মূর্তি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু হয়তো ভাঙবে কিছুদিনের জন্য। জানি না, সৈন্যদলের উদ্যোগে যে অস্থায়ী ‘সর্বদলীয়’ (এতে আপাতত প্রধান দল আওয়ামি লীগ থাকবে না) তারা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কী নীতি নেবে। বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপন্ন বোধ করছে, তাদের আশ্বাস দেওয়ার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেবে। আওয়ামি লিগকে সমর্থন করেন প্রচুর কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও শিল্পী তো চিহ্নিত হয়ে আছেন। তাঁদের দশা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। রাজনীতির জন্য নয়, তাঁরা বাঙালির সম্পদ বলেই।
টেলিভিশনে সবই দেখাচ্ছে। একটি মূর্তির কাঁধে চড়ে বাংলাদেশের এক নাগরিক তার মাথায় হাতুড়ি মারছে, ইচ্ছে মূর্তিটিকে ভেঙে ফেলা। তার গলায় কিছু দড়ি বা কাছিও ঝুলছে দেখলাম। হয়তো এর পরে ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলে কোরাস শুরু হবে, মূর্তিটা জনতার টানে ভেঙে পড়বে।
এমন ঘটনা বাংলাদেশে বিস্ময় উদ্রেক করছে কি? বা বাহির বিশ্বে? করার কথা নয়, কারণ মূর্তিটি যাঁর, তাঁকে তো এর আগে হত্যাই করা হয়েছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তারই পরে বাংলাদেশের মানুষেরাই তাঁর মূর্তি গড়েছিলেন, আবার তাঁরাই তা ভাঙলেন। আবার কি কখনও এই মূর্তি উঠবে?
শেষ প্রশ্নটা অবান্তর নয়, কারণ এই মানুষটি বাংলাদেশের স্রষ্টা, স্লোগানের ভাষায় ‘জাতির পিতা’। তিনি পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন, একটি নতুন দেশ সৃষ্টি করে। তখন সারা দেশের মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিল, তাঁকে নিয়ে কী করবে ভেবে পায়নি। কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ স্থির থাকেনি। তাঁকে হত্যা করা হল, তাঁর আদর্শকে বর্জন করা হল, সামরিক শাসন এল। আবার তারও দিন শেষ হল। এইভাবে তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে জোয়ার-ভাটা চলেছে। পরে তাঁর কন্যাকে গ্রহণ করে বাংলাদেশ। কন্যা যেন তাঁরই বিস্তার। ক’-দিন আগেও বাংলাদেশে প্রতি সভার শেষে স্লোগান উঠত, ‘জয় বাংলা’, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা জিন্দাবাদ’। এবং আরও কিছু। এখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি হয়তো কষ্টেসৃষ্টে টিকে যাবে, যদি যায়। কিন্তু বাকি সব স্লোগান বাংলাদেশের মানুষ আর উচ্চারণ করতে সাহস করবে না। বা ইচ্ছে করে বাতিল করবে, যেমন তাঁর কন্যাকে উৎখাত করেছে। এই বাতিল স্লোগানগুলো কি একটু বেশি বেশি উচ্চারিত হত, মূর্তিগুলো কি সংখ্যা একটু অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছিল, পূজার এই অভ্যাস কি একটু বেশি প্রদর্শনধর্মী হয়ে গিয়েছিল? হয়তো তাই।
ফলে বাংলাদেশের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী আর একবার শেখ মুজিবকে ত্যাগ করেছে, পরম বিতৃষ্ণায়। তাঁর গৃহ লুট করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে তাঁর স্মারক জাদুঘর। সৈন্যবাহিনী তাঁর কন্যাকে হত্যা করেনি, বরং তাঁর জীবনরক্ষার জন্য তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাঁদের ধন্যবাদ। কিন্তু মুজিবের চিহ্ন বা স্মৃতিকে রক্ষা করতে পারেনি। খুব চেষ্টা করেছিল কি? হয়তো করেছিল, কিংবা হয়তো জনরোষের বল্গা টেনে ধরতে সাহস করেনি, তাতে আরও রক্তপাত হত হয়তো।
২.
মূর্তি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু হয়তো ভাঙবে কিছুদিনের জন্য। জানি না, সৈন্যদলের উদ্যোগে যে অস্থায়ী ‘সর্বদলীয়’ (এতে আপাতত প্রধান দল আওয়ামি লীগ থাকবে না) তারা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কী নীতি নেবে। বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপন্ন বোধ করছে, তাদের আশ্বাস দেওয়ার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেবে। আওয়ামি লিগকে সমর্থন করেন প্রচুর কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও শিল্পী তো চিহ্নিত হয়ে আছেন। তাঁদের দশা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। রাজনীতির জন্য নয়, তাঁরা বাঙালির সম্পদ বলেই। রাতারাতি মতামত বদলানো আত্মরক্ষার একটা উপায় বটে, কিন্তু সবাই যদি সেটা রুচিকর মনে না করেন? পরে যখন একটি নির্বাচিত সরকার আসবে তাদেরই বা অবস্থান কী হবে। এটা একটা প্রশ্ন। আর একটা প্রশ্ন হল, শেখ মুজিবের খুবই প্রিয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে এক ব্যক্তি, যাঁর একটি গান বাংলাদেশেরও জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। জানি না, সে গানটির ভাগ্য কোনদিকে দুলবে। বাংলাদেশের পাঠ্যতালিকায় তিনি কতটা হাজির থাকবেন।
বাংলাদেশে কি মুজিব আবার ফিরবেন? আগে তো ফিরেছেন! দেখা যাক। বাঙালি এক আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যায়।