কলাভবন প্রাঙ্গণে ডিজাইন বিভাগের পিছন দিকে অঙ্কিত দুর্গার মিউরালটিতে দেবীর হাতে অজস্র পদ্ম দেখা যায়। তিনি বলেছিলেন– ‘আমার এই দুর্গা কোনও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে না, বরং সে ফুল নিয়ে যুদ্ধ করছে। আমি মনে করি, কোনও একটা শক্তিকে যদি তুমি দমন করতে চাও তবে তার বিরুদ্ধ-শক্তিকেই প্রয়োগ করতে হবে’। অর্থাৎ হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা নয়, যুদ্ধের বিপরীতে আরেকটা যুদ্ধের অস্ত্র ঝনঝনা নয়, প্রেমের পথে, ভালোবাসার পথে এগোতে হবে আমাদের।
শিল্পীর চিত্রপটে সেই কবে থেকে দেবদেবীর ছবি আঁকা হয়ে আসছে। চিত্রকরদের মধ্যে কেউ পুরাণমতে প্রতিমার আকার নির্মাণ করেন, কেউ বা নিজের মতো গড়ে নিতে চান তাঁর প্রাণের ঠাকুর। অসুরদলনী দেবী দুর্গার কথাই ধরা যাক। শিল্পীর পটে কত বিচিত্ররূপে তাঁকে ফুটে উঠতে দেখি। একদিকে শক্তিরূপিণী মূর্তিতে আবির্ভূতা, অন্যদিকে তাঁর মাতৃরূপ আমাদের পরম আশ্রয়স্থল। আবার কারও কাছে তিনি আদরের কোলের মেয়েটির মতো– যার বিবাহ হয়েছে বেশ দূরে, সেই মেয়ে কি না বাপের বাড়িতে আসার সুযোগ পায় বৎসরান্তে একবার।
খেয়াল করলে, গ্রামবাংলার দুর্গোৎসব এখনও যেন কন্যার পিত্রালয়ে আগমনের আনন্দ-উৎসবের সনে একাকার হয়ে আছে। এই রেশ কেবল শিল্পীর তুলিতে নয়– জেগে ওঠে আগমনী গানের সুরে, লোকায়ত ছড়ার অক্ষরে, পটুয়ার ছবিতে, পটের গানে। সর্বত্র ভেসে ওঠে বছরশেষে কন্যাকে কাছে পাওয়ার গভীর আকুলতা। শ্রাবণের ধারা ফিকে না-হতেই গৌরীকে আনার জন্যে জননীর করুণ আবেদন আকাশে ভেসে ওঠে। দেবীর বন্দনা ঘিরে এই আনন্দবিরহের আখ্যান যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে। প্রাণের পুত্তলিকে পাওয়া আর তাকে বিদায় দেওয়ার ব্যথায় নুয়ে পড়ে কাশের বন, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ঝরা শিউলির গন্ধে। বছর পার করে মেয়েটি মাত্র ক’দিনের জন্যে কাছে এসেছে, সেই ক্ষণিক আনন্দের শেষে তাকে আবার চোখের জলে বিদায় জানাতে হবে, সেই বেদনা গাঁথা হয়ে আছে গানের সুরে। চকিতে আমাদের মনে পড়বে মধুসূদনের কবিতার আকুল আর্তি জড়ানো কয়েকটা ছত্র। নবমীর রাত্রিশেষে কন্যাকে বিদায় দিতে হবে– এমন আবেগমাখা মুহূর্তে মায়ের বুকফাটা হাহাধ্বনি–
যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে,
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরান যাবে।
উদিলে নির্দয় রবি উদয় অচলে
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে।
গিরিপত্নী মেনকার এই আকুল আর্তি নবমীর রাত্রিকে বুঝি চুরমার করে দিয়ে যায়।
কিন্তু কৈলাসের চূড়ায় কেমন সংসার পেতেছে গিরিবালা? সে একেবারে আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েটির চেয়ে কিছুমাত্র আলাদা নয়। শিবদুর্গার ঘর-গেরস্থালির আখ্যানের সঙ্গে আমাদের ছা-পোষা বাঙালি মধ্যবিত্তের নুন আনতে পান্তা ফুরনো টানাটানি সংসারের কোনও তফাত নেই। নানান লোকগাথায় তা একাধিক গপ্পোগাছা দিয়ে মোড়া। শিবসদাগরের ছড়ার সঙ্গে আমাদের পাড়ার শিবুদার সংসারের ব্লু-প্রিন্ট একই রকম। ওই যে আমাদের স্বভাব– দেবতাকে প্রিয় আর প্রিয়কে দেবতা গড়ে তোলার চিরকালীন সূত্র। কিন্তু চিত্রকরের পটে দেবীর প্রতিমা ফুটে উঠেছে কীভাবে?
একথা বললে গোড়াতে নন্দলালের ছবির কথা এসে পড়ে। দেবীপ্রতিমার অজস্র ছবি এঁকেছেন তিনি। সেখানে মহিষাসুরমর্দিনী, অসুরদলনী দুর্গার পাশাপাশি ফুটে উঠেছে দেবীর একেবারে আটপৌরে ঘরোয়া পারিবারিক মুহূর্ত। আড়ে-লাটাই পটের গড়নে আঁকা একটা ছবিতে দেখি, পোঁটলাপুটলি, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘাটে ভিড়েছে গৌরীর নৌকো। খবর পেয়ে মা মেনকা নদীর ঘাটে ছুটে এসেছেন নাতিনাতনি-সহ মেয়েকে নামিয়ে নিতে। যা একেবারে বাঙালি মা-মেয়ের স্নেহ-সোহাগের চিরকালীন ছবি। যেখানে আনন্দ আর অশ্রু কোনওটাই বাধা মানে না।
এরই পাশাপাশি নন্দলালের আঁকা শক্তিরূপিণী দুর্গার দীপ্ত প্রতিমা আমাদের চমকে দিয়ে যায়। সেখানে দেবীর মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি, অস্ত্রধারণ করা হাতের বজ্রমুষ্ঠির রেখাঙ্কন যেন মহাশক্তির আদিরূপের প্রকাশ। ভাস্কর্যের মতো দৃঢ় হয়ে উঠেছে সে দেবীপ্রতিমা, কোথাও ‘রণং দেহি’ ভঙ্গিতে তিনি এমন পোশাকে আবির্ভূতা– যেখানে তথাকথিত নারীসুলভ কমনীয়তা একেবারে অনুপস্থিত। সে ছবিতে তিনি মল্লযোদ্ধাদের মতো ঋজু ভঙ্গিতে স্থাপত্যের দৃঢ়তায় দণ্ডায়মান।
কেবল নন্দলাল নয়, তাঁর একাধিক ছাত্রের পটে আঁকা হয়েছে দেবীর প্রতিমা। এইসব শিল্পীদের মধ্যে রামকিঙ্করের আঁকা এক জোরালো ড্রয়িঙের কথা মুহূর্তে মনে পড়ে। সে যেন প্রতিমার উপরে সলমা-জড়ি-চুমকির পেলব আবরণ সরিয়ে একেবারে খড়ের কাঠামোর টান টান দৃঢ় স্তব্ধতা। তবে শিল্পী বিনোদবিহারীর পটে কখনও কোনও পৌরাণিক দেবদেবীর ছবি ফুটে ওঠেনি। তিনি সচেতনভাবে চোখ মেলেছিলেন প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিকের দিকে।
অনুজ শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনের ছবিতে দেবীর বিপুল উপস্থিতি পুনরায় লক্ষণীয়। সেসব ছবি ক্যানভাস, কাগজে, মাটির সরা, ছাপাই ছবির ধাতব পাত, পোড়ামাটি– সর্বত্র বিস্তৃত। কেবল তাই নয়, রঙিন অথবা সাদা-কালো, জলরং বা প্যাস্টেল সব রকমের আঙ্গিকে এই ছবি ছড়িয়ে আছে। আরেকটা কথা, বিষয় দেবীদুর্গা হলেও শিল্পী তাঁর নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছেন ভাবনা ও চিত্রপট। তিনি মনে করেন, মানুষের অন্তরে দেবত্ব আর পশুত্বের যে সহাবস্থান, সেখানেই অসুরদলনীর সারসত্যটি উদ্ঘাটিত। বাইরে থেকে আরোপিত নয়, শ্রেয় আর প্রেয়র দ্বন্দ্বে সত্য এবং সুন্দরের প্রতিষ্ঠার মধ্যেই দেবীর সত্যিকার আবির্ভাব।
তাঁর ছবিতে দেবী কখনও সিংহবাহিনী, কোথাও বৈষ্ণোদেবীর মতো বাঘের পিঠে আসীন। কখনও তিনি সাধারণভাবে দশভুজা, তো কোথাও অষ্টভুজা, ষষ্ঠ বা চতুর্ভুজা। আবার কখনও বা মানবীর মতো দ্বিভুজা মূর্তিতে প্রকাশমান। কোথাও তিনি অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার নিয়ে আবির্ভূতা, কোথাও ত্রিশূল ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই। তখন ওই ত্রিশূল ব্যতীত দেবী ও মানবীর মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া ভার। তবে সুব্রহ্মণ্যনের দুর্গা প্রতিমায় একটা বিশেষ দিক লক্ষ করার, সে হল প্রায় সব ছবিতে দেবীর হাতে ধরা একটি প্রস্ফুটিত পদ্ম অথবা পদ্মকলিকা। এই ফুলের কুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে তাঁর নিজস্ব ভাবনা, দেবী প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনা।
এক সাক্ষাৎকারে শিল্পীর যা বলেছেন তা স্মরণযোগ্য। কলাভবন প্রাঙ্গণে ডিজাইন বিভাগের পিছন দিকে অঙ্কিত দুর্গার মিউরালটিতে দেবীর হাতে অজস্র পদ্ম দেখা যায়। তিনি বলেছিলেন– ‘আমার এই দুর্গা কোনও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে না, বরং সে ফুল নিয়ে যুদ্ধ করছে। আমি মনে করি, কোনও একটা শক্তিকে যদি তুমি দমন করতে চাও তবে তার বিরুদ্ধ-শক্তিকেই প্রয়োগ করতে হবে’। অর্থাৎ হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা নয়, যুদ্ধের বিপরীতে আরেকটা যুদ্ধের অস্ত্র ঝনঝনা নয়, প্রেমের পথে, ভালোবাসার পথে এগোতে হবে আমাদের। এমনটা আমরা যুগে যুগে শুনে এলেও বিস্মৃত হয়েছি। সমগ্র বিশ্ব আজ পরস্পরের মধ্যে মারণখেলায় মেতেছে। কে তাদের কানে পৌঁছে দেবে ‘শান্তির ললিত বাণী’? কে তাদের সামনে মেলে ধরবে একগোছা শুভ্র ফুল? ‘প্রেম’, ‘অহিংসা’, ‘ভালোবাসা’– এইসব শব্দেরা কি তবে হারিয়ে গেল? কে দেবে উত্তর!
দুর্গাপ্রতিমার কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ এক সাঁওতালি গানের কথা মনে এল। আমরা কি ভেবে দেখেছি, জাঁকজমকের আতিশয্যে বাবুদের পুজো তাদের মনে অন্যরকম কোনও ভাবনা জাগিয়েছিল কি না? গানের শব্দগুলো যেন তেমন কিছু বলে। সে গানের সামগ্রিক অর্থ এইরকম– একদল সাঁওতাল মেয়ে বাবুদের দালানে প্রতিমা দেখতে গিয়েছে। সাবেকচালের সেই ঠাকুর দেখে তাদের মনে হচ্ছে, এখানে সকলেই নানা জমকালো শাড়িগয়না, ধারালো অস্ত্রে সুসজ্জিত। তারা সকলে মিলে এক অর্ধনগ্ন কালো মানুষকে আঘাত করছে। সুসজ্জিত দেবদেবীর মধ্যে একমাত্র অসুরকেই তাদের চেনা ঠেকছে, তাদের সম্প্রদায়ের আপন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। সাঁওতাল ভাষায় তাকে নিতান্তই ‘মাঝি’ বলে মনে বোধ হচ্ছে। তাই তাদের সমস্ত আবেগ, দরদ, সহানুভূতি গিয়ে পড়েছে ওই নিগৃহীত ‘মাঝি’র প্রতি। সাঁওতালি মেয়েদের মনে হয়েছে– এই মাঝি হয়তো নিজের অধিকার অতিক্রম করে বাবুদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। তাকিয়েছিল বাবুদের মেয়েদের দিকে। তারই শাস্তিস্বরূপ সুসজ্জিতা মেয়েরা তাকে অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত করেছে। তার দিকে বাঘ লেলিয়ে দিয়ে, সাপ লেলিয়ে দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি– বুকের মাঝখানে শূল দিয়ে বিদ্ধ করেছে। তাদের গানের ভাষা অনেকটা এইরকম– ‘ওরে মাঝি, তুই কেন বাবুদের বাড়িতে গেলি? কেন তাকালি তুই বাবুদের বিটিছেলেদের দিকে? দ্যাখ, সেজন্যে কি চরম শাস্তি হল তোর!’ গানের অক্ষরের আড়ালে হয়তো লুকিয়ে আছে– ওরে বোকা মাঝি, তোর নিজের সমাজে কি তোর কাউকে তোর মনে ধরল না? শেষে বাবুদের সুন্দরী মেয়ের দিকে চাইতে গেলি! এখন যে তার শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে! জানি না, এ গান সত্যিসত্যিই তাদের লেখা? না কি তাদের হয়ে এমনটা কেউ ভেবেছে! ‘লালপাহাড়ির দেশে যা’ লেখার মতো কোনও আধুনিক কবি। ঘটনা যাই হোক, দুর্গাপুজো উপলক্ষে আমাদের আজকের বিপুল গ্র্যাঞ্জারের পাশে ওই প্রান্তিক মানুষের এক টুকরো গানের সুর মনকে ভারি করে তোলে!
উপরে ব্যবহৃত সঙ্গে ব্যবহৃত সুব্রহ্মণ্যনের আঁকা দুর্গার কথায় ফিরে আসি। সাদা হ্যান্ডমেড কাগজে প্যাস্টেল দিয়ে আঁকা ছবিটির রচনাকাল ২০১৪। চতুর্ভুজা এই প্রতিমার হাতে ত্রিশূলের পাশাপাশি অন্য হাতে পদ্মের কলিকাটি সবিশেষ লক্ষণীয়। কাগজের সাদা ছেড়ে রাখা ছবিতে রঙের ব্যবহার খুবই সামান্য, নীল আর মভ রঙের সঙ্গে কালো রেখার ক্ষিপ্র আঁচড় ছবিকে প্রাণবান করে তুলেছে।
………………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন সুশোভন অধিকারী-র অন্যান্য লেখা
………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved