যে মহিলারা চন্দ্রযানের নেপথ্যে কাজ করেছেন, তাঁরা যে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ বজায় রেখে শাড়ি, মঙ্গলসূত্র, সিঁদুর, টিপ পরে তথাকথিত ‘ভারতীয় মহিলা’-র ইমেজ বজায় রেখেছেন– সেটাই নাকি গর্বের বিষয়। আজ যদি তাঁরা একই কাজে শাড়ি না পরতেন, টিপ না পরতেন– বেছে নিতেন নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনও পোশাক, যা কিনা তথাকথিত সমাজস্বীকৃত ‘ভারতীয় নারী’-র ইমেজের সঙ্গে খাপ খায় না– তাহলেও কি তাঁদের কাজ যথাযথ স্বীকৃতি পেত?
একুশ শতকে দাঁড়িয়ে লিঙ্গগত বৈষম্যের নুয়ান্সড আলোচনা প্রয়োজন ছিল, দরকার ছিল বৈষম্যকে মানবমনের গভীর থেকে উৎখাত করার– কিন্তু তার বদলে নারীদের এখনও পোশাকের চয়েজের জন্য লড়াই করে যেতে হচ্ছে। আর দক্ষিণপন্থী মনোভাব যেখানে রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি– সেইখানে এই লড়াই প্রত্যেক দিন আরও একটু একটু করে কঠিন হচ্ছে আর সমাজ এগনোর বদলে এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। আজও দেশের একপ্রান্তে মেয়েরা লড়ে যাচ্ছে খোলা চুলে ঘুরে বেড়ানোর বাসনায়। হিজাবের বিরুদ্ধে।
এদিকে ইসরোর চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটি ছুঁয়েছে। একাধিক বিজ্ঞানীর বুদ্ধিমত্তা, কারিগরি কৌশল এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল এই সাফল্য। সত্যি, এ নিয়ে ভারতবাসীর গর্ব করাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আদপে গর্ব ঠিক তা নিয়ে করা হচ্ছে না। বরং গর্ব করা হচ্ছে, ইসরোর মহিলাদের শাড়ি এবং টিপ পরা নিয়ে। অর্থাৎ, যে মহিলারা চন্দ্রযানের নেপথ্যে কাজ করেছেন, তাঁরা যে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ বজায় রেখে শাড়ি, মঙ্গলসূত্র, সিঁদুর, টিপ পরে তথাকথিত ‘ভারতীয় মহিলা’-র ইমেজ বজায় রেখেছেন– এই এখন দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রনেতা ও এক বৃহৎ অংশের ভারতবাসীর কাছে সেটাই নাকি গর্বের বিষয়। সেই কারণেই তাঁরা আজ সমাজের চোখে ‘প্রকৃত নারীশক্তি’ বা ‘আইডিয়াল উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’-এর মডেল। আজ যদি তাঁরা একই কাজের সাফল্য-অনুষ্ঠানে শাড়ি না পরতেন, টিপ না পরতেন– বেছে নিতেন নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনও পোশাক, যা কিনা তথাকথিত সমাজস্বীকৃত ‘ভারতীয় নারী’-র ইমেজের সঙ্গে খাপ খায় না– তাহলেও কি তাঁদের কাজ যথাযথ স্বীকৃতি পেত? তাঁদের এমপাওয়ারমেন্ট-কে নিয়ে এত সহজে আনন্দে মাততে পারত পুরুষতন্ত্র? পুরুষতন্ত্র নিজের সুবিধামতো নারীকে সংজ্ঞায়িত করেছে। কখনও নারীকে প্রয়োজন ঘরের কাজে, কখনও প্রয়োজন পুরুষের সেবায়, কখনও সন্তান লালনপালনে, তাই বিয়ের পর স্ত্রী নাচ শিখতে চাইলে তাকে গুলি করে মেরে দেওয়া হয়। আজ চন্দ্রযানের সাফল্য পুরুষতন্ত্রের প্রয়োজন। কারণ ইসরোতে কাজ করা এই বিপুল সংখ্যক নারীর সাফল্য পুরুষতন্ত্র প্রোক্লেম করতে চায় নিজের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে। চন্দ্রযান এখন তুরুপের তাস। এর সাফল্য গ্রহণ করতে চায় রাজনৈতিক দল, গ্রহণ করতে চাইছে পুরুষতন্ত্র, হাতাতে চাইছে দক্ষিণপন্থী মনোভাব। তাই চন্দ্রযানের নেপথ্যে নারীর ভূমিকা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। বরং প্রয়োজন নারীর এই সাফল্যকে নিজের করে তোলা। আর পুরুষতন্ত্র বা দক্ষিণপন্থা নারীকে সম্মান দিতে জানে একটাই পদ্ধতিতে, সেটা হল– আরাধনা। নারীকে দেবীর স্থানে নিয়ে যাওয়া। নারী হয় দেবী, নয় বেশ্যা। এই বাইনারিতে স্বাভাবিকভাবেই শাড়ি পরিহিত নারীরা দেবীর স্থান অর্জন করেছে। কারণ পুরুষতন্ত্র এ কথা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে যে স্বল্প পোশাক পরিহিত নারীরা ধর্ষণের যোগ্য।
অর্থাৎ আবারও যখন মহিলারা শতকের পর শতক লড়াই করে ঘরের বাইরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে, পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে, যখন মেয়েরা লড়ছে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান উপার্জনের জন্য, সমান সম্মান অর্জন করার জন্য, কর্মক্ষেত্রে সমান সংখ্যক নারী ও পুরুষ কর্মী নিয়োগের জন্য, যখন মহিলারা আর দ্বিতীয় নাগরিক নয়, যখন মহিলারা সুযোগ পেয়ে পুরুষের সাফল্যকে অতিক্রম করতে পারছে, তখনও একজন মহিলার মূল্য নির্ধারিত হচ্ছে পোশাকের নিরিখে। এ লজ্জা রাখব কোথায় আমরা? চাঁদে পা রাখার সাফল্য আমাদের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। বরং দগদগে হয় নারীর অসম্মান।
কয়েক বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। ২০১৫-এ ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিরণ গান্ধী ‘পিরিয়ডস’ নিয়ে লন্ডনের একটি অ্যাথলিট দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ঠিক করে নেন ট্যাম্পুন বা প্যাড ব্যবহার করবেন না– অত্যন্ত স্বাভাবিক এই মেন্সট্রুয়েশন, তাই মেন্সট্রুয়েট করতে করতেই ট্র্যাকের ওপর দিয়ে দৌড়বেন। দৌড়ের পর রক্তের দাগ লাগা ট্র্যাক প্যান্টস পরেই অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে পোজ দিয়ে ছবি তোলেন তিনি। তাঁর এই পা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়া দৌড়ের ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পরে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়– নেমে আসে নোংরা ব্যক্তি-আক্রমণ। এ কোন নারীর সংজ্ঞা? সমাজ বুঝতে পারে না। কিরণ হাসিমুখে জানান সমাজ অস্বস্তিতে পড়ছে, কারণ সে মহিলাদের কোনও সমাজস্বীকৃত ধারণার সঙ্গেই তাঁকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। পাবলিকলি মেন্সট্রুয়েট করলে লজ্জায় মুখ ঢাকবে নারী– এই তো হওয়ার ছিল। উল্টে সে মেন্সট্রুয়েশনের রক্ত নিয়ে শয়ে শয়ে ক্যামেরা আর গ্যালারিভর্তি হাজার লোকের সামনে দিয়ে উদ্ধত হয়ে ছুটে চলেছে। স্বাভাবিক এই ক্ষরণকে আড়াল করার কোনও চেষ্টাই করেননি কিরণ। বহু সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন তাঁর এই কনশাস চয়েজের অন্যতম কারণ পুরুষতন্ত্রকে অস্বস্তিতে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব প্রান্তিক মহিলাকে সাহস জোগানো, যাঁদের কাছে এখনও স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে যায়নি এবং যাঁরা তাঁদের শরীরের এই স্বাভাবিক ক্ষরণ নিয়ে লজ্জিত। মহিলা শরীর পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য নয়, এই শরীর নিজের ইচ্ছেয় নিজের মতো করে চালনা করার জন্য। এই সাহসিকতা থেকেই মাসিক রক্তক্ষরণকে দৌড়ের ময়দানে আড়াল করবার চেষ্টা করেন না তিনি। অথচ এই সাফল্যকে নিয়ে গর্ব তো দূরের কথা বরং নির্লজ্জতার ট্যাগে ভূষিত হন কিরণ। আসলে এই এমপাওয়ারমেন্টকে ‘নারীশক্তি’ বা ‘ভারতীয় নারী’-র তথাকথিত খোপগুলোর মধ্যে পুরে দেওয়া যায় না যে! সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক এমপাওরমেন্টের ধারণা আমাদের মেয়েদের স্বাধীনভাবে পছন্দ করতে পারার সাহস বা কঠিন পরিশ্রমে নয়। পোশাকের বাছবিচার, পুরুষতান্ত্রিক মডেলের রাখঢাক বা ‘ফেটিশিজম’-এর মধ্যে থেকে কাজ করলেই তা ‘নারীশক্তি’ আর খোপে না ঢুকলেই ফক্কা!
তাই ইসরোর মহিলারা চাঁদের মাটিতে পা ছুঁলেও দিনের শেষে তাঁদের পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাবিশ্বের মডেলে ফেলতেই উদ্যত সমাজ। চোখে আঙুল দেখিয়ে বারবার বলে যাওয়া হচ্ছে– দেখুন, ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন শাড়ি পরে– দেখুন, ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন টিপ পরে– দেখুন ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন মঙ্গলসূত্র পরে– দেখুন, ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন সিঁদুর পরে। আসলে বক্তব্যটা এই– দেখুন, ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন কিন্তু পশ্চিমি খোলামেলা পোশাক পরতে হয়নি– দেখুন, ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন কিন্তু ছোট পিক্সি কাটে কপাল ঢেকে রাখেননি– দেখুন, ওঁরা চন্দ্রযান বানিয়েছেন কিন্তু বিবাহের চিহ্নকে আড়াল করেননি। সুতরাং ওঁরাই আদর্শ নারী। এবং তাই ওঁদের চন্দ্রযান সাফল্যের জয়জয়কার করা হোক।
শোনা যাচ্ছে, চন্দ্রযান যেখানে ল্যান্ড করে সেইখানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘শিবশক্তি’। সম্প্রতি এক কনফারেন্সে এহেন শিবশক্তিকে নারীশক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন এক জনপ্রিয় দক্ষিণপন্থী নেতা। এই বার্তায় উদ্বুদ্ধ কোনও ‘আদর্শ নারী’ শিবের বসনে পরবর্তী চন্দ্রযানের জন্য কাজ শুরু করে দিলে কী হবে ভাবছি! এমন অনাচার দেখিয়া ‘আদর্শ নারী’-র সম্মান রক্ষার্থে স্তম্ভিত পুরুষতন্ত্র ত্রাসে-সন্ত্রাসে চন্দ্রযাত্রাই না নিষিদ্ধ করে দেয়!
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?