্যতম প্রধান কারণ, ভারতীয়দের পেশাদারিত্বের প্রতি অনীহা অথবা মস্তিষ্কের থেকে হৃদয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া। এ রোগ না-সারলে রাহুলের মতো হতাশা অনেকের ক্ষেত্রেই আসবে!
২০০৮-এ ‘ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ’ শুরু হওয়ার পর প্রথমবার নিলাম হচ্ছে, বেঙ্গালুরুর আইটিসি রয়াল গার্ডেনিয়া হোটেলে। আইপিএল-এর নিলামকারী রিচার্ড ম্যাডলি ডাক দিলেন, ‘এবারে প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি!’
৩৮ বছর বয়স হলেও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও– তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। কলকাতা নাইট রাইডার্সের গত তিন বছরের আইকন ক্রিকেটার! বয়সের কারণে ফর্ম এবং ক্ষিপ্রতা কমলেও ক্রিকেট অর্থনীতির বাজারে তাঁর দাম কমেনি! আর আইপিএল তো বাজারের আনুকূল্যই চায়। যে ক’টি দল অল্প সময়ের মধ্যে লাভের মুখ দেখেছে, তার মধ্যে সবার আগে থাকবে কেকেআর! তাহলে?

কিন্তু শুধু স্বল্পকালীন বাণিজ্যিক লাভ দেখলেই তো হয় না! গত তিন বছরে কেকেআর যথাক্রমে ষষ্ঠ, অষ্টম এবং ষষ্ঠ হয়েছে। একমাত্র দল, যারা প্লে-অফ খেলেনি! এই অবস্থায় বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিতেই হত। কয়েক মাস আগেই আমেরিকায় শিক্ষিত এক ব্যবসায়ীকে কেকেআর নিজেদের প্রধান আধিকারিক হিসাবে নিয়োগ করেছে, বেঙ্কি মাইসোর। আর তিনি এসেই এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! দলটাকে একদম নতুন করে তৈরি করতে হবে! টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উপযোগী করে!

২০১১-র পরবর্তী আইপিএল বিশ্বে সাফল্যের ভিত্তিতে কেকেআর তিন নম্বরে থাকবে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, চেন্নাই সুপার কিং-এর পরেই! তিন-তিনটে আইপিএল জেতা হয়ে গিয়েছে। ২০১৪-য় তো বাংলার কোনও ক্রিকেটার না-নিয়ে, সারা বাংলায় প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও!
একইভাবে, সচিন তেণ্ডুলকর-পরবর্তী সময়ে খোলনলচে বদলে, অধিনায়কত্বের ব্যাটন রোহিত শর্মার হাতে দিয়ে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সও হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় সফল দল! চেন্নাই সুপার কিংসের সঙ্গে সমান সমান ৫টা ট্রফি জিতে! কিন্তু সেই রোহিত শর্মাকেই নির্দয়ভাবে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিতে বাধেনি তাদের! এমন একটা অদ্ভুত সমস্যা তৈরি হল যে, ভারতীয় দলের টেস্ট এবং একদিনের দলের অধিনায়ক রোহিত, টি-২০ দলের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব, অথচ মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া!

একইভাবে দেখতে গেলে ‘রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর’-এর বিরাট কোহলি আর ‘চেন্নাই সুপার কিংস’-এর মহেন্দ্র সিং ধোনি ছাড়া কোনও তারকাই পারফরম্যান্স, বাজার আর টিম ম্যানেজমেন্টের এক হৃদয়হীন ত্রিভুজের চাপ থেকে ছাড় পাননি! শুরুর দিকের যুবরাজ সিং, ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককুলামদের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি! এমনকী, মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষকেও, যে দু’-বছর বেটিংয়ের অভিযোগে সিএসকে সাসপেন্ডেড ছিল, সেই দু’-বছর ‘রাইজিং পুনে সুপার জায়েন্টস’-এ গিয়ে অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়ার মতো অসম্মানের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
অবশ্য পুনে সুপার জায়েন্টসের যিনি মালিক, তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড এখনও বিশেষ বদলায়নি! ২০২৪-এ ‘হায়দরাবাদ সানরাইজার্স’-এর কাছে হারের পর জনসমক্ষে তিনি তাঁর বর্তমান ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘লখনউ সুপার জায়েন্টস’-এর অধিনায়ক লোকেশ রাহুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, যার স্বর এবং আলোচনার পরিবেশ খুব একটা মনোমুগ্ধকর ছিল না। ফলস্বরূপ, তার আগের বছর ফাইনাল খেলা অধিনায়ক ২০২৫-এর আগেই একপ্রকার জোর করেই দল ছাড়েন! দিল্লি থেকে ঋষভ পন্থকে ২৭ কোটি টাকা দিয়ে কিনে লখনউয়ের অধিনায়ক করে দেওয়া হয়! অবশ্য তাতে দলের সার্বিক ফলের উন্নতি খুব বেশি হয়নি! প্রথম দু’-বছর যথাক্রমে ফাইনাল ও প্লে-অফ খেলা দল তার পরের দুই বছর সাত নম্বরেই শেষ করে!

রাহুল সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করেছেন যে, আইপিএল এখনও পর্যন্ত পেশাদারি কর্পোরেট মানসিকতা নিয়ে আসতে পারেনি, দলগুলির মধ্যে, সার্বিকভাবে! এই অভিযোগ অবশ্য সবগুলো দলের বিরুদ্ধে করা যাবে না! ‘গুজরাত টাইটান্স’-এর প্রাথমিক মালিকানা ছিল একটি আমেরিকান কোম্পানির কাছে, যারা এর আগে স্পেনের ফুটবল লিগ ‘লা লিগা’তে বিনিয়োগ করেছে! প্রথম বছর দল তৈরি করেই তারা ২০২২-এ চ্যাম্পিয়ন হয়, ২০২৩-এ রানার্স।
বর্তমানে টরেন্ট গ্রুপকে দুই তৃতীয়াংশ শেয়ার বেচে দেওয়ার পরেও গুজরাত টাইটানসের কর্পোরেট সংস্কৃতির কোনও পরিবর্তন হয়নি বিশেষ। ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোচ আশিস নেহরা বা ম্যানেজার সত্যজিৎ পরবকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। আর ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক কর্নেল অরবিন্দর সিং-ই মুখ!

কিছুটা কেকেআরের ক্ষেত্রেও হয়তো। বেঙ্কি মাইসোরের ওপর দল সংক্রান্ত সমস্ত কিছুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব। কিন্তু বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত রয়েছে মালিক রেড চিলিজ বা আরও স্পষ্ট করে বললে মহাতারকা শাহরুখ খানের ওপর! তাই সৌরভ-পরবর্তী সময়ে সচেতনভাবে স্টারবর্জিতভাবে দলগঠনের কথাই ভাবে হয়েছে। তাতে একটা সুনীল নারিন, একটা আন্দ্রে রাসেল বা একটা মিচেল স্টার্ক চলে এলে সেটা ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত বেশি, বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত কম বলেই ধরে নেওয়া যায়! বর্তমান ভারতের টেস্ট এবং একদিনের ক্রিকেটের অধিনায়ক শুভমন গিলই হোক বা ২০২৪-এর আইপিএল বিজয়ী অধিনায়ক শ্রেয়স আইয়ার-ই হোন, দল যদি মনে করে যে তারকা রাখা হবে না! তা হলে সফল ক্রিকেটারদের ছেড়ে দিতেও পিছপা নয় কেকেআর। শাহরুখ খানই দলের মুখ! বাকিটা ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত!
রাজস্থানের কথাই যদি ধরি! প্রথম বছরের আনকোরা দল নিয়ে ম্যাজিকাল সাফল্যের নেপথ্যে ছিলেন শেন ওয়ার্ন, তাঁর ক্যারিশমা আর তাঁর ক্রিকেটীয় দক্ষতা ও বোধ! শেন চলে যাওয়ার পর ব্যাঙ্গালোর থেকে রাহুল এসে কিছুটা হয়তো হাল ধরেছিলেন, কিন্তু প্রথম বছরের পর আর ট্রফি আসেনি! আর সাম্প্রতিককালে যে বিতর্কের মধ্যে রাজস্থান রয়্যালস পড়েছে, তাতে কোচ বা অধিনায়ক কেউই ছাড় পায়নি!

ফ্র্যাঞ্চাইজির একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় রিয়ান পরাগ, যিনি আবার রাজস্থান রয়্যালসের প্রশাসনিক প্রধান রঞ্জিত বড়ঠাকুরের আত্মীয়। আর সেখান থেকেই চাপ পড়ে অধিনায়ক সঞ্জু স্যামসন আহত হওয়ার পর যে রিয়ানকে অধিনায়ক করতে হবে! সেই অবধি ঠিক ছিল, কারণ রিয়ানের পারফরম্যান্স খারাপ নয়। গোল বাধল সঞ্জু চোট সারিয়ে ফিরে আসার পর! ফলস্বরূপ দ্রাবিড়ের অপসারণ এবং ২০২৫-এর পর সঞ্জুর সরে যাওয়া!
অন্য রাহুলের প্রসঙ্গে ফিরে যাই! ক্রিকেটীয় কারণে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এবং তা যদি ক্রিকেটে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নেন তাহলে প্রশ্ন থাকলেও সংশয় থাকে না। উদাহরণ হিসাবে ধরি, ভারতীয় দলের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে অস্ত্রোপচারের পর ফিরে আসা মহম্মদ শামিকে দলভুক্ত না করাটা ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু দল সামান্য খারাপ পারফর্ম করতেই আইপিএল জয়ী অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত সংঘাত এবং তারপর দল গঠন নিয়ে দল পরিচালন সমিতির সঙ্গে বিবাদ ও বিদায়– ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত নয়। একইভাবে আকাশ আম্বানির পছন্দ বলেই হার্দিক পান্ডিয়ার দাদা ক্রুনালকে দলে নেওয়া ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্ত নয়!

তবে এতগুলো দল, এত তার নন প্লেয়িং স্টাফ, তাতে ভুলভাল সিদ্ধান্ত কি একেবারেই হয় না?
আরসিবির চ্যাম্পিয়ন হতে লেগে গেল ১৮টা বছর। মাঝে তো তারা খারাপ দল গড়েনি! ক্রিস গেইল, এবি ডি’ভিলিয়ার্স, ভুবনেশ্বর কুমার, ফাফ দুপ্লেসি-র মতো খেলোয়াড় ছিলেন, ছিলেন অনিল কুম্বলেও! আর বিরাট তো আছেনই। তাও সাফল্য আসেনি, কারণ সময়োপযোগী দল গড়তে পারেনি আরসিবি। একই কথা প্রযোজ্য দিল্লি বা পাঞ্জাবের ক্ষেত্রেও। ক’দিন আগেই ড্রেসিংরুমে ঢুকে পাঞ্জাব কিংসের অন্যতম মালকিন প্রীতি জিন্টা কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারকে কুকথা বলার ঘটনাও ঘটেছে।
বস্তুত, আইপিএল এক যুগান্তকারী সিস্টেম, যা ক্রিকেট পাগল দর্শককে মনোরঞ্জন দেয়, থ্রিল দেয়, আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেয়। তাই তারা ক্রিকেটীয় দিক থেকে উন্নততর বিবিএল বা অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের থেকেও বেশি জনপ্রিয় এবং বাজারপ্রিয়। কিন্তু আইপিএল যে মডেলের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে, সেই এনবিএ-র পেশাদার সংস্কৃতির সমমানের হতে এখনও বহু দিন বাকি। তার কারণ অনেক কিছুই থাকতে পারে, তবে ভারতীয়দের পেশাদারিত্বের প্রতি অনীহা অথবা মস্তিষ্কের থেকে হৃদয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া একটা প্রধান কারণ। এ রোগ না-সারলে রাহুলের মতো হতাশা অনেকের ক্ষেত্রেই আসবে! বাজার সেখানে অপারগ!
তথ্যসূত্র
ক্রিকেট ২.০ ইনসাইড দ্য টি২০ রেভোল্যুশন- টিম উইগমোর ও ফ্রেডি ওয়াইল্ড
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved