
এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা, যেখানে সবই সম্ভব। নিয়ত যেখানে ঘটে চলেছে ছোট ছোট ইচ্ছে থেকে শুরু করে, স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও মনের সুকোমল বৃত্তিগুলির খুন। সে খুবই সামান্য ব্যাপার আজকাল। শেষ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি, যতক্ষণ না আক্ষরিক অর্থেই ঘাতক কোপটি নেমে আসে বুকে বা পিঠে। পিছতে পিছতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমরা ঘুরে দাঁড়াই, দেখি আমারই মতন ‘কেউ তবু হেঁটে যাচ্ছে শেষ পৃষ্ঠা বরাবর, একা’।
এবারের শীত যেন কেমন একটু উদাসীনভাবে এসেছে। মেলা, খেলা, অবেলার কলকাতা বিমর্ষ নরম রোদ্দুরে বেকুবের মতো শুয়ে ভাবছে এ কেমন দিন এল! এ শহরে শীতবুড়ো এসে পৌঁছেই যেন তার দস্তানাটি খুলে রেখেছেন, আর তার থেকে বেরিয়ে পড়ছে পুরোনো কবিতার বই, নকশাকাটা উলের টুপি, স্মৃতিমথিত পুরনো বন্ধুর গল্প আরও কত কী! অপ্রতুল হয়ে ওঠা ছুটির তালিকা থেকে একটি-দু’টি পেলে পুরনো প্রিয় কবিতার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ‘দস্তানা আর শীতের গল্প’ পড়তে পড়তে প্রথম ও শেষ অংশের কাছে এসে বসি। প্রথম অংশে–
শীতের রাস্তায় কারো গ্লাভস পড়ে আছে। ফুটপাথে।
ছিন্ন করতল তার, দূরে দূরে ছড়ানো আঙুল
কে এখানে কার হাত ছেড়ে চলে গিয়েছিল তবে?
আর তারপর একটি দীর্ঘ যাত্রা সম্পূর্ণ করে এসে আমরা দেখি–
দস্তানাটি হাত পায়, হাতও পায় ভুলে-যাওয়া ওম
কী নিশ্চিন্ত মুঠো পায়। গল্পে যেরকম হয়।
ভেতরে, নিঃশব্দে কিছু ঘাতক শূন্যতা বেঁচে থাকে।

কবি রাকা দাশগুপ্তের ২০১৮ সালে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত কবিতার বইটির নামকবিতা এটি। ১০টি কবিতার এই সিরিজটি বইয়ের শেষ কবিতা, কিন্তু কোথাও যেন গোটা বইটির মূল সুর বাঁধা রয়েছে এই কবিতাতেই। আমাদের প্রেম, বিচ্ছেদ, উত্থান-পতনের দিনলিপি একটি দস্তানার আত্মকথার মতো লেখা হয়ে গিয়েছে। দস্তানাটি মরে যায়, ফের দগ্ধ ফিনিক্সের মতো পুনর্জন্মের কাছে ফেরে। আবার একই সুর ধরে চলে আসা যায় বইয়ের প্রথম কবিতা ‘গুহামানবীর চিঠি’-তেও। জীবন, রাজনীতি ও ইতিহাসের চক্রবৎ পরিবর্তন তাকে টলাতে পারে না। সে লেখে–
অজস্র অজস্র মুখ। কেনা-বেচা। তারই মধ্যে কার
অসতর্ক থলি থেকে পড়ে যাচ্ছে রাশি রাশি
মোহর ও কাটা মুণ্ডু, সেই দৃশ্যে, বিস্মিত, দাঁড়াই
মুদ্রাতে রানীর মাথা, ভূতলে প্রজার।
১৪ লাইনের প্রতিটি কবিতায় সে যেন লিখে রাখছে তার বিস্ময়, বিতৃষ্ণা, শোক, ভালোবাসা এবং দ্রোহের দিনলিপি। একা গুহামধ্যে বসে সে দেখছে নিয়ত বদলে যাচ্ছে, আর আরও রক্তাক্ত, একা হচ্ছে এই বাদামী-নীল-সবুজের প্রকৃত পৃথিবী। একেই কি উন্নয়ন বলে?
এই কাব্যগ্রন্থে রাকার কবিতার ক্রাফটসম্যানশিপের থেকেও বেশি ঝলকে ওঠে এক অন্তর্মুখী জীবনবোধের চলাচল। বইটির বেশিরভাগই সিরিজ কবিতা। তার মধ্যে দীর্ঘতম ‘আভে মারিয়া’। আসলে ‘আভে মারিয়া’, যাকে আমরা মাতা মেরির প্রতি ক্যাথলিক প্রার্থনাসংগীত বলে জানি, সেটির মূল গানটি ছিল একটি ল্যাটিন প্রার্থনাগীত– যাকে পরে ইংরেজিতে অনুবাদ করে গাওয়া হত। অন্যদিকে ১৮২৫ সালে ওয়াল্টার স্কট রচিত ‘দ্য লেডি অফ দ্য লেক’ নামক একটি লিরিক-কবিতায় সুরারোপ করে একটি কম্পোজিশন তৈরি করেন ফ্রাঞ্জ শ্যুবার্ট– যার শুরু সেই ‘আভে মারিয়া’ শব্দবন্ধ দিয়ে। পরবর্তীকালে এই দুয়ে মিলেমিশে প্রার্থনা সংগীতটির বহুলপ্রচলিত রূপটি আসে। এই গৌরচন্দ্রিকাটির অবতারণা এইজন্য যে, রাকার এই সিরিজ কবিতাটিতে পরমশক্তি, তার প্রতিভূ নবী, সেই নবীর মানবিক গুণের অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব ও তার প্রতি বিশ্বাস, অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানবীর মুখ বারবার ভেসে ওঠে– যে মুখটি আসলে মাতা মেরী, মেরী ম্যাকডালিন, কুঁজি মন্থরা বা আমি, তুমি, যে কেউই হতে পারত। যে কি না আরও কোনও গভীর ভবিষ্যতে জল নয়, আগুনে দীক্ষিত হতে চায়; যে কি না নবীর ক্ষত নিজের দেহেও লক্ষ করে। কবিতাগুলির মধ্যে কোনও চটকদার পঙক্তি নেই, আছে আদ্যন্ত অভিঘাত তৈরি করা বোধ। যে বোধ জারিত হয় পাঠকের মধ্যে এই ২২টি কবিতাংশের মাধ্যমে।

এই কাব্যগ্রন্থের ‘জাতক-সিরিজ’ এবং ‘লবণাবতী’ কবিতাতে আমরা চেনা রাকা দাশগুপ্তকে পাই। সেও এক আলাদা আবহ তৈরির কাজ, কিন্তু ভেতরে গুমড়ে আছে বজ্রগর্ভ মেঘের সাঁজোয়া। সবশেষে যে তিনটি কবিতার কথা বলব, সে তিনটি আলাদাভাবে রাকার কবিতাকে চেনায়। ‘যে সীমান্তে যুদ্ধ হয়’, ‘যুদ্ধ-পরবর্তী’ এবং ‘ক্লাইম্যাক্স’ শীর্ষক কবিতাগুলি। ‘যে সীমান্তে যুদ্ধ হয়’ সিরিজটিতে ‘অন্তিম’ নামক অংশটিতে চমকে দিচ্ছেন রাকা।
ছোট একটি শোক। তাকে রাষ্ট্রীয় পতাকা মুড়ে
শেষকৃত্যে নিয়ে আসা হলো
দিকে দিকে তোপধ্বনি, বিদগ্ধ ভাষণ
এসবে সে শোক ভারী বিড়ম্বিত, মনে মনে মরে গেল আরো
আসলে শোকটি ছিল ব্যক্তিগত। নিরুদ্বিগ্ন জীবন, বাবা-মা,
লনে পা-ছড়িয়ে বসা, নীল স্কার্ট, ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে হতে
অবশেষে অন্তরীন হয়ে যাওয়া
এখন সবাই তাকে বহন করেছে কাঁধে
সমাধি পর্যন্ত তবু নিয়ে যেতে পারছে না কেউই
শোক সে হাজার মানুষের হোক আর একান্ত হোক, সে তো ব্যক্তিবিশেষের কাছে ব্যক্তিগতই। বহ্বাড়ম্বর তো তাকে এনে রাস্তায় দাঁড় করায়, কিন্তু তাকে মাটি চাপা দিতে পারে না। সে ভেসে থাকে মাথার ওপরে মেঘের মতো। আর ভাসতে ভাসতে কখনও ভারী, কখনও হালকা হয় তার শরীর, ঋতুতে ঋতুতে রূপ বদলে যায় তার। একটি শোকের মেঘ অন্য শোকের সঙ্গে মিলেমিশেও যায় কখনও কখনও, তখন আর তাকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্ব তো থেকেই যায়। আর এই একই সুর ধরে চলে যাওয়া যায় ‘যুদ্ধ-পরবর্তী’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতায়, যেখানে রাকা লিখছেন–
কাচ ঢুকে যাচ্ছে পায়ে সন্তর্পণে ঢেকে রাখছো ক্ষত
রাস্তা তো অলীক শুধু দৃশ্যাবলী বাস্তবসম্মত।
স্মৃতির মলম পড়ছে ব্যান্ডেজ শোভিত ইতিহাসে
যে অজস্র মৃতদেহ পড়ে আছে সভ্যতার ঘাসে
ধুলো জামা ঝেড়ে উঠে মিশে যাচ্ছে জনস্রোতে। প্রেত…

এই কাব্যগ্রন্থে বারবার ফিরে আসে যুদ্ধের কথা। যে যুদ্ধ, ব্যক্তি থেকে সমষ্টি সবক্ষেত্রেই ঘটে থাকে, সমান ক্ষতি করে। ধ্বংস, শূন্যতা, শোক এবং পুনর্নির্মাণের হাতছানি নিয়ে সে নেমে আসে রাজপথে এবং ব্যক্তিগত জানলায়। অতঃপর শেষে এসে যে কবিতাটির কথা বলব সেটি বইয়ের শেষ কবিতাও হতে পারত, হতে পারত– ‘ক্লাইম্যাক্স’। যেখানে রাকা বলছেন–
বন্ধু বলে কেউ নেই; সকলে সম্ভাব্য আততায়ী
পর্দা টানা সারি সারি অন্ধকার মুখ। কানা গলি।
রহস্যের আলো খুব নিচু হয়ে আসে। টর্চ হাতে
কেউ তবু হেঁটে যাচ্ছে শেষ পৃষ্ঠা বরাবর, একা।
মনে পড়ে যায় এহমদ নাদিম কাজমি-র দুটি অমোঘ পঙক্তি–
কিসকো কাতিল ম্যায় কহুঁ, কিসকো মসীহা সমঝুঁ
সব ইয়াহাঁ দোস্তহি ব্যায়ঠে হ্যাঁয়, কিসে ক্যা সমঝুঁ॥
এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা, যেখানে সবই সম্ভব। নিয়ত যেখানে ঘটে চলেছে ছোট ছোট ইচ্ছে থেকে শুরু করে, স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও মনের সুকোমল বৃত্তিগুলির খুন। সে খুবই সামান্য ব্যাপার আজকাল। শেষ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি, যতক্ষণ না আক্ষরিক অর্থেই ঘাতক কোপটি নেমে আসে বুকে বা পিঠে। পিছতে পিছতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আমরা ঘুরে দাঁড়াই, দেখি আমারই মতো ‘কেউ তবু হেঁটে যাচ্ছে শেষ পৃষ্ঠা বরাবর, একা’।
……………………..
রোববার.ইন-এ পড়ুন শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী-র অন্যান্য লেখা
……………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved