কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে এরকম একটি কিংবদন্তি চালু ছিল যে, তিনি রুশ ভাষা জানতেন। সুভাষদা যেমন ‘যাই একটু মস্কো থেকে ঘুরে আসি’– এমন একটা ভাব দেখিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিতেন এবং যেহেতু তিনি রুশ গল্প ও উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন অতএব দুয়ে দুয়ে চার করে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে তিনি অবশ্যই রুশ জানতেন।
১৬.
মুখুজ্যের সঙ্গে আমার আলাপ যে প্রথম কবে হয়, তা মনে নেই, অবশ্য মনে না থাকলেও ক্ষতি নেই। কোনও কোনও মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের শেকড়টা এতদূর গভীরে চলে যায় যে, মনে হয় সেটা যেন আজন্মকালের। উনিও সেই গোত্রের একজন মানুষ আমার কাছে। ওঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় বিগত শতকের সাতের দশকের শুরুতে, কোনও এক সময়।
দেশ নয়, বিদেশের মাটিতেই তাঁর সঙ্গে আমার এবং আমার পরিবারের সকলের ঘনিষ্ঠতা। মস্কোয় থাকার সময় মানুষ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আরও বেশি করে মাটির কাছাকাছি পেয়েছি। কী করে কাঁচালঙ্কা বেশিদিন টাটকা রাখা যায়, কী দিয়ে কী রান্না করলে ভালো হয়, সে সবের সুলুকসন্ধানও তিনি দিতে পারতেন পাকা গৃহিণীর মতো। অবসর সময় মাছ ধরার নেশা ছিল। মস্কো নদীতে ছিপ ফেলে স্থানীয় শখের মৎস্যশিকারীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখে তিনি যেমন মুগ্ধ হতেন, তেমনই বিদেশিদের পক্ষে সে অনুমতি মেলে না বলে আক্ষেপও প্রকাশ করতেন। দেশে মৎস্যশিকারে গিয়ে নিজে তিনি কখনও বড় রকমের কোনও রাঘব বোয়াল ধরতে পেরেছিলেন কি না, সে কথা জিজ্ঞেস করলে মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে যেতেন। সুভাষদার মাছ ধরার প্রসঙ্গ উঠলেই গীতাদি হাসতে হাসতে বলতেন: ‘মাছটা আসে বাজার থেকে– তাও কানকোটা, মাথাটা, ল্যাজাটা।’ মস্কোয় এসেও তিনি ভালো ছিপ, বঁড়শি, হুইল, এমনকী, ফাতনারও সন্ধান করতেন। দোকানে গিয়ে তাঁকে কিনে দিয়েছি, অনেক সময় ওঁর জন্য আগে থাকতে কিনেও রেখেছি।
মুচকি হেসে যেকোনও বিতর্কের পাশ কাটিয়ে যাওয়াটা বোধহয় সুভাষদার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। তর্কপ্রিয় তিনি আদৌ ছিলেন না, অথচ শেষ বয়সে তিনিই কি না একটা বড় রকমের বিতর্কের মধ্যে জড়িয়ে পড়লেন!
একবার মনে আছে, খুব সম্ভবত ১৯৮৩ সাল তাঁর ‘অন্তরীপ বা হ্যানসনের অসুখ’ উপন্যাসটি সবে প্রকাশিত হয়েছে, সুভাষদা তখন মস্কোতে। উপন্যাসের একটা ত্রুটির প্রতি আমি সুভাষদার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ওইভাবেই মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে সবিনয়ে বলেছিলেন, ‘হতে পারে, ও ভাবে ঠিক ভাবিনি।’
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে কলকাতার কোনও এক সাহিত্যপত্র তাঁর স্মরণে একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। প্রচ্ছদে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রতিকৃতিটা এঁকেছিলেন কলকাতার কোনও এক খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। ছবিতে সুভাষদাকে যে একেবারেই চেনা যাচ্ছিল না এমন নয়, কিন্তু মানতেই হবে ইনি আমাদের চেনা সুভাষ নন– অমন বিক্ষুব্ধ, বিরক্ত ও রাগী চেহারার মানুষ আমাদের সুভাষদা হতে পারেন না কি? মুখের আদল, মাথায় পাখির বাসা সেই একই, কিন্তু রেখাগুলি কেমন যেন বেয়াড়া। মুখের সেই পরিচিত মুচকি হাসিটিই নেই– ওটা না থাকলে কীসের সুভাষদা? এই রেখাগুলি ঠিকমতো ধরতে না পারলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, শুধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কেন– যেকোনও মানুষের এবং যেকোনও সৃষ্টিরই প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে এরকম একটি কিংবদন্তি চালু ছিল যে, তিনি রুশ ভাষা জানতেন। সুভাষদা যেমন ‘যাই একটু মস্কো থেকে ঘুরে আসি’– এমন একটা ভাব দেখিয়ে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দিতেন এবং যেহেতু তিনি রুশ গল্প ও উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন অতএব দুয়ে দুয়ে চার করে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি অবশ্যই রুশ জানতেন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর অনূদিত ‘রুশ গল্প সঞ্চয়ন’-এর ভূমিকায় জানিয়েছেন: ‘বক্সা বন্দী নিবাসে যখন আমরা একসঙ্গে ছিলাম, কাটুদা (সুনীল কুমার বসু) তখন রুশ ভাষা শিক্ষার বইপত্র আর লিঙ্গুয়াফোনের রেকর্ড আনিয়ে রুশ ভাষা শেখার তোড়জোড় করেন। সঙ্গে আমাকেও জুটিয়ে নেন। যখন সবে বর্ণপরিচয় শেষ করেছি, ঠিক সেই সময় আদালতের রায়ে ছাড়া পেয়ে গেলাম। ফলে জেলে বসে নির্ঝঞ্ঝাটে ভাষা শেখার সুযোগ চিরদিনের মতন হাত ছাড়া হয়ে গেল।’
সুভাষদা মস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় ও অর্থানুকূল্যে পরিচালিত বেশ কতকগুলি আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্য ছিলেন– তাই অ্যাফ্রো-এশিয়া সংহতি সমিতি হোক, বিশ্বশান্তি পরিষদ হোক বা পৃথিবীর যেকোনও দেশের বিভিন্ন বামপন্থী লেখক শিল্পী সংঘই হোক, সব জায়গা থেকেই নানা উপলক্ষে তিনি আমন্ত্রণ পেতেন, আর সেসব জায়গায় বিমানের টিকিট যেহেতু হত আয়রোফ্লোত-এর, তাই মস্কো হয়েই তাঁকে যেতে হত– এমনকী, আসা-যাওয়ার পথে মস্কোতে তাঁর দু’-একদিন থাকার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হত। তাছাড়া আলাদাভাবে সোভিয়েত লেখক সংঘ বা সোভিয়েত মৈত্রী সংঘের আমন্ত্রণ তো তিনি পেতেনই। এমনকী, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্যও সেখানে তাঁর যাতায়াত ছিল। এই সমস্ত কারণে ভাষা না জানা সত্ত্বেও সে দেশের রীতিনীতি সম্পর্কে তাঁর এমন একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, যার ফলে রুশ-জীবনের মর্মস্থলে তিনি প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। ভাষা না জানাটা তেমন একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..
সুভাষদা অন্য অনেক ভ্রমণকারীর মতো ইংরেজি ভাষা সম্বল করেই পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে তা দিয়ে তেমন একটা সুবিধে হত না– এমনকী, সেখানকার বুদ্ধিজীবী মহলেও না। তবে ভ্রমণকারী হিসেবে তাঁর দুটো বড় গুণ ছিল: বিদেশে একবার কোনও জায়গায় রুট বা যাত্রাপথ দেখিয়ে দিলে দ্বিতীয়বার কারও সাহায্য ছাড়া, বিনা বাক্যবিনিময়ে ট্রামে, বাসে চেপে ঠিক সেখানে পৌঁছে যেতে পারতেন– কোনও ভুল হত না। দ্বিতীয়ত, ভাষা ছাড়াই বা অল্প ভাষায় ভাব বিনিময়ের অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর ছিল।
হোটেল থেকে আমার বাড়ির রাস্তা ঠিক এইভাবেই তাঁর চেনা হয়ে গিয়েছিল। শুধু একবারই বিপত্তি হয়েছিল। ১৯৮২ সালের ঘটনা। তখন হেমন্তকাল। গাছপালা সোনালি পাতা ঝরিয়ে দিয়ে ন্যাড়া ডালপালা ছড়িয়ে শীতের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। দিনও অনেক ছোট হয়ে এসেছে। সে দিন সন্ধ্যায় আমার নতুন ফ্লাটে সুভাষদার আসার কথা। এই ফ্ল্যাটটা সুভাষদাকে চিনিয়ে দেওয়া হয়নি, কিন্তু বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর আর পথ নির্দেশিকা তাঁকে লিখে দিয়েছিলাম। বললেন, ঠিক পৌঁছে যাবেন।… রাত আটটা বাজতে চলল, রীতিমতো অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, বাইরে এলোমেলো হাওয়া বইতে শুরু করেছে, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। হোটেলের রুমে ফোন করতে কেউ ফোন তুলল না, অর্থাৎ উনি বেরিয়েছেন। তখন মোবাইলের যুগ নয়, তাই যোগাযোগের আর কোনও উপায় নেই। রাত প্রায় ন’টার দিকে আমার বাড়ির টেলিফোন বেজে উঠল: সুভাষদা ফোন করছেন কোনও একটা পাবলিক বুথ থেকে– কোথায় নেমেছেন বুঝতে পারছেন না– আমরাই বা কী করে বুঝব? বললাম, একজন পথচারীকে ইশারায় ডেকে রিসিভারটা ধরিয়ে দিন। তার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, উনি আগের স্টপে নেমে পড়েছেন। সুভাষদাকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে তাঁকে নিয়ে আসার জন্য ছুটলাম।
(চলবে)
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি