‘অল আইজ় অন রাফা’ এই স্লোগান যত ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে, জ়ায়নিরা ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। আহাম্মকের ঔদ্ধত্যে তারা দুনিয়াকে সওয়াল করছে—কোথায় ছিল তোমাদের মানবতা, যখন ফিলিস্তিনিরা আমাদের সীমানায় ঢুকে ১২০০ মানুষকে মেরেছে, ধরেছে, ধর্ষণ করেছে? শিশুদেরও পুড়িয়ে মেরেছে যারা? মরে যাওয়ার মাত্র ক-টা দিন আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমি স্পষ্ট করে কি উত্তর দিইনি তার? মূর্খ! তুমি জানো না যে আক্রান্ত আর আক্রমণকারীর ক্ষেত্রে একই যুক্তি খাটে না, প্রতিআক্রমণ আক্রান্তের ন্যায়সংগত অধিকার?
১৫
রিফাত আলআরির
ফ্যলাস্তিন
আমাকে মেরে ফেলার পর পাঁচ মাস কেটে গেছে। আমার কবরগাহ্ যেখানে, শত্রুর যুদ্ধবিমান থেকে নেমে আসা বোমা সেখানকার জমিটুকুও গুঁড়ো করে দিয়েছে। সাঁজোয়া গাড়িগুলো, বোমারু বিমানগুলো বা ধর মেশিনগানগুলোর পেটে সবসময়েই চিতার আগুনের মতো খিদে। তাই আমাদের মাটিতে ঠেলে পাঠানোর আগে তাদের পেট ভরে খাইয়ে দেওয়া হয় ঘৃণা। আকণ্ঠ ঘৃণায় পেট বোঝাই করে এখানে এসে আরব মানুষগুলোর ঠান্ডা চোখ আর শক্ত চোয়াল দেখে তাদের গা গোলাতে থাকে। আর তারা ওয়াক তুলে উগরে দিতে থাকে ঘৃণা! তারা শান্তিতে বাঁচতে চাওয়া আমার এ-দেশটার ওপর ক্রমাগত বোমা আর গুলি বমি করে চলে, করে চলে। তাদের বোমা ফুরোয় না। তাদের বমি ফুরোয় না। এই করতে করতে তারা একদিন ফুরিয়ে যাবে। আমরা থেকে যাব।
আমাকে মেরে ফেলার পর পাঁচ পাঁচটা মাস কেটে গেছে। পুরো গাজা শহরটাকে চুরচুর করতে করতে রাতের নেকড়ের মতো গুঁড়ি মেরে ওদের সাঁজোয়া ট্যাংকগুলো রাফা-তে এসে ঢুকছে এক এক করে। একা আসতে ওরা ভয় পায়। তাই লোম-ওঠা শকুনের মতো ওদের মাথার ওপর উড়ে উড়ে পাহারা দিচ্ছে বোমারু বিমানগুলো। ভলকে ভলকে ঘৃণা উগরে চলেছে ওরা। দিনে ওরা ধুঁকে ধুঁকে এগোয়, রাতে ঘুমোতে পারে না। ঘুমোলেই দুঃস্বপ্ন ওদের গলা টিপে ধরে। ওরা বুঝতেই পারে না এত মৃত্যুর পরেও আমাদের দেশের এই রুখাশুখা মানুষগুলো রুখে দাঁড়ায় কী করে! কী করেই-বা তারা কবিতা লেখে!
আমাকে নিয়ে গত আট মাসে এদেশে মৃতের সংখ্যা ছত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গাজা শহরের বেশিরভাগটাকে ধ্বংসস্তূপে বদলে দিয়ে এবার ওরা রাফা-র রেফিউজি ক্যাম্পকে ঘিরে ফেলেছে। সারা পৃথিবীর মনুষ্যত্বে বেঁচে থাকা মানুষেরা গর্জে উঠেছে– সবাই চোখ ফেরাও রাফা-র দিকে! ‘অল আইজ অন রাফা’ এই স্লোগান যত ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে, জায়নিরা ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। আহাম্মকের ঔদ্ধত্যে তারা দুনিয়াকে সওয়াল করছে– কোথায় ছিল তোমাদের মানবতা, যখন ফিলিস্তিনিরা আমাদের সীমানায় ঢুকে ১২০০ মানুষকে মেরেছে, ধরেছে, ধর্ষণ করেছে? শিশুদেরও পুড়িয়ে মেরেছে যারা? মরে যাওয়ার মাত্র ক-টা দিন আগে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমি স্পষ্ট করে কি উত্তর দিইনি তার? বলিনি যে আক্রান্ত আর আক্রমণকারীর ক্ষেত্রে একই যুক্তি খাটে না, প্রতিআক্রমণ আক্রান্তের ন্যায়সংগত অধিকার?
পেপার কাটিং-১/ অক্টোবর ২০২৩
‘আমি মনে করি, হ্যাঁ, আমি মনে করি, এই ৭ অক্টোবরের এই আক্রমণ ছিল ন্যায়সংগত (ইসরায়েল সীমার মধ্যে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের আক্রমণ) এবং নৈতিক, ঠিক যেমনটি ন্যায়সংগত ছিল ১৯৪৩-এ নাৎসি জার্মানিতে নিপীড়িত ইহুদিদের ওয়ারশ-ঘেটো অভ্যুত্থান। (হামাস ও অন্যান্য প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ওঠা) ধর্ষণ/যৌন অত্যাচারের অভিযোগের পুরোটাই বানানো গল্প; এইসব গল্প ছড়িয়ে ইসরায়েল আসলে নিজের গণহত্যার রাজনীতিকে একটা মান্যতা দিতে চাইছে।’
(রিফাত আলআরির-এর বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে)
পেপার কাটিং-২/ ডিসেম্বর ২০২৩
“আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক মিনিট আগে আমার বন্ধু কবি রিফাত আলআরির ইসরায়েলি বিমান-হানায় শহীদ হয়েছে। ওর নিজের ভাই, বোন এবং তাঁদের চারজন সন্তানের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে ওই বিমান-আক্রমণ। আপনারা জানেন, রিফাত গাজা ইসলামিক ইউনিভারসিটিতে ইংরেজির অধ্যাপক এবং লেখক ছিলেন, ‘গাজা স্ট্রাইক্স ব্যাক’ সংকলনটির সম্পাদনাও করেছিলেন। মাত্র দু’-মাস আগে রিফাত আমাকে জিগ্যেস করেছিল– “আমি কি তোমার নাম ‘উই আর নট নাম্বার্স’-এ যুক্ত করতে পারি?” (‘উই আর নট নাম্বার্স’ একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যেখানে ফিলিস্তিনি কবি-লেখকদের ইংরিজিতে লেখার মাধ্যমে সারা দুনিয়ার সামনে নিজেদের আখ্যান তুলে ধরতে সাহায্য করা হয়)… আমরা দু-জনেই স্ট্রবেরি তুলতে ভালোবাসতাম, দু-জনে মিলে উত্তরের দিকে যেতাম, স্ট্রবেরি তুলে খেতে খেতে গল্প করতাম। ও কক্ষনো বাড়ির সবার জন্য স্ট্রবেরি নিতে ভুলত না।”
(কবি মোসাব আবু তোহা-র স্মৃতিচারণ)
পেপার কাটিং-৩/ ডিসেম্বর ২০২৩
ইউনিভারসিটি কলেজ অফ লন্ডন-এ সদ্যনিহত রিফাত আলআরির-এর স্মরণে জমায়েত হওয়া ছাত্র ও শিক্ষকেরা দাবি তুলেছেন যে এই হত্যার ব্যাপারে ইউনিভারসিটি কর্তৃপক্ষকে বিবৃতি দিতে হবে, কারণ রিফাত আলআরির ইউসিএল-এর ছাত্র ছিলেন। এই জমায়েতটি হয়েছিল ইউসিএল-প্যালেস্টাইন সলিডারিটি-র ডাকে।
পেপার কাটিং-৪/ ডিসেম্বর ২০২৩
ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান হিউম্যান রাইট্স মনিটর স্পষ্ট বিবৃতিতে দাবি করেছে– রিফাত আলআরিরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। পুরো কমপ্লেক্সের মধ্যে যে অ্যাপার্টমেন্টে তিনি ছিলেন, তাকে চিহ্নিত করে বোমা ফেলা হয়েছে। এর আগে একাধিক ইসরায়েলি অ্যাকাউন্ট ও নম্বর থেকে লাগাতার তাঁর কাছে হত্যার হুমকি মেল/ফোন আসায় তিনি সস্ত্রীক ইউএন রিলিফ স্কুলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেখানে তাঁর কাছে ইসরায়েলি নম্বর থেকে আসা কলে এক অপরিচিত কণ্ঠ তাঁকে বলে যে স্কুলটা কোথায় তারা জানে! এরপরই ওই আশ্রয় ছেড়ে রিফাত তাঁর বোনের বাসায় আশ্রয় নেন। ছানবিন করে এই বাড়িটিকেই নিশানা বানিয়ে রিফাতকে সপরিজন ৬ ডিসেম্বর হত্যা করা হয়েছে।
পেপার কাটিং-৫/ এপ্রিল ২০২৪
গাজা শহরের পশ্চিম প্রান্তে গতকাল রাতে এক বিধ্বংসী বিমান-হানায় একাধিক বাড়ি মাটিতে মিশে গিয়েছে। যাঁরা এই আক্রমণে মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শায়মা রিফাত আলআরির। শায়মা চারমাস আগে ইসরায়েলি বোমারু বিমান-হানায় শহীদ কবি রিফাত আলআরির-এর মেয়ে।
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………….
যদি আমি মরে যাই
তোমরা বেঁচে থেকো
আমার কথা বলার জন্য
আমার যা কিছু বেচে দিয়ে
একফালি কাপড় আর
অনেকটা সুতো কিনবার জন্য
(লম্বা লেজের মতো সুতো আর কাপড়টা যেন সাদা হয়)
যাতে এই গাজার কোথাও একটা বাচ্চা আকাশের দিকে
মুখ তুলে যখন তার বাবাকে খুঁজবে–
খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে যে বাবা
কারোকে বিদায় না জানিয়েই
নিজের রক্তমাংসকেও নয়
এমনকি নিজেকেও নয়–
সে আমার জন্য বানানো ঘুড়িটাকে
দেখতে দেখতে এক লহমার জন্য
হয়তো ভাববে কোনও দেবদূত ওখানে
ভালোবাসা নিয়ে ভেসে রয়েছে।
যদি আমি মরে যাই
তা যেন আশা নিয়ে আসে
তা যেন গল্প হয়ে ফিরে ফিরে আসে।
[‘আমি মরে গেলে’ রিফাত আলআরির-এর শেষ কবিতা। এই লেখার শিরোনামের পঙক্তিটি (কামানের মুখে কলহাস্যে…) কমলেশ সেনের কবিতা থেকে নেওয়া]
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ