এদিকে হয়েছে কী, ‘চ’ ক্যাসেট বেরনোর পরদিন থেকে জীবন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। আনন্দবাজারে প্রায় চার কলাম জুড়ে প্রকাশ পেয়েছে অ্যালবাম প্রকাশের খবর, সর্বাগ্রে শঙ্খবাবু। ঋতুপর্ণ আছে, তবে তা সহনায়কের ভূমিকায়। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা অ্যালবাম নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। চারিদিকে ‘চ’ নিয়ে একটা সাজো সাজো রব! ঋতুদা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা গোলমাল। পরদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার রে?’
৩৪.
বিদ্যাসাগর আবাসনের বাড়িতে সকাল এগারোটায় পৌঁছে গিয়েছি ঠিক। তেমনই সময় পাওয়া গিয়েছে। মূর্তিমান দুই ভূতের মতো আমি আর চন্দ্রিল বসে রয়েছি একরাশ উৎকণ্ঠার ঝাঁকা মাথায় চাপিয়ে। জয়দেবই সময় করে দিয়েছে। ‘স্যর টাইম দিয়েছেন, দেরি করবি না।’
‘রেগে আছেন?’
জয়দেব বিচ্ছিরি টাইপ হাসল। ‘আমি যা বলার বলে দিয়েছি, একেবারে মুখের ওপর।’
‘কী বললে?’
‘কী আবার, আপনি জলের ধার ঘেঁষে থাকবেন, আর কেউ আপনাকে ঠেলা মারবে না, তা কি হয়? ফলে যা হওয়ার ছিল, হয়েছে, সংস্কৃতির ঋণ শোধ করেছেন।’
‘এটা তুমি বলতে পারলে?’
জয়দেব স্বভাবোচিত হেঁচকি হাসি চালাতে লাগল।
এদিকে হয়েছে কী, ‘চ’ ক্যাসেট বেরনোর পরদিন থেকে জীবন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে। আনন্দবাজারে প্রায় চার কলাম জুড়ে প্রকাশ পেয়েছে অ্যালবাম প্রকাশের খবর, সর্বাগ্রে শঙ্খবাবু। ঋতুপর্ণ আছে, তবে তা সহনায়কের ভূমিকায়। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় গোটা অ্যালবাম নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। চারিদিকে ‘চ’ নিয়ে একটা সাজো সাজো রব! ঋতুদা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা গোলমাল। পরদিন ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার রে?’ বললাম। কীরকম মিইয়ে যাওয়া গলাতে বলল, ‘ও।’ তারপর একটু থেমে, ‘তোদের কিন্তু গিয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত।’ বটেই তো, চাওয়া তো উচিতই। আর সে কারণেই তো হত্যে দিয়ে পড়ে আছি দুই মূর্তি।
শঙ্খবাবু আসছেন না দেখে আরও টেনশন হচ্ছে। এ বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী জল-মিষ্টি আগেই দিয়ে গিয়েছে কেউ। সেসব দাঁতে কাটার সাহস হয়নি এখনও। স্যর কী বলবেন, কতটা বিরক্ত কে জানে! কী করে যে বোঝাব গোটা ঘটনাটায় আমাদের কিছু করার ছিল না। একজন উদোমাদা কালচারপ্রেমীর জন্য এ দশা– সে কথাই বা বোঝাব কী করে? শঙ্খবাবুর গলার আওয়াজ পেলাম। ভিতর বাড়িতে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করলাম তাঁর পায়ের শব্দ।
যেদিন কাগজে কাগজে ‘চ’-এর খবর, সেই দিন সন্ধেয় তরুণ চট্টোপাধ্যায়ের নীলাচল আবাসনে একটা ঘরোয়া পার্টি। সব আমাদেরই জন্য। হঠাৎ করে জীবনে গুরুত্ব বেড়ে গেলে মানুষ বেতালা হয়ে যায়। আমারও সেই দশা হল। অপরিমিত মদ্যপান করে, ভুলভাল বকে, টলমল পায়ে বাড়ির রাস্তা চণ্ডীবাড়ি স্ট্রিটে ফিরি। তখন রাত দেড়টা হবে। দরজা খোলার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখি উল্টোদিকের রকে একটা ক্যামেরাওলা মানুষ। কোন একটা চ্যানেল থেকে এসেছিলেন দু’জন। কেন এমন অসময়ে? মিউজিক ওয়ার্ল্ডের চার্টবাস্টার (সেরা দশ)-এ চন্দ্রবিন্দুর ক্যাসেটটি একনম্বরে। সেই খবরটা করতে। আমার সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছিল না! রাত দুটোর সময় আমার ঘরে ইন্টারভিউটি হয়। তখন আমি একটা চৌকির ওপর শুই, চূড়ান্ত অগোছালো এক উড়নচণ্ডী জীবন। ওই প্রথম ক্যামেরার সামনে কথা বললাম।
শঙ্খবাবু নিঃসাড়ে এসে বসলেন। তাঁকে দেখে আমরা ওঠার উপক্রম করতেই হাত নেড়ে বসিয়ে দিলেন। মাথা নিচু করে বসে রইলাম। কীভাবে যে কী বলব, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। এখন মনে হচ্ছে, কী ভাগ্যিস ভুল করে লোকটা শঙ্খবাবুকে মঞ্চে তুলে দিয়েছিল। তার ফলেই না এমন হইচই, ছবিছাবা। একটা মানুষের মিউজিক ওয়ার্ল্ড আসা নিয়ে এতবড় যে ইস্যু হতে পারে, তাই জানা ছিল না। ঘরে গুজগুজে নীরবতা। কে যে আগে কথা পাড়ব, জানি না একেবারেই।
ঋতুদা বার দশেক ফোন করে ফেলেছে একদিনের মধ্যে। কখনও ‘হ্যালোজেন বৃষ্টিকে রং লিখে ঘর পাঠায়’-এর জন্য, আবার কখনও ‘কবির রক্ত চাটে শহরের ট্রাম’-এর জন্য। এতবার ফোন করায় অবাক লাগছে, কিন্তু বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার। একবার ফোন করে বলল, কী করে লিখলি– ‘তুমি মায়ের মতোই ভালো’? তার আবার খানিকক্ষণ পর, ‘তুই তো বাঙাল নোস, এপার বাংলা। তোর কী করে ব-এ শূন্য র আর ড-এ শূন্য ড় গন্ডগোল হয়?’ যত বলি ‘হয়নি’, তত বলে, ‘এলেই শুনিয়ে দেব এক্ষুনি।’ ঋতুদাকে দেখে মনে হচ্ছে, বাচ্চা ছেলেরা যেমন অবসেসড হয়ে যায় বিশেষ খেলনা নিয়ে, ঋতুদার অবস্থা তাই। ভয় লাগছে, অবাক লাগছে, ভালো লাগছে– তিন-চার রকমের অনুভূতি একযোগে। সবই তুমুল হচ্ছে, কেবল শঙ্খবাবুর ঘটনাটা গোপন কাঁটা হয়ে খুব খচখচানি দিচ্ছে।
শঙ্খবাবুর দৃষ্টি আমাদের পেরিয়ে অন্য কোথাও নিবদ্ধ। আমরা সেই অন্তর্ভেদী চোখ দুটোর মোকাবিলা করতে পারব না, তাই ঢাল-তরোয়াল মাটিতে নামিয়ে বসে আছি। যত সময় যায় যাক, আজ যে কোনও মূল্যে ক্ষমা নিয়েই ফিরতে হবে। আবার এক পাত্র চা এল, ধোঁয়া ও বিস্কুট সহযোগে।
আশা অডিও সূত্রে জানা গেল, মাত্র দেড়দিনে ‘চ’-এর রিপিট অর্ডার যায়। এত তাড়াতাড়ি বিক্রি হচ্ছিল সব। ট্রেডের ভাষায়– মুভমেন্ট খুব ভাল। মহুয়া জানাল, খুব তাড়াতাড়ি সিডি বের করে দেওয়া হবে। আর একটা অনুষ্ঠান করব আমরা। তার প্ল্যান করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। মহুয়ার প্রশ্ন, ‘আর কে কে আসতে পারে বলো তো?’
নীরবতার পাহাড় ঠেলে প্রথম কথা বলেছিলেন শঙ্খবাবুই। ‘চা তো ঠান্ডা হয়ে যাবে না খেলে।’ ওইটুকু বৃষ্টি দেখেই সটান ছাতাখুলে সাষ্টাঙ্গে… ‘আসলে ওই যে ভদ্রলোক, ওঁকে তো পইপই করে বলা ছিল… তারপর যখন…’ বেয়াড়া ছাত্রদের নালিশেও মাস্টারমশাই মজা পান। স্বভাবস্বরে গলা নামিয়ে, ‘যা হওয়ার তো হয়ে গেছে, ছেড়ে দাও। ক্যাসেট বাড়ি এসে শুনেছি। শুনতে বেশ লেগেছে।’
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?