‘বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়’ শীর্ষক কার্টুনে দেখা মেলে এক বেঁটেখাটো ব্যক্তির। তিনি একখানি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক কিনেছেন নিলাম ঘর থেকে। ফিরতি পথে হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি! ভদ্রলোকের মাথায় অভিনব বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি সটান সেঁধিয়ে গেলেন ঘড়ির মধ্যে। তারপর বাকি পথটা একটুও না ভিজে এগিয়ে চললেন। ঈষৎ অবাস্তবধর্মী হলেও এ ছবির দক্ষ ড্রয়িং এবং রসিকতার ধাঁচ ছোটদের সহজেই আনন্দ দেয়। ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ নামের কার্টুনটি আরওই মনোরম। হেঁটো ধুতি পরা এক দরিদ্র ব্যক্তি হাতেপিঠে বিজ্ঞাপনের ব্যানার নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, তাতে লেখা: ‘ঘেঁটুর সার্কাস দেখুন’। পথচলতি একটি কিশোর সেই বিজ্ঞাপন দেখে উৎসাহিত। কিন্তু আবারও সেই এক গেরো। বৃষ্টি! ছেলেটি চৌকশ, পট করে সামনের লোকটির পিঠে ঝোলা ব্যানার নিজের মাথার উপর তুলে সে বৃষ্টির জল আটকাল। গোটা ছবিটির মধ্যে সিচুয়েশনাল কমেডির বিলিতি মেজাজ থাকলেও, আবহটা নিখাদ ‘বাঙালি’।
বর্তমানে জীবনযুদ্ধে রীতিমতো পর্যুদস্ত হলেও, আমুদে বাঙালি তার রসবোধের টিমটিমে প্রদীপটি এখনও আগলে রেখেছে প্রাণপণে। দরকার শুধু একটা উপলক্ষ। ব্যস। পালাপার্বণ, দোল, দুর্গোৎসব, নির্বাচন বা নীড়-বাছন, সাহিত্য, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি যাই হোক, বাঙালির উদ্যাপন ও রসিকতা অবিচ্ছেদ্য। বিশ্ব উষ্ণায়নের ষড়যন্ত্রে বাংলার ঋতুচক্রের বিভাগ স্পষ্টতই খানিক বেসামাল। গ্রীষ্মের লম্বা ইনিংস পেরিয়ে তবুও ‘বর্ষা আসে বসন্ত’। আর সেই পথ চাওয়াতেই কর্মব্যস্ত বাঙালির আনন্দ। তবে কিনা আহ্লাদের মধ্যে ভোগান্তিরও রসদ থাকে। তারাপদ রায় একদা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির সারাবছরই সিজন চেঞ্জ, সারাবছরই হাঁচি কাশি।’ এইসবের খতিয়ানও নেহাত কম জরুরি নয়। বৌদ্ধিক রসে জারিয়ে এইসব ঘটমান বর্তমানকে রেখায়, লেখায় ধরে রাখার কাজটিতেও বঙ্গজদের প্রবল উৎসাহ! ফলস্বরূপ গত ১৫০ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে বাংলা কার্টুনের জয়যাত্রা অব্যাহত। কার্টুনের মজা হল এই যে, খানিক অতিরঞ্জিত ছবি বা ছবির সঙ্গে কিছু সংলাপ, কিছু কথা সামগ্রিকভাবে এক অন্য সত্যকে তুলে ধরে। বুদ্ধির ঝিলিক আর ঈষৎ রঙ্গব্যঙ্গের মিশেলে ছবি যেন বলে ওঠে একশো কথা! কখনও দৈনন্দিন জীবনচিত্র, কখনও রাজনৈতিক চাপানউতোর, আবার কখনও বা নিছক রসিকতা। সমাজ, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার ‘সরস পাঠ’: ‘কার্টুন’ নামক এই শিল্পে বৃষ্টি ঝরেছে বহুবার। কাজেই স্মৃতি শুকিয়ে যাওয়ার জো নেই। বরং হে পাঠক, আসুন, ছাতা মাথায় দিয়ে এই সুযোগে সরস কিছু বৃষ্টি-চিত্রের ঝাঁকিদর্শন হয়ে যাক।
বৃষ্টি বলতেই বাঙালি একসঙ্গে অনেক কিছু বোঝে। ঝড়জল, পথঘাট থইথই, থকথকে কাদা, ছাতা-বর্ষাতি-গামবুটের ত্রহ্যস্পর্শ ছাড়াও বিস্তর ইনডোর সিকোয়েন্স। শুকোতে দেওয়া কাপড়-জামা ভিজে সপসপে, অসাবধানে রাখা বইপত্র ও জল শুষে নেওয়া দেওয়ালে ফুটে ওঠা প্যাটার্ন, সোঁদা গন্ধ, প্রবল ঝড়ে লোডশেডিং, বাচ্চাদের টালুমালু পায়ে ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভিজতে চাওয়া, এরই মধ্যে ইলিশমাছের আগমন এবং অকুতোভয় বাঙালির থলি হাতে বাজার অভিযান। এমন হরেক কিসিমের দৃশ্য, বর্ণময় যোগসাজশে বর্ষাকালে ঘটনার ঘনঘটা। ছবির অভাব নেই। ১৮৭৩-’৭৪ সালেও ছিল না। তার প্রমাণ মেলে প্রথম বাংলা কার্টুন পত্রিকা ‘হরবোলা ভাঁড়’ এবং ‘বসন্তক’-এর পাতায়। ভরা বর্ষায় রাস্তায় জল জমে ফিটন গাড়ি নট নড়নচড়ন। বিপত্তির একশেষ! পরিস্থিতি সামাল দিতে কোচোয়ান নিজেই জলে নেমেছে ছাতা দিয়ে জল সরাতে। ছবির ক্যাপশন: ড্রেনেজ হওয়াতে ছাতার নূতন ব্যবহার। এ ছবির ঈষৎ অবিন্যস্ত ভাঙা স্ট্রোকে বিদেশি ধাঁচ ছেড়ে স্বতন্ত্র শৈলীর খোঁজ চোখে পড়ে। যদিও ‘বসন্তক’-এ প্রকাশিত ছবিতে শিল্পীর কোনও স্বাক্ষর বা নামোল্লেখ থাকত না। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানি মুদ্রিত বাংলার প্রথম সচিত্র বই: কবি ভারতচন্দ্র রচিত ‘অন্নদামঙ্গল’-এর খোদাইচিত্রের সঙ্গে এই কার্টুনগুলির অবয়বগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী সময়ে গবেষকরা বিভিন্ন সূত্র খুঁজে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে বসন্তক-এর কার্টুনচিত্রীরা ছিলেন যথাক্রমে প্রাণনাথ দত্ত, গিরীন্দ্রনাথ দত্ত এবং গোপালচন্দ্র দত্ত। এই কার্টুনগুলি উনিশ শতকের ‘কলকাত্তাইয়া’ জীবনযাত্রার এক প্রামাণ্য দলিল।
পরাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী হিসেবে কলকাতা বহুদিন পর্যন্ত ছিল গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে। স্বাধীনতা সংগ্রামের জোয়ার এল অচিরেই। তার ফলে সংবাদপত্রের কার্টুনে সমাজব্যবস্থার গোলমেলে দিকগুলিই প্রাধান্য পেল বেশি। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিরূপ বজ্র’ (১৯১৭) বা ‘অদ্ভুত লোক’ (১৯১৭) নামক কার্টুন-সংকলন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতা লাভ এবং দেশভাগের জ্বলন্ত সমস্যা সাময়িকভাবে থিতু হওয়া পর্যন্ত বাংলা কার্টুনের তেমন ফুরসত মেলেনি রাজনৈতিক পরিসর ছেড়ে নিছক ঋতু বৈচিত্রের নানা সরস বর্ণনার ছবি ফুটিয়ে তোলার। সে অবকাশ মিলল আরও পরে। ততদিনে নানা টানাপোড়েনে বাঙালি ঈষৎ হতোদ্যম। কিন্তু রসবোধের কমতি নেই। বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করতে দেওয়ালে কারা যেন শ্লোগান লিখে গিয়েছে: ‘বাঙালি গর্জে ওঠো!’ পরদিন দেখা গেল সেই বাণীর নিচে ইটের টুকরো দিয়ে কেউ একজন লিখে গেছে: ‘হালুম।’
বুঝতে অসুবিধে হয় না, যে-অমোঘ আশা নিয়ে বাঙালি ২০০ বছরের ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছিল, স্বাধীনতার পরের কয়েক দশকে রাজনৈতিক নেতামন্ত্রীদের প্রতি অনাস্থা-বৃদ্ধি এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যাশা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছিল তার। ফলে কার্টুন তার চিরাচরিত রাজনৈতিক পরিসর নিয়ে মজে থাকলেও সেভাবে আর প্রকৃতিবিমুখ থাকতে পারল না। বিপণনের খোলা ময়দান আর শিশুসাহিত্যের জোয়ারে ভেসে রঙ্গচিত্র পেল নতুন অক্সিজেন।
শঙ্কর’স উইকলি (১৯৪৮-’৭৫) কাগজটির পরিচয় আলাদা করে দিতে হয়না। রসিক পাঠকমাত্রই জানেন এঁর গুরুত্ব। ১৯৪৮-এ প্রখ্যাত রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট কেশব শঙ্কর পিল্লাই শুরু করেন এই তীর্যক কার্টুনের পত্রিকা। আর.কে. লক্ষণ, রাজেন্দর পুরী, কুট্টি, বালাসাহেব থ্যাকারে, যেশুদাসন প্রমুখ দিকপাল কার্টুনিস্টদের সঙ্গে সে কাগজে ছবি আঁকতেন অমল চক্রবর্তী। বাংলার কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তী এই সেদিন অবধি কার্টুন উপহার দিয়েছেন ‘অমল আলোয়’ শিরোনামে। ১৯৫৪ সালে শঙ্কর’স উইকলির পাতায় শিল্পী একটি অভিনব ছবি আঁকেন। এক ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ছাতা মাথায় চলেছেন, ঝড় আসায় ছাতা গিয়েছে উল্টে, ফের ঝড়ের অভিমুখে ছাতা বাগিয়ে ধরায় শেষমেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। ২০২১ সালে ‘অমল আলোয়’ ঝলসে ওঠে আরেক রঙ্গচিত্র। বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে মন্ত্রীদের হেলিকপ্টার ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। ত্রাণ সরবরাহের বদলে পর্যবেক্ষণেই সময় ব্যয় হচ্ছে দেখে জলে ডোবা অঞ্চলে কারা যেন ভাসিয়েছে স্লোগান লেখা ফেস্টুন: দেখলে হবে, খরচা আছে। কার্টুনচিত্রী যেন নিমেষে রসিকতা ছেড়ে বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ! এখানেই কার্টুনের জয়। শিল্পীর বয়স তখন মাত্র ৮৭।
গত শতাব্দীর ছয়ের এবং সাতের দশক জুড়ে দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশিত বিভিন্ন পূজাবার্ষিকীতে লেখার শেষে কার্টুন স্ট্রিপ বা পাদপূরণের ব্যবহার লক্ষ করা গিয়েছিল। দু’টি বা তিনটি বর্গক্ষেত্রে বিন্যস্ত কার্টুনচিত্রে নির্মল মজাই হত প্রধান উপজীব্য। অলকানন্দা (১৩৬৯), শ্যামলী (১৩৭০), উত্তরায়ণ (১৩৭১), নীহারিকা (১৩৭২) প্রভৃতি পুজােসংখ্যায় স্ট্রিপ-কার্টুন যিনি সর্বাধিক এঁকেছিলেন, তিনি নারায়ণ দেবনাথ। বাংলা কমিকসের কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্মশতবর্ষ এ বছর। বৃষ্টি নিয়ে বেশ কয়েকটি মজার কার্টুন তিনি এঁকেছিলেন। ‘বুদ্ধি থাকলে উপায় হয়’ শীর্ষক কার্টুনে দেখা মেলে এক বেঁটেখাটো ব্যক্তির। তিনি একখানি গ্র্যান্ডফাদার ক্লক কিনেছেন নিলাম ঘর থেকে। ফিরতি পথে হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি! ভদ্রলোকের মাথায় অভিনব বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি সটান সেঁধিয়ে গেলেন ঘড়ির মধ্যে। তারপর বাকি পথটা একটুও না ভিজে এগিয়ে চললেন। ঈষৎ অবাস্তবধর্মী হলেও এ ছবির দক্ষ ড্রয়িং এবং রসিকতার ধাঁচ ছোটদের সহজেই আনন্দ দেয়। ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ নামের কার্টুনটি আরওই মনোরম। হেঁটো ধুতি পরা এক দরিদ্র ব্যক্তি হাতেপিঠে বিজ্ঞাপনের ব্যানার নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, তাতে লেখা: ‘ঘেঁটুর সার্কাস দেখুন’। পথচলতি একটি কিশোর সেই বিজ্ঞাপন দেখে উৎসাহিত। কিন্তু আবারও সেই এক গেরো। বৃষ্টি! ছেলেটি চৌকশ, পট করে সামনের লোকটির পিঠে ঝোলা ব্যানার নিজের মাথার উপর তুলে সে বৃষ্টির জল আটকাল। গোটা ছবিটির মধ্যে সিচুয়েশনাল কমেডির বিলিতি মেজাজ থাকলেও, আবহটা নিখাদ ‘বাঙালি’। পোশাক, পরিচ্ছদ, মায় সার্কাসের নাম সর্বত্রই বাঙালিত্ব বিদ্যমান।
আরেকটি অতি পরিচিত আইডিয়ার দুর্দান্ত বঙ্গীকরণ চোখে পড়ে ‘ম্যাজিক ছাতা’ নামের কার্টুনে। প্রৌঢ় ব্যক্তির চেহারা দেখে নন্টে-ফন্টের বোর্ডিংয়ের সুপারিনটেনডেন্ট স্যরের কথা মনে পড়াবেই। তা এই ভদ্রলোক ছাতা মাথায় মনের আনন্দে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুখে তৃপ্তির হাসি। হঠাৎ বৃষ্টি। ছাতার সব রং গায়েব, ওদিকে সেই রঙের কল্যাণে ভদ্রলোক একেবারে কুচকুচে কালো। জোরালো আঁকা, আর সহজবোধ্য বিষয়ের জন্য শিশু-কিশোর পড়ুয়ারা এসব ছবিকে যেমন ভালোবেসেছে, তেমনই তাদের মনে শিল্পীর ‘না’ স্বাক্ষরটিও চিরকালীন হয়ে গিয়েছে। হাঁদা-ভোঁদাকে নিয়েও একটি বৃষ্টি ধোওয়া দিনের গল্প এক পাতার কমিকসে এঁকেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ ১৯৬৪ সালে, শুকতারার পাতায়।
কার্টুনিস্ট হিসেবে নরেন রায় নামটি যত না পরিচিত, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিচিত তাঁর ‘সুফি’ ছদ্মনাম। ‘শঙ্কর’স উইকলি’, ‘সচিত্র ভারত’, ‘অচলপত্র’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘সন্দেশ’, ‘কিশোর ভারতী’-সহ নানা পত্রিকায় তাঁর কার্টুন ও কমিকস ছড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টি নিয়ে বিদ্রুপাত্মক এবং রাজনৈতিক কার্টুনে তাঁর ছিল রীতিমতো প্রসিদ্ধি। বৃষ্টির অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে। ১৯৯৫-এর ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত কার্টুনে দেখা মেলে এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোকের যিনি তাঁর ছেলেকে পিঠে নিয়ে রণ-পা চড়ে জল থইথই রাস্তা পেরিয়ে চলেছেন। গন্তব্য সম্ভবত ছেলের স্কুল। নেপথ্যে দু’টি গাড়ি জলে আধডোবা হয়ে রয়েছে। কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা-জনিত সমস্যার ছবিটি এখানে সুন্দর ফুটে উঠেছে। বন্যাত্রাণ পৌঁছতে গিয়ে আর্ত মানুষদের উদ্দেশে কর্তারা বলছেন যে তাঁরা আবারও পর্যবেক্ষক দল পাঠাবেন শিগগিরই। এমন শ্লেষাত্মক কার্টুনও পরম যত্নে, সরল রেখায় আঁকার ব্যাপারে সুফি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
২০০৫-এ ফের সন্দেশের পাতায় পুনর্মুদ্রিত কার্টুনে কলকাতার মানুষের দৈনন্দিন রাস্তাঘাটের ভোগান্তিকে ধরেছেন চারটি অব্যর্থ প্যানেলে। শিরোনাম: কলকাতার অলিম্পিক। ট্যাক্সি ধরতে জনতার দুশো মিটার দৌড়, রাস্তায় খানাখন্দ এড়াতে লং জাম্প, বিক্রেতার ভিড়ে ফুটপাত বোঝাই , অগত্যা হার্ডল রেস। আর জলমগ্ন কলকাতায় যানবাহনের ভরসায় না থেকে সাঁতার দেওয়াই যে দস্তুর এমন একটি সরস ছবি দিয়ে ইতি টেনেছেন সুফি।
কলকাতার রাস্তায় গর্ত নিয়ে তাঁর আরেকটি কার্টুনে দেখা যায় কর্তাব্যক্তিরা আলোচনা করছেন, গর্ত না বুজিয়ে সেই জমা জলে মাছ চাষ করা যায় কি না। তেমনি গামবুট ও ছাতা নিয়ে বৃষ্টিতে বেরনো ভদ্রলোক যে আদতে একজন দক্ষ মৎস্যশিকারী তা আমরা টের পাই তিনি গামবুট হাতড়ে মাছ পাওয়ার পর।
কাফি খাঁ বা পিসিএলের পরেই যদি সেই ধারার কার্টুনিস্টের খোঁজ যদি করা হয়, তাহলে চণ্ডী লাহিড়ী ব্যতীত আর কারও নাম মনে আসে না। সন্দেশের পাতায় ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে ‘বন্ধুর নাম ছাতা’ শিরোনামে চার প্যানেলের স্ট্রিপ কার্টুন আঁকেন তিনি। বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গত থাকলে এবং সেই অনুযায়ী ছাতাকে মেলে ধরতে পারলে এক ব্যক্তি যে নিখরচায় স্থানান্তরে পৌঁছে যেতে পারেন, তার হদিশ মেশে এই রঙিন কার্টুনে।
বাংলা কার্টুন নিয়ে কথা হচ্ছে, অথচ আট থেকে আশি সব্বার প্রিয় শিল্পী দেবাশীষ দেবের কথা উঠবে না, তা কি হতে পারে? নানাবিধ সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে বৃষ্টি নিয়েও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অসংখ্য ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন তিনি। সেগুলির মধ্যে ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজের জন্য করা নানা স্তরের বাঙালির ‘বৃষ্টি-প্রতিক্রিয়া’ সম্বলিত একটি কার্টুন এক কথায় অনবদ্য। এক উচ্চপদস্থ অফিস-কর্মী এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে, পকেটে টাই গোঁজা অবস্থায় ব্রিফকেসটি আলগোছে ঝুলিয়ে অফিসে ফোন করে জানাচ্ছেন: ‘মিটিংটা ক্যানসেল কোরো না, আমি আসছি।’ অন্যদিকে এক হতভাগ্য স্বামী তাঁর গৃহিনীকে অফিসে পৌঁছতে প্রায় পুরো রাস্তাই জলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ঠেলেছেন। পৌরসভার তরফ থেকে এক ভদ্রলোক জানাচ্ছেন যে ২০০৮ সালে আর রাস্তায় জল জমবে না। অন্যদিকে বৃষ্টিতে ভিজে কাবু এক ভদ্রলোক ফুটবাথ আর ওষুধের সঙ্গে বাড়ির মধ্যেও মাফলার জড়িয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছেন। টিভির ফোরকাস্ট শুনে তিনি বেজায় মনমরা। আরো ৪৮ ঘন্টা বৃষ্টি হলে যে কেলেঙ্কারি! অন্যদিকে একদল জেন-ওয়াই বাঙালি বর্ষাফূর্তি উৎসবে মেতে। কেউ বৃষ্টি মাথায় করে সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে, কেউ বা ইলিশ উৎসবে খাদ্যদ্রব্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করছেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুখী বোধহয় লাল টি-শার্ট আর চশমা পরিহিত মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। যিনি ইলিশ মাছ সহযোগে দুপুরের ভোজ খেতে খেতে জানলা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি উপভোগ করছেন। এতরকম লোক, এতরকম চরিত্রের পরিচ্ছন্ন লাইন ড্রয়িং ও জলরঙের প্রলেপ মাখানো ঝলমলে সহাবস্থান; তাও আবার কিনা বৃষ্টিযোগে! এ একমাত্র দেবাশীষ দেবের পক্ষেই সম্ভব। শিল্পীর স্বাক্ষরের শেষে বিস্ময়বোধক চিহ্নের দিকে তাকিয়ে সত্যিই যেন এর মানে খুঁজে পাওয়া যায়।
বর্তমান সময়ের খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট উদয় দেবও এ পরিসরে ভীষণরকম উপস্থিত। ২০১৩ সালে বিহারের সেন্দুয়ার গ্রামে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। লাগাতার বৃষ্টির পরে গ্রামবাসীরা হঠাৎ খেয়াল করেন পাহাড়চূড়ার খননক্ষেত্র থেকে গড়িয়ে আসছে বর্ষার জল। আর সেই ঝরনায় পাত্র ডুবিয়ে সোনা আর দামী রত্নের গুঁড়ো ছাঁকছেন গ্রামের মানুষজন! উদয় দেবের জোরালো স্টাইলাইজড ড্রয়িং-এ দেখা যায় এক দেহাতি মানুষ দেদার ফুর্তিতে ছাতা উল্টো করে তাতেই বৃষ্টির মধ্যে সোনা ছাঁকছেন! টাইমস্ অব ইন্ডিয়ার পাতায় ২০১৩ সালে প্রকাশিত এই কার্টুনটি সত্যিই অভিনবত্বের দাবিদার।
বাঙালির কালচারাল আইকন বলতে যাঁর নাম অবধারিত ভাবে মনে পড়ে, তিনি নিজেও ছিলেন একজন অসাধারণ অঙ্কনশিল্পী ও ডিজাইনার। মূলত চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হলেও সত্যজিৎ রায় আজীবন ছবি আঁকার সঙ্গে অটুট সংযোগ বজায় রেখেছিলেন। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় সেইসব অমূল্য ইলাস্ট্রেশন এবং প্রচ্ছদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি কার্টুনও এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। এক চোখে পড়ার মতো চেহারার বাঙালিবাবু এবং তাঁর বিবিধ কীর্তিকলাপ নিয়ে মোট চারটি কমিক্স আঁকেন সত্যজিৎ রায়। এর মধ্যে একটি ছিল বৃষ্টি-কেন্দ্রিক। এক রোদালো দিনে ছাতার দোকান থেকে নতুন ছাতা কিনে বাবু পথে বেরিয়েছেন। এমন সময় মেঘ, তারপর বৃষ্টি। বাবু হাওয়ার গতিবেগ বুঝে ঠিক নিজেকে বাঁচিয়ে চললেন। ভিজলেন না একটুও। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। ছ’ নম্বর এবং অন্তিম প্যানেলে আমরা দেখি বিরস বদনে বাবু এক-কোমর জলে দাঁড়িয়ে। খটখটে রোদ উঠেছে। ছাতার কোনও ভূমিকা নেই। যে তিমিরে সে তিমিরেই।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি, সত্যজিতের একেবারে প্রথমদিকে করা কাজ: কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছাতুবাবুর ছাতা’ বইয়ের প্রচ্ছদটি ছিল চমকপ্রদ। পাঠকের দিকে পিছন ফেরা সাদা কালো ছাতুবাবুর কোটে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। তিনি ছত্রপতি হয়ে এগিয়ে চলেছেন। বইয়ের হলুদ জমিতে প্রখ্যাত ওলন্দাজ শিল্পী এম.সি.এশার-এর ঘরানায় অপটিকাল আর্ট এঁকেছেন সত্যজিৎ। যেন ছাতার বৃষ্টি হচ্ছে গোটা মলাট জুড়ে।
বাঙালি বৃষ্টিকে ঠিক কেমনভাবে দেখে বা দেখতে চায়, তা বলা শক্ত। কোনও নির্দিষ্ট বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, বরং বৃষ্টি বলতে বাঙালি বোঝে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনার সমষ্টি। ঝড়জল তো আছেই, সেই সঙ্গে বৃষ্টি মানেই ‘রেইনি ডে’-র ছুটির জন্য মন হাঁকুপাঁকু, কোনওভাবে ছুটি ম্যানেজ হলেই দুপুরের ভোজে অবধারিত খিচুড়ি আর পাঁপড়ভাজা, চা-কফির কথা ছেড়েই দিলুম। বাড়ির নিরাপদ অন্দরে বসে জানলা দিয়ে বাইরের ঝমঝমে বর্ষার দিকে তাকিয়ে দার্শনিকের ভঙ্গিতে ‘বৃষ্টি ইজ রিডিং অর্থাৎ বৃষ্টি পড়িতেছে’ বলার মধ্যে যে সুখানুভূতি আছে তার সঙ্গে ঘোর বৃষ্টিতে মাঝরাস্তায়, বা আপিস-ফেরতা প্যাঁচে পড়া অবস্থার কোনও সদ্ভাব নেই। যাই হোক, বাঙালির অগতির গতি রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টির সঙ্গে সাদৃশ্য পেয়েছিলেন এক অমোঘ বার্তাবাহকের। ঘন মেঘ যেন আদতে অশোকবনে বন্দিনী সীতার কাছে খবর পৌঁছতে আসা হনুমান। ‘আকাশ কালো করে’ আসা সেই ‘সজল নবনীল মেঘ’-কে বাঙালি বেকায়দায় পড়লে আর উপভোগ করতে পারে কই? বৃষ্টি, জলকাদা, লোডশেডিং, খানাখন্দ ইত্যাদি নানাবিধ প্যাঁচে পড়ে তখন তার ‘লাগছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে!’
ওদিকে বাঙালির শিল্পবোধ, সংস্কৃতি এবং খানিক ফিচেল বুদ্ধি তো সহজে ক্ষান্ত হওয়ার নয়। বার্তা থাকুক, কিন্তু বার্তার সঙ্গত করতে যোগ্য ছবিও তো চাই! ফলে ‘যেমন ধারা কথায় শুনি’ হুবহু তা না এঁকে, বাঙালির দাবি ‘কার্টুন চাই’। আর চাই একজন দক্ষ বৃষ্টি-বিশেষজ্ঞ। এমন এক ব্যক্তি যাঁর আগাম পূর্বাভাস প্রকৃতির খেয়ালখুশির সঙ্গে মিলে যাবে হুবহু। মহামতি সুকুমার রায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে, এমন একজন বাঙালি সত্যিই ছিলেন। একবার আকাশ শুঁকেই নাকি তিনি বলে দিতে পারতেন বৃষ্টি হবে কি না। মুশকিল হল, তাঁর কোনও ঠিকানা বা ছবি (কার্টুনও) নেই। কিন্তু রঙ্গপ্রিয় বাঙালি হার মানার পাত্র নয়। বৃষ্টিপার্বণ বছর বছর আসবে, আর সেই সূত্র ধরে বাঙালি একদিন নিশ্চিত খুঁজে পাবে সীতানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হদিশ। বর্ষা-ফুর্তির মধুরেণ সমাপয়েৎ তো তিনিই!
ঋণ স্বীকার: দেবাশীষ দেব, দেবাশিস সেন
তথ্যসূত্র:
১. গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বদেব (সম্পা.), কমিক্স ও গ্রাফিক্স ১ (বুক ফার্ম)
২. ঘোষ, সমীর, অলংকরণ শিল্পের অন্যধারা (ঠিক-ঠিকানা)
৩. দেব, দেবাশীষ, আঁকায় লেখায় চার দশক (বুক ফার্ম)
৪. দেবনাথ, নারায়ণ, কমিক্স সমগ্র ১ ও ২ (লালমাটি)