Robbar

শক্তিদা আলিঙ্গনে তৃপ্ত হতেন, অবলম্বনে নয়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 25, 2025 8:18 pm
  • Updated:November 25, 2025 8:21 pm  

পদ্য যখন লেখেন তখন তাঁর বিপরীতগামিতা দেখে অবাক হতে হয়। কী নরম ঋজু সংসারী মানুষ, যিনি নির্ভর করেন সাজানো গোছানো সংসারে– সেখানে উদাসীনতা নেই, সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যকরণ পড়াতে বসে কারক ইত্যাদির প্রকারভেদ পদ্যের সহজ সমীকরণে বুঝিয়ে দেন।

প্রচ্ছদ-ঋণ: পূর্ণেন্দু পত্রী

সৌমিত্র মিত্র

আমরা যখন থিয়েটার রোডের সরকারি ফ্ল্যাটে এলাম, ঠিক তার আগেই শক্তিদা, মীনাক্ষীদি, বাবুই, তাতারকে নিয়ে তাঁদের বেলেঘাটার পূর্বাঙ্গনাতে চলে গেলেন। এর আগে বেকবাগানের বাড়িতে আমাদের নিত্য যাতায়াত। একটু মনখারাপ তো হলই, শক্তিদার বাড়ির কাছে আসার সময়ই বাসাবদল হল।

আমার ছেলের তখন বছর পাঁচেক বয়স। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে খুব ভালোবাসতেন। আমার ছেলে তাতনের ভালো নাম রেখেছিলেন সুভাষদা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়– সৌপর্ণ। শক্তিদা ডাকতেন ‘ভোম্বল’ বলে। ভোম্বল আবার ডাকত ‘বোলবোলজেঠু’।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সৌজন্য: মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়

কত জায়গায় আমরা যে একসঙ্গে ঘুরেছি বলে শেষ করা যাবে না। এবং এই বিভিন্ন পর্যটনে শক্তিদা, বাবুই, তাতার, ভোম্বল, এমনকী বাংলোর কেয়ারটেকারদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গল্প করতেন। প্রকৃতির সঙ্গে এক বিচিত্র ভালোলাগা ছিল শক্তিদার। গাছ-ফুল সব চিনিয়ে ছোট ছোট ছড়া বলতেন, যাতে তারা মনে রাখতে পারে।

…………………..

পড়ুন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়-এর স্মৃতিচারণ: একা বিমর্ষ, অনর্গল বন্ধুরাই শক্তির বেঁচে থাকার শক্তি

…………………..

বাবুই-তাতারের কাছে শক্তিদা এক নিশ্চিন্ত মুঠি-ধরা মানুষ ছিলেন। ছিলেন নিশ্চিত আশ্রয়। যতই তাঁর বাইরের টান থাকুক না কেন, বাড়িতে তিনি ছিলেন অন্য মেজাজে।
লিখেছেন,

‘ছেলেটি ঘুমন্ত হাতে জড়িয়েছে নিষ্ঠুর পিতাকে
যিনি সদা ভ্রাম্যমাণ জঙ্গলে, জনপদে, বিজনে–’

কন্যার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সৌজন্য: মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়।

এই পদ্য যখন লেখেন তখন তাঁর বিপরীতগামিতা দেখে অবাক হতে হয়। কী নরম ঋজু সংসারী মানুষ, যিনি নির্ভর করেন সাজানো গোছানো সংসারে– সেখানে উদাসীনতা নেই, সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যকরণ পড়াতে বসে কারক ইত্যাদির প্রকারভেদ পদ্যের সহজ সমীকরণে বুঝিয়ে দেন। মনে পড়ছে কানাইনাটশাল বাংলোতে এক প্রবল বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমরা গান শুরু করলাম। বাবুই ধরল ‘রিমঝিম ঘন ঘন রে’… শক্তিদা, মুনমুন, মীনাক্ষীদি সবাই গলা মেলালেন। সেই বর্ষার গান চলতে থাকল রাতের খাবার না আসা পর্যন্ত!

৬ জানুয়ারি, তাতারের জন্মদিনে, ১৯৮৩-র এক সন্ধ্যায় আমরা অনেকেই জড়ো হয়েছি কর্ণেল বিশ্বাস রোডের বাড়িতে, সে সন্ধ্যাতেই সংবাদ এল ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ বইয়ের জন্য ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার প্রাপ্তির। সন্ধ্যাটি ঝলমল করে উঠল পুরস্কার আর জন্মদিনে।

আড্ডায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মহাদেব সাহা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ওই কানাইনাটশাল বাংলোতে শক্তিদা উপুড় হয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত ‘একা গেলো’ কাব্যনাট্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি সন্ধ্যার আয়োজন করেছিলাম অকাদেমিতে ১৯৮২-র নভেম্বর মাসে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শক্তিদার লেখা এক নতুন কাব্যনাট্য পড়বেন, অথচ শক্তিদা কিছুতেই লিখছেন না। আমরা প্রত্যেকে মিলে মীনাক্ষীদির সঙ্গে পরামর্শ করে বর্ধমানে বেড়াতে গেলাম। কানাইনাটশাল শক্তিদার প্রিয় বাংলো। নিচের বাগানে ময়ূর, হরিণ, অজস্র গাছগাছালি। সকালে জলখাবার খেয়ে শক্তিদা দরজা বন্ধ করলেন, এক ঘণ্টা পর বারন্দায় তাঁর গমগম কণ্ঠে শুনলাম,

‘গ্রহণ করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে
চুম্বন করিনি আগে ভুল হয়ে গেছে
তেমন বাসিনি ভালো ভুল হয়ে গেছে…’

এই কাব্যনাট্য সৌমিত্রদার লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিতে, আমায় বসতে বললেন। আধঘণ্টা পর আমার হাত শক্ত মুঠিতে ধরে বললেন– আমি কাল শক্তির বাড়ি যাব, তুমি বলে রেখো। সকালেই যাব। আমি এখন আর কথা বলতে পারছি না।

মীনাক্ষী ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতির ভারে আচ্ছন্ন আমি। কতদিন কত কথা কত আড্ডা কত বেহিসেবি দৌড়। তারই মধ্যে এক অবাক করা ভালোবাসা ছুঁয়ে থাকত আমাদের প্রত্যেককে! কেউ নিকটজন কেউ-বা একেবারেই অচেনা।

……………………………

পড়ুন শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে

……………………………

আলিঙ্গনে তৃপ্ত হতেন, অবলম্বনে নয়। পদ্য যখন লিখেছেন অন্য মানুষ, এলোমেলো, কিন্তু শব্দকে বন্দি করেছেন হাতের মুঠোয় ছন্দকে তালুতে বলতে পেরেছেন,

‘যা পোড়ে না– বেঁচে থাকে–
ভালোবাসি , ভালোবাসি তাকে’

…………………………

রোববার.ইন-এ পড়ুন সৌমিত্র মিত্র-র অন্যান্য লেখা

…………………………