আপনারা জানতেনই না আমি এই পৃথিবীতেই বেঁচে আছি আপনাদের সঙ্গে, আপনারা জানতেনই না আপনাদের কারও নিঃশ্বাস থেকেই আমি প্রশ্বাস নিই। Nobody knew I existed. অথবা আপনারা জানতেন যে আমি বেঁচে আছি আপনাদের পায়ের নিচে কিংবা ঘামের প্রাবল্যে চাপা পড়ে যাওয়ার জন্যই। আপনারা জানতেন আপনাদের ডাস্টবিন কিংবা শৌচালয় আমি যা সুলভ। আমাকে কানা বানিয়ে পদ্মলোচন নাম দিয়ে নিজেরাই ফ্যাক্ফ্যাক্ হেসেছিলেন আপনারা, আমাকে করে নিয়েছিলেন ভাঁড়-জোকার। যদি আমি ভালোবাসতাম কিংবা কাউকে কিচ্ছু না করে গাছে জল দিতাম, আপনারা ফ্যাক্ফ্যাক্ করেই মুড়িয়ে নিতেন সেই গাছ, সমূলে উৎপাটিত করতেন আমার ভালোবাসা, যেমন করে এসেছেন হাজার বছর ধরে।
শপিংমলের ভেতর যে সিনেমা দেখার জায়গাটা ছিল সেটায় বিস্ফোরণ হয়েছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। শপিংমলের কিছু হয়নি। ইতিউতি আগুন জ্বলছে এখনও, ছাই রঙে ভরে গিয়েছে পৃথিবী। হতাহতের খবর নেই, কারণ সিনেমার দর্শক ছিল না। ছিল না কোনও কর্মচারীও। কারণ সিনেমার দর্শকই ছিল না। ফলে সরকার বা প্রশাসন কেউ কোনও অ্যাকশন নেয়নি। সিনেমাহলটা গলে-ফেটে ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে শপিংমল থেকে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যস্ত রাস্তায়। মিনিট দুয়েক যানজট হয়েছিল, তারপর সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, কারণ রাস্তার এখন অনেক অপশন।
সিনেমাহলের ধ্বংসস্তূপটাকে ঘিরে অনেক পাহাড়, জঙ্গল, নদী ও ফ্লেক্স দেখা যাচ্ছে। শহরে সৌন্দর্যায়নের জন্য বানানো হয়েছিল। হঠাৎ, শতচ্ছিন্ন প্রোজেকশন রুমের একটা অংশ নড়ে উঠল। একজন সর্বাঙ্গে ছাই মেখে উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। মাটির সঙ্গে মিশে ছিঁড়ে যাওয়া পর্দা আর টয়লেট ন্যাপকিন ফাঁক করে মাথা তুলল আরেকজন। তারও সর্বাঙ্গে ছাই। দশমাস দশদিন অতল জলে ভেসে ভেসে হঠাৎ দ্বীপ দেখলে যেমন হয়, একে অপরের দিকে তাকিয়ে তেমনই চেঁচিয়ে উঠল ওরা– Can we have a cigarette?
আলাপে জানা যায় একজনের নাম ‘অ’, আরেকজনের ‘আ’। অ আর আ দু’জনে একটাই সিগারেট খাচ্ছে– তাই দু’জনকেই একে-অপরের কাছে এসে সিগারেট পাচার করে আবার দূরে চলে যেতে হচ্ছে ধ্বংস মাড়িয়ে। ‘চলে যেতে হচ্ছে’ না বলে বলা যায়, ‘চলে যাচ্ছে’। কেন যাচ্ছে, জানলেই আর যেতে পারত না, সন্তানের মুখ ধরে চুমো-টুমো খেয়ে ফেলত। বোধহয় চলে যেতে হয় বলেই চলে যাচ্ছে, না হলে তো আরেকটু থাকত। একথা ভাবতে গিয়ে কেউ খেয়ালই করেনি যে একটা লাল ছোপ সিগারেটের সাদা কাগজে জ্বলজ্বল করছে। কোত্থেকে এল জানতে আবার দু’জন দু’জনের কাছে এগিয়ে এল। দু’জনেই অন্যের ঠোঁটের কোণ দেখে এবং ছুঁয়ে আবিষ্কার করল ভোটের কালির মতো একটুখানি রক্ত। দু’জনেই ভাবল, something is wrong in the state of mind. দু’জনেরই ঠোঁটের কোণে রক্ত ছাড়াও জেগে উঠল হাসি। দু’জনেই বলল– আইলাভিউ!
জনসভায় চিৎকার করে মিথ্যে বলার মতো হাঁক শোনা গেল– let’s give the people what they want. ঝিন্চ্যাক ঝিন্চ্যাক টুকুরুক্ টুকুরুক্ বাজনা শুরু হয়ে গেল। দুমাদুম বোম পড়ল আর বর্গি এল, বুলবুলিতে ধান খেল, খোকারা মরে গেল, চাঁদ উঠল, ফুল ফুটল, কদমতলায় হাতি-ঘোড়ার সঙ্গে সবাই নাচল বেদম আর ভাবল– জিনা ইসিকা নাম হ্যায়। হঠাৎ বাজনা বন্ধ হয়ে গিয়ে দৈববাণী শোনা গেল– তুমি স্বাধীনতা চাও না। তোমরা স্বাধীনতা চাও না। তোমরা চাও কেউ তোমাদের বলুক তোমরা স্বাধীন। দৈববাণী মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার রেশ থেকে গেল কিছুটা, আমফানের মতো। নাচ থেমে যাওয়ায় কী করবে বুঝতে না পেরে এবং খারাপ অভিনয়ের মতো মাথা চুলকে সবাই এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে মাটির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ছায়া। ফ্যাক্ফ্যাক্ করে হাসছে সে। শালা মা-বাবা শিক্ষা দেয়নি? অন্যের দুঃখে হাসছিস? বলেই সবাই নিজের ছায়াকে মারতে লাগল। ছায়াগুলো পিছলে গেলেই একজনের মার গিয়ে পড়ল আরেকজনের ওপর। শেষ পর্যন্ত উন্মত্ত মব, মব লিঞ্চ করে, মব মেরে ফেলল। ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল পঞ্চভূতে। কিন্তু দেখা গেল এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে, ভূতগ্রস্তের মতো স্থবির, হাতে প্রশ্নপত্র। এতক্ষণ মবের মধ্যে দেখা যায়নি ওদের। ওরা মারেনি ওদের ছায়াকে। মারতে পারেনি। হাতে প্রশ্নপত্র ছিল। প্রশ্ন: আলো বলতে কী বোঝো? একজন বলে– আলো এক প্রকার শক্তি, যা তরঙ্গের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে আমাদের দর্শনের অনুভূতি ঘটায়। আলো নিজে দৃশ্যমান নয় কিন্তু অন্য সকল বস্তুকে দৃশ্যমান করে তোলে। ঝিন্চ্যাক ঝিন্চ্যাক টুকুরুক্ টুকুরুক্ বাজনা হয়ে শেষ হয়ে গেল। প্রশ্ন: ছায়া কাকে বলে? আরেকজন বলল, আলোর গতিপথে কোনও অস্বচ্ছ বস্তু থাকলে বা রাখলে বস্তুটির পিছনে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলের সৃষ্টি হয়। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলটিকে ছায়া বলা হয়। ঝিন্চ্যাক ঝিন্চ্যাক টুকুরুক্ টুকুরুক্ বাজনা হয়ে গান বাজল– ‘ভালো করে তুমি চেয়ে দেখো/ দেখো তো চিনতে পারো কি না/ আমার দু চোখে চোখ রেখে দেখো/ বাজে কি বাজে না মনোবীণা’। ওরা দু’জন দেখল হাতের প্রশ্নপত্র দুটো আয়না হয়ে গেছে। আয়নায় ওরা দেখল, ঠোঁটের কোণে ভোটের কালির মতো একটুখানি রক্ত।
‘আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখি।
চুল আঁচড়াই, দাড়ি কামাই,
কখনও নিজেকে ভাল করে দেখি,
ফিসফিস করে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি,’
Who’s there?
আয়নায় টোকা দিই knock knock
“কখনও কখনও নিজেকে বলি,
‘ছেষট্টি বছর বয়েস হল,
যদি আর অর্ধেক জীবন বাঁচো,
শতায়ু হবে।’
নিজের রসিকতায় নিজেই হাসি
নিজে অর্থাৎ আমি নিজে এবং আয়নার নিজে।
এইরকমভাবে একদিন,
কথা নেই, বার্তা নেই আয়নার নিজে
কী কৌশলে আয়নার থেকে বেরিয়ে আসে।
আমি তাকে বোঝাই, ‘এ হয় না, এ হতে পারে না।’
সে আমাকে বোঝায়, ‘এ হয় না, এ হতে পারে না।’
আয়নার সামনে এইরকম কথা কাটাকাটি হতে হতে
হঠাৎ সে আমাকে এক ধাক্কায়
আয়নার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
তারপর থেকে আমি আয়নার ভিতরে।’’
কে বাইরে? কে ভেতরে? ছায়া আমার নাছোড় নাকি আমি নাছোড় ছায়ার? আমার পাপ কি ছায়ারও পাপ নাকি ছায়ার পাপেই আমি পাপী? হয়তো আমি তুলে আছি আঙুল, অথচ ছায়ায় হাতে বন্দুক আমার। বাগানে দোল খাচ্ছি দোলনায়, অথচ ছায়ায় ঝুলে আছি গলায় দিয়ে দড়ি। ছায়া আমাদের ছেড়ে যায় না, এমন কথা শোনা গেছে বহুবার, কিন্তু এ কি সত্যি? ছায়া তো ছেড়ে যায়, অন্ধকারে। নাকি অন্ধকারই ছায়া? Folie à Deux-এর দু’জন, যারা ভাগ করে নিয়েছে বা নেবে সমস্ত বিভ্রম-মায়া-মোহ-ক্ষ্যাপামো, সেই দু’জন– তারা কি তবে আমি আর আমার ছায়া? Shared madness? প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই, কিন্তু পুলিশ সে কথা জানে না, বোঝেও না। উত্তর না পেয়ে খুব মারে, খুব মারে, খুব মারে আর আমাদের 4:3 জীবন থেকে রক্ত উপচে ছিটকে পড়ে 16:9 কিংবা IMAX-এর বিস্তৃত ধরণিতে। রক্ত লেগে আর জেগে থাকে সর্বত্র। তেমন জেগে থাকে কয়েদিরা। অপরাধীরা। আরেকটি অপরাধের ইশারায় অথবা আরেকটি প্রভাতের উষ্ণ অনুরাগে। জেলে ইস্পাতকঠিন বদ্ধদ্বারের মাঝে একটুখানি কাটা। ওই ফাঁক দিয়েই ঈশ্বর আসবেন বা আসছেন বলে মনে করে জেলবন্দিরা, the saints are coming. ওই ফাঁক দিয়েই নিকষ অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নিষিদ্ধ আগুন। আলেকজান্ডারের মতো বিশ্বজয়ী হাসি হেসে বুকভরে ধোঁয়া আর কাঁদানে গ্যাস নেয় সিগারেটধারী। হাসে কেন? মানুষ কাঁদে কেন বলা সহজ। কিন্তু কেন যে হাসে, তা কেউ জানে না। যে জীবন কনসেনট্রেশন কিংবা ডিটেনশন ক্যাম্পের, মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয় পৃথিবী জুড়েই, নিয়মিত, কিন্তু সেখানেও বৃষ্টি নামে আর তখনই যদি আকাশের দিকে একবার তাকানো যায়, নিজেকে এবং অপরকে ঢেকে রাখার সমস্ত নিকষ গাঢ় কালো ছাতা কোনও ডিজল্ভ ছাড়াই হয়ে ওঠে রঙিন। হাসির মতোই, কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে বলা গেলেও বলা যায় না কেন গান আসে। কেন আমার সকল হৃদয় কিংবা শরীর কিংবা জীবন কিংবা মৃত্যু তোমারে লক্ষ্য করে নয়, কেন আমার সকল গান তোমারে লক্ষ্য করে? ভাবা যাক, পৃথিবীতে প্রথম কেউ গান গেয়ে উঠলেন, সেই দিনটার কথা। তিনি তো জানতেন না যা তার গলা থেকে বেরিয়ে এল, তা গান। কিন্তু সেই যে প্রথম এককোষী প্রাণীর নড়েচড়ে ওঠার মতো স্বরের অজানা ওঠানামা, তা শুনে তিনি নিজে কি ভয় পেয়েছিলেন? না কি আশ্চর্য হয়েছিলেন? না কি এক অমোঘ দুঃখ হয়েছিল তার? তার কি মনে পড়েছিল মানুষজন্ম? জেগে ওঠা তো গাঢ় বেদনাই। একটা গানের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে গতি মন্থর হয়ে গিয়েছিল যার, কোনও এক হঠাৎ অথচ অনিবার্য ডাকে পিছন ফিরে তাকিয়ে তিনি তার ভাঙাচোরা মুখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন তেমনই কোনও চাপা পড়ে যাওয়া ক্ষীণতম স্মৃতির আবিষ্কার। কানের কাছে শোনা যাচ্ছিল, this is how the other half lives. Could have been all yours if you hadn’t killed five people. ওই তাকিয়ে থাকা তাই নিজের সমস্ত হনন মনে পড়ায়, মনে পড়ায় সমস্ত সমাপ্ত আর আসন্ন বিস্ফোরণ ও বিগ ব্যাং। মনে পড়ায় জীবনের সব অন্ধকার ফুলগাছ। যার দিকে তাকিয়ে এসব মনে পড়ে, সে গান ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে। তাই ঘণ্টি বাজার পরে স্যাঁতসেঁতে কয়েদখানায় ঢুকে যেতে থাকা শরীরটাতেও বাঁক আসে, আসে অনিবার্য এক মোচড় and that’s life.
Funny as it seems
Some people get their kicks just steppin’ on a dream
But I won’t let it get me down
‘Cause this whole world keeps spinnin’ around
I’ve been a puppet, a pauper, a pirate, a poet
A pawn and a queen
I’ve been up and down and over and out
But I know one thing
Each time I find myself flat on my face
I pick myself up and get back in the race
ওদের মনে পড়ে গলিত স্থবির ব্যাঙের কথা, যে আরও দুই মুহূর্ত চায় রয়ে যেতে…so many troubles, but you’re so happy…বাবার ভাঙা অচল ট্রলিভ্যানের ওপর অন্ধকারে বসে বাইক নিয়ে লাদাখ যাওয়ার কথা ভাবে ওরা… you keep on dancing to find your way… ভিখারিদের ডাকাত হতে ইচ্ছে করে, পালাতে পারবে না জেনেও লোহার জাল বেয়ে উঠে পড়তে থাকে আর নাচতে থাকে হাসতে থাকে কারণ সে ভাবে সে আর একা নয়, একা নয় কারণ এ তো ভাগ করে নেওয়া পাগলামো …you’re such a marvel, come on, get happy… গান জেগে উঠলে হাতকড়া হাতও ছুঁয়ে যায় অপর কোনও নরম আঙুল আর নরম গালের পাশে রাত জাগতে থাকে ভালোবাসা …you’re shining on your judgement day… বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন যে ট্যাক্স দিতে হয়, জানি তার নাম নিঃসঙ্গতা। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন পরীক্ষাও দিতে হয়। সেই কবে কোন ছোটবেলায় ইশকুল-হাফপ্যান্ট পরতে শেখা থেকে পরীক্ষার শুরু। আজও, আজও এই বিস্ফোরণের পৃথিবীতেও হাতে পেনসিল আর প্রশ্নপত্র। প্রতিদিনই জাজমেন্ট ডে। কিন্তু আমরা কি পারব আমাদের এই প্রতিটি বিচারদিনে ঝলমল করতে? মরে যাওয়ার আগে বাড়ির জন্য মাছ আনতে? যদি সব দেবতা আর মানুষেরা একজোট আর আমোদিত হয়ে ফাঁসি কিংবা গিলোটিন, ইলেকট্রিক চেয়ার কিংবা ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে মেরে ফেলার কথা বলে আমাকে-আমাদের, আমরা কী করব? শুধু কথায় ব্যক্ত হয় না সবটুকু, তাই সুর আসে।
For once in my life
I won’t let sorrow hurt me
not like it’s hurt me before
for once I have someone
I know won’t desert me
and I’m not alone anymore
for once I can say
this is mine, you can’t take it
as long as I know I’ve got love
I can make it
ঘনঘোর ফ্যাসিবাদেও যেভাবে ফুল ফোটে, ঠিক সেভাবেই সুর জাগলে জ্বলতে থাকা পৃথিবীতে জ্যোৎস্নালোকিত প্রোজেকশনের সামনে দাঁড়িয়ে চুমু খায় মানুষ। ফুটো হয়ে যাওয়া সমাজের পুলিশি পাহারার রাস্তায় স্পটলাইট এসে পড়ে। সাইরেন আর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ তখন শুধুই উপেক্ষাযোগ্য সাউন্ড এফেক্ট। জীবনের এই চন্দ্রাহত উত্তাপ দেখে মৃত্যুও হাসে, যে হাসি ঠিক নয়, যে হাসির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই কারও। বোকা প্রেমের অহংকার দেখে মৃত্যু মনে মনে ভাবে you get what you fucking deserve. চলো চলো চলো মেপে নেওয়া যাক তোমার কী প্রাপ্য। বলো, যাহা বলিবে সত্য বলিবে, সত্য বই মিথ্যা বলিবে না। বলো, তুমি কেন হেসেছিলে। বলো তুমি কেন কেঁদেছিলে? কেন তুমি লুকিয়েছিলে কান্না কিংবা হাসি? কেন তুমি রেগে গেলে? কেন তুমি রাগলে না? কেন তুমি ভয় পেলে না? কেন তুমি ভয় পেলে? কেন তুমি অবাক হলে এবং হলে না? কেন তুমি ভালোবাসলে, ঘৃণা করলে না আর কেন ঘৃণাই তুমি করলে, ভালোবাসলে না? কেন তুমি মরে গেছ? কেন তুমি বেঁচে? বুলবুলিতে ধান খাওয়া সত্ত্বেও খাজনা ঠিকঠাক দিয়েছ কি? কী নাম তোমার? জাত কী? বর্ণ কী? গন্ধ কী? রং কী? ধর্ম কী? দেশ কোথায়? প্রমাণ কোথায় এটাই তোমার দেশ? প্রমাণ কোথায় এটাই তুমি? বাঁচার জন্য সব্বাই বলে অন্য কেউ হুজুর, আমি নই, আমি নির্দোষ। অন্য কেউ অন্য কোনওখানে করেছে, মেরেছে, দিয়েছে গাল, ভেঙেছে তেলের শিশি, ভেঙেছে দেশ, ভেঙেছে ঘর, বুজেছে পুকুর, মেরেছে সোনার মাছি এবং মারতে চেয়েছে একদম ছোটবেলায় যে জোর করে প্যান্ট খুলে হাত দিয়ে দিয়েছিল তাকে, খুচরো জমানোর লাল ভান্ডার না জানিয়েই ভেঙে দিয়েছিল যে, সমস্ত টিফিন খেয়ে নিয়েছিল যে, ইশকুলের যে শিক্ষক কান ধরে শূন্যে তুলে দিয়েছিল, ইংরেজি ম্যাডামকে বিয়ে করেছিলে যে, জানলার ধারে রুমাল রাখা সত্ত্বেও জানলা জবরদখল করেছিল যে যাত্রী নিত্য, অনেক টাকা নিয়েও বাঁজা গাঁদার চারা দিয়েছিল যে, ঘেমেনেয়ে একশো আটটা পদ্ম আনার পরেও কথা রাখেনি যে, লাটাইভরা মাঞ্জা সুতোয় পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল যে, অন্ধের হাতে বোতলের মুটকি দিয়ে কয়েন বলে দাবি করেছিল যে, পোস্টার মেরে যারা বুঝিয়েছিল তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে সরকার কিংবা মাল– এইরকম সবাই, সবাইকেই মারতে চেয়েছে ও। ও মারলেই আমি উদযাপন করেছি, আমোদ করেছি। বলেছি আমি নই হুজুর, ও করেছে। তারপর ওর ছায়ায় নিশ্চিন্তে ঘাপটি মেরে মাথায় তুলেছি ওকে। হয়েছি ফ্যান। কিন্তু যেই ও বলেছে, অন্য কেউ এসব করেনি, আমিই করেছি, আমিই মেরেছি, আমিই দিয়েছি গাল, তখনই খানখান স্তব্ধতা এক। স্তব্ধতা দুই। স্তব্ধতা তিন। স্তব্ধতা অগুনতি। সাময়িক স্তব্ধতার ধাক্কা কাটিয়ে রেগে ওঠে সবাই, যেমন করে ছায়াকে পিটিয়েছিল মবেরা। রেগে গিয়ে জনগণ চিমটি কেটে, থুতু আর টিটকিরি দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে চায়, টের পাওয়াতে চায় this is not a comedy club, you are not on stage.
…………………………………..
পড়ুন অন্য লেখা: অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত, দু’জনের প্রতিই মায়াভরা বিশ্লেষণ
……………………………………
Shut up! Shut up! All the world’s a stage…everybody on stage. সবাই অন্যের চরিত্রে অভিনয় করে কিন্তু আমি তা করছি না আর। আমি ছাড়া আমার আর কোনও চরিত্র নেই। সব আমি। সব। এতদিন আপনাদের ভেতরের সর্বস্ব হিংসা আর অন্যকে পিষে-দলে-মুচড়ে-থেঁতলে দেওয়ার অলৌকিক আকর্ষণ আর লোভ আমার কাঁধে বেতালের মতো চেপে বসে আমাকেই থেঁতলে, পিষে দিয়েছে। আমি মুক্ত হতে চাইছি আপনাদের এই পাহাড়প্রমাণ খুনে-ইচ্ছার দপদপানো ভার থেকে। আমি অস্বীকার করছি এই দায় নিতে কারণ আপনারা কখনও, কোনও দিন আমার কথা ভাবেননি। আপনারা জানতেনই না আমি এই পৃথিবীতেই বেঁচে আছি আপনাদের সঙ্গে, আপনারা জানতেনই না আপনাদের কারও শ্বাস থেকেই আমি প্রশ্বাস নিই। Nobody knew I existed. অথবা আপনারা জানতেন যে আমি বেঁচে আছি আপনাদের পায়ের নিচে কিংবা ঘামের প্রাবল্যে চাপা পড়ে যাওয়ার জন্যই। আপনারা জানতেন আপনাদের ডাস্টবিন কিংবা শৌচালয় আমি যা সুলভ। আমাকে কানা বানিয়ে পদ্মলোচন নাম দিয়ে নিজেরাই ফ্যাক্ফ্যাক্ হেসেছিলেন আপনারা, আমাকে করে নিয়েছিলেন ভাঁড়-জোকার। যদি আমি ভালোবাসতাম কিংবা কাউকে কিচ্ছু না করে গাছে জল দিতাম, আপনারা ফ্যাক্ফ্যাক্ করেই মুড়িয়ে নিতেন সেই গাছ, সমূলে উৎপাটিত করতেন আমার ভালোবাসা, যেমন করে এসেছেন হাজার বছর ধরে। আপনারা ভাবেননি আমার কথা, তাই আমি খুনি হয়েছি আর যেই না খুনি হয়েছি, আপনারা জানতে শুরু করেছেন যে আমি আছি আছি আছি। আমি বেঁচে আছি, টিকে আছি। আপনারা আমায় খুনি বানিয়েছেন। প্রজাপতির ডানা ছিঁড়ে দিলে বাহবা দিয়েছেন এই ভেবে যে, কতজনই বা পারে করতে এমন অসাধ্য সাধন! আপনারা ভেবেছেন আমি কতটা হিংস্র হতে পারছি তা নিয়ে কারণ সেটাকেই টিকে থাকার প্রমাণ বানিয়েছেন আপনারা। আপনারা ভেবেছেন আমি কতটা অমানুষ হতে পারছি তা নিয়ে। আপনাদের কোটি কোটি যৌনাঙ্গের থেকে কত সুদক্ষ ও পেশাদার হস্তমৈথুনে বের করে আনতে পারছি রক্ত। আমি যতক্ষণ নেচে যেতে পারছি আপনাদের তালে তালে, যতক্ষণ গিলে যেতে পারছি উচ্ছ্বিষ্ট ও মিথ্যা, যতবার কামড়ে দিতে পারছি মানুষ কিংবা মাংস, ততক্ষণ সব ঠিকঠাক, একশোয় একশো। কারণ you all don’t care. You are just like everyone. You want sensationalism. Look around, নিজেদের দেখুন, দেখুন এই জনপিণ্ডকে, look at all these people, everyone outside, who do you think they see? তারা দেখতে চায় এক খুনি ভাঁড়কে, জোকারকে, যা তাদের দেবে পেট কুঁচকে দেওয়া আমোদ আর রক্ত। আপনারা মেপে নিতে চেয়েছেন আমার সৌজন্যবোধ, বড়দের প্রণাম, ছোটদের ভালোবাসা আছে কি না। আপনার চেয়ারম্যানই আমার চেয়ারম্যান কি না। আপনার জাস্টিসই আমার জাস্টিস কি না। আপনার নির্লজ্জতাই আমার নির্লজ্জতা কি না কিংবা আপনার রাম-শ্যামই আমার বন্ধু কি না। আপনি যা বলেন বা মনে করেন আমিও তাই মনে করি কি না। না। করি না। আমি আমার মা-কে খুন করেছি, কিন্তু আজ বুক বাজিয়ে স্বীকার করে নিতে চাই, সে খুন আমিই করেছি, অন্য কেউ অন্য কোথাও অন্য কোনও চরিত্র হয়ে করেনি। আমি ছাড়া কোথাও কোনও ভাঁড় ছিল না, ছিল না কোনও জোকার। আমিই জোকার– the joker is me আর আজ থেকে নেই কোনও জোকার, কারণ আমি অস্বীকার করছি আপনাদের আমোদ আর রক্ত উপহার দিতে। I can’t be what you want me to be. I just want to blow it all up. আমি থেমে যেতে চাই। আমি ক্লান্ত হয়ে ফুরিয়ে গেছি। আমার শরীর ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, আমার চোখের নীচে গভীর গভীর কালি! এ মুখে লাল-নীল রং মাখলেও এ মুখ হয় না জোকার, থেকে যায় মানুষের মতোই। ভাঙাচোরা। আবহমান। আমি থেমে গেছি। আমি ক্লান্ত। কিন্তু আমার ক্লান্তিই আমাকে মানুষ করে দিচ্ছে কারণ আমার ক্লান্তিই আমায় ঘুম পাড়াচ্ছে। আমার ক্লান্তি আমাকে কোলে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে আর চাঁদকে ডেকে বলছে টিপ দিয়ে দিয়ে যেতে। আমার ক্লান্তি আমার কাঁধে হাত রেখে বলছে আমার চোখটা এত লাল কেন। এসো ক্লান্তি। অপার ক্লান্তি। আমি মনে করতে চাই আমার জন্ম। সমস্ত বিস্ফোরণ আর হনন পেরিয়ে আমার মানুষজন্ম। আমাদের মানুষজন্ম।
আমাদের নিয়ে কথা উঠতে খেয়াল হল, আশপাশে কোনও ? আমাদের আর নেই। কিছু দিন ও রাত পড়ে থাকার মতো শুধু রয়ে গেছে আমি নিজে আর আয়নার নিজে। রাত হয়ে গেল কি অনেক? কখন যে সব্বাই চলে গেছে, চলে গেছে সমস্ত দর্শক, অন্য কোথাও অন্য কোনও গ্রহে, খেয়াল পড়েনি। অথবা খেয়াল ছিলই, শুধু সকলের চলে যাওয়া আর ছেড়ে যাওয়া নিয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে আলাদা করে আর ধরা পড়েনি চেতনায়-আয়নায়। গোল খেতে খেতে খেতে খেতে জাল ছিঁড়ে সামনে শুধুই শূন্য ধ্বংস প্রান্তর দেখা যায়। ডানপাশে ধস আর বাঁয়ে গিরিখাত। পিছনে তাকিয়ে দেখা যায় আরেকজন! স্তব্ধতা এক। স্তব্ধতা দুই। স্তব্ধতা তিন। স্তব্ধতা অগুনতি। সাময়িক স্তব্ধতা কাটিয়ে চিৎকার করে কান্না ডুকরে ওঠে– Can we have a cigarette?
একটাই সিগারেট খেতে খেতে দু’জন দু’জনকে চেপে আঁকড়ে জাপটে আকণ্ঠ জড়িয়ে থাকে। সর্বাঙ্গে ছাই-fleck, তাই আলাদা করে সিগারেটের ছাই বোঝা যায় না। অন্ধ আলিঙ্গন শেষ হলে দু’জনেই খেয়াল করল একটা লাল ছোপ সিগারেটের সাদা কাগজে জ্বলজ্বল করছে। দু’জনেই অন্যের ঠোঁটের কোণ দেখে এবং ছুঁয়ে আবিষ্কার করল ভোটের কালির মতো একটুখানি রক্ত। দু’জনেই ভাবল something is wrong in the state of mind. দু’জনেরই ঠোঁটের কোণে রক্ত ছাড়াও জেগে উঠল হাসি। দু’জনেই বলল– আইলাভিউ! বিস্ফোরণ।
শপিংমলের ভেতর যে সিনেমা দেখার জায়গাটা ছিল, সেটায় বিস্ফোরণ হয়েছে ঘণ্টা পাঁচেক আগে। শপিংমলের কিছু হয়নি। ইতিউতি আগুন জ্বলছে এখনও, ছাই রঙে ভরে গেছে পৃথিবী। হতাহতের খবর নেই কারণ সিনেমার দর্শক ছিল না। ছিল না কোনও কর্মচারীও, কারণ সিনেমার দর্শক ছিল না। সরকার বা প্রশাসন কেউ কোনও অ্যাকশন নেয়নি কারণ সিনেমার দর্শক ছিল না। সিনেমাহলটা গলে ফেটে ভেঙেচুরে শপিংমল থেকে বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যস্ত রাস্তায়। মিনিট দুয়েক যানজট হয়েছিল, তারপর সব ঠিক হয়ে গেছে, কারণ রাস্তার এখন অনেক অপশন। সিনেমাহলের ধ্বংসস্তূপটাকে ঘিরে অনেক পাহাড়, জঙ্গল, নদী ও ফ্লেক্স দেখা যাচ্ছে। শহরে সৌন্দর্যায়নের জন্য বানানো হয়েছিল। তার মধ্যে একটা পাহাড়ের ফ্লেক্স ছিঁড়ে আর ধ্বংস মাড়িয়ে এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসছেন। চোখ বাঁধা কালো কাপড়ে। একহাতে তরবারি, অন্য হাতে দাঁড়িপাল্লা। শতচ্ছিন্ন প্রোজেকশন রুমের কাছে এসে খুললেন চোখের কালো কাপড়। দিন না রাত– বোঝা যায় না ওটা চোখে পরে থাকলে। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। ভদ্রমহিলা ক্লান্তি নিয়েই বললেন– বলো, যাহা বলিবে সত্য বলিবে, সত্য বই মিথ্যা বলিবে না। ওরা বলল। ভদ্রমহিলা ওদের নাম জিজ্ঞাসা করলেন। একজন বলল– অ। আরেকজন বলল– আ। পুরো নাম জানতে চাইলে ওরা বলল– অন্ধকার, আলো। তারপর দাঁড়িপাল্লায় দু’জনকে তুলে মাপলেন ক্লান্ত ভদ্রমহিলা। দেখা গেল, দু’দিকই সমান সমান হচ্ছে। ভদ্রমহিলা হেসে উঠলেন। যে হাসি ঠিক নয়, যে হাসি নিয়ন্ত্রণহীন। হাসতে হাসতেই বললেন, তোমাদের মধ্যে কোনও একজনকে জেতানো গেল না। জেতানো গেল না কারণ চোখে কাপড় নেই। কাপড় থাকলেই পারতাম ঘটাতে অনাসৃষ্টি। কিন্তু আমারও তো ক্লান্ত লাগে! কতক্ষণই বা চোখ আটকে থাকব। আপাতত এই। We get what we fucking deserve. হঠাৎ হাতের তরবারিটা নিজের হাসতে থাকা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে চিড়ে দিলেন ক্লান্ত ভদ্রমহিলা। এদিক থেকে ওদিক। অন্ধকার আর আলো ছুটে এল কিন্তু গলা-মুখ কেটে গেলেও ভদ্রমহিলার হাসি থামল না। ওরা দু’জনও হেসে ফেলল, নিয়ন্ত্রণহীন। হাসতে হাসতেই অ আর আ চিৎকার করল– knock knock! কোনও উত্তর পাওয়া গেল না, কারণ কোত্থাও কেউ নেই।
ঋণ:
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর চক্রবর্তী, উইলিয়াম শেক্সপিয়র, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, লতা মঙ্গেশকর, তারাপদ রায়, জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জয় গোস্বামী, পূর্ণেন্দু পত্রী, কবীর সুমন, হাসান রোবায়েত, অন্নদাশংকর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, শঙ্খ ঘোষ, টড ফিলিপ্স, হোয়াকিন ফিনিক্স, লেডি গাগা ও জোকার: ফোলি আ দ্যু চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকের কাছে