শেষ শটের পর প্রচুর হাততালি পড়ল, এইসব সময়গুলোয় সুপারস্টারেরাও মনখারাপ করে ফেলে। সেই শুটিং শেষের জমজমাট পার্টিতে মাংস রান্না হচ্ছে বহুক্ষণ ধরে। আমরা কয়েকজন ইউনিটের খাবার খাইনি, স্পেশাল আইটেম খাব বলে। শেষমেশ রান্না শেষ হল। পাতে মাংসও পড়ল। কিন্তু সে রান্না শেষ করতে গেলে রামসুক তেওয়ারির দাঁতের পাটি চাই, অভুক্ত টানামানিতে ডিনার মাথায় উঠল, শালা এত চেষ্টা করেও একটু সেদ্ধ হলি না শুয়োর কোথাকার!
২৬.
শুটিং মানে আত্মীয়তা। অচেনা সব মানুষজনের সঙ্গে মুড়ি খেতে বসে যাওয়া। এই সংজ্ঞায় ‘তিতলি’র এডি হিসেবে আমি ডিস্টিংশন পাব। কিন্তু কাজের নিরিখে লবডঙ্কা। কিছুই করিনি পাহাড় বেড়ানো ছাড়া। ফলে ফিরে আসার তাড়না প্রবল হচ্ছিল। আর একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কেন যেন মনে হচ্ছিল, ‘তারা’তে আর আমাকে জয়েন করতে দেবে না। এইসব অমূলক অনিশ্চয়তা নিয়ে ফালতু সময় বরবাদ করেছি কত! ঋতুদাকেও বলেছি! একটু ভুরু কুঁচকে ঋতুদা বলল, না দিলে না করবি! কাজের অভাব আছে না কি! কাজের অভাব হয়তো ছিল না, কিন্তু টাকাপয়সার অভাবটা নিয়ে কী করব, সে নিয়ে বিলক্ষণ মাথাব্যথা ছিল। এটা এমন একটা সময়ের কথা, যখন ‘চন্দ্রবিন্দু’র ‘চ’ ক্যাসেটের প্রস্তুতি চলছে। তখনও জানি না, ওই ক্যাসেটের আগের আর পরের জীবনে বিস্তর বদল ঘটবে বেঁচে থাকায়।
পাহাড়ের মতোই শুটিংয়ের ওয়েদারও মিনিটে-মিনিটে বদলায়। যে স্বকুঘো-র বিরুদ্ধে খারাপ খাবারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছিল একদিন, তিনিই শেষবেলায় ইলিশ খাইয়ে হিরো হয়ে গেলেন। হাইটের কারণে যে কোনও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসেরই একটু বেশি দাম ছিল লাভায়। ফলে অমন বিজনব্যাজার প্রান্তরে পাতে সর্ষে ইলিশ হাততালি কুড়োল অনেক। শিলিগুড়ি বাজার থেকে এসেছিল ওই মহার্ঘ্য ইলিশ। পাহাড়ে পা দুলিয়ে ইলিশ পেটি– এমন ফুড ফ্যান্টাসি ভাবাই যায় না। বড় বড় হাটেলের মেনুতে তো আর ইলিশ লেখা থাকে না, সেখানে জলের রুপোলি শস্যের নাম হিলসা। সেই নামের আগেও হিলপাহাড় আছে বই কি! হিল-এ হিলসা হিলিং– এমন একটা নাম দেওয়াই যেতে পারে এপিসোডটায়।
পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– এমন একটা কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল ইউনিটে। সারণ তো মিঠুনদার ব্যাপারে অনেকটাই জানে– ‘মিঠুনদার রান্নার হাত মানে ভাবতে পারছিস না।’ তখন সারণের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ফলে ‘কাঁচা ঢপ মারিস না তো’ বলার মতো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সারণ মুখ ভেটকে ‘এই হচ্ছে তোদের নিয়ে সমস্যা’ বলে ফট করে মিঠুনদাকে বলে দিল। খাওয়াদাওয়া নিয়ে সংশয় দেখালে ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি ঘটে। কী রান্না হবে ডিরেক্টোরিয়াল টিম-এর জন্য? না, পর্ক রান্না হবে। সেটাই স্পেশালিটি। নোলায় জল এসে সারাটাদিন কাটিয়েছি। মিঠুনদার প্রধান অ্যাসিস্টেন্ট হচ্ছে সারণ, শুভ কাজে সে-ই জোগানদার। এই ঘটনাটার কথা তুললে সারণ অবশ্য এখন ভয়াবহ প্রতিবাদ করে। বলে, মাংসটা আমিই রেঁধেছিলাম, মিঠুনদা নয়। ইতিহাস চিরকালই নানা দিক থেকে লেখা হয়েছে। একমাত্র মার্কসিস্ট অ্যাপ্রোচটাই ধ্রুব ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই।
এ ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে আর একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিল সারণ। যেহেতু প্রতিরাতেই চিত্রনাট্য লেখার সময় ও ফিল্মের নেশা ও রামের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত, অনেক সময়ই খেয়াল করত না কোথায় আছে। চিমনির মতো ধোঁয়া ছাড়ত, আর যেখানে সেখানে সিগারেট গুঁজত। একদিন বোধহয় ক্রিয়েটিভিটির অত্যাচারে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। কাঁচাঘুম যখন ভাঙল, দেখি ঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়া। কোথাকার তরবারি কোথায় রেখেছিল কে জানে, ঘরে গিয়েছে আগুন লেগে। বালিশ, সোয়েটার, ব্যাগপ্যাক– সব দিয়ে প্রাণপণে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে সারণ। আমিও দুমদাম লেগে পড়লাম দমকলের ভূমিকায়। চিরকালই জানতাম সারণ বন্ধুবৎসল ও বিপজ্জনক, তা বলে পুড়িয়ে মারার বন্দোবস্ত করতে পারে, কখনও ভাবিনি। লাভার গেস্ট হাউজ, হোটেলগুলো সবই কাঠ দিয়ে তৈরি– একবার ধরে গেলে যে কী লঙ্কাকাণ্ড হত কে জানে!
আগুন লাগানোর হপ্তাখানেক পরে সেই সারণ এখন মন দিয়ে মাংস রান্না করছে। শুটিং প্রায় শেষের মুখে। কিছু এক্সট্রা শট নেওয়া বাকি। ছোট একটা ইউনিট সেই কাজটা করবে। বাকিরা ফিরে যাবে বেসক্যাম্প হয়ে কলকাতায়। ফলে সত্যি ফিল্ম প্যাক আপ-এর সময়টা আমরা ছিলাম না কেউ। রাজীব কেবল থেকে গিয়েছিল। তবে লাভা যেহেতু সবচেয়ে বড় লোকেশন এই ফিল্মের, তাই শেষ শটের পর প্রচুর হাততালি পড়ল, এইসব সময়গুলোয় সুপারস্টারেরাও মনখারাপ করে ফেলে। সেই শুটিং শেষের জমজমাট পার্টিতে মাংস রান্না হচ্ছে বহুক্ষণ ধরে। আমরা কয়েকজন ইউনিটের খাবার খাইনি, স্পেশাল আইটেম খাব বলে। শেষমেশ রান্না শেষ হল। পাতে মাংসও পড়ল। কিন্তু সে রান্না শেষ করতে গেলে রামসুক তেওয়ারির দাঁতের পাটি চাই, অভুক্ত টানামানিতে ডিনার মাথায় উঠল, শালা এত চেষ্টা করেও একটু সেদ্ধ হলি না শুয়োর কোথাকার!
এবার শিলিগুড়ি ছুঁয়ে বাড়ি ফেরার পালা। পাহাড় যে কোনও মানুষকেই একটা মর্যাল উচ্চতা দেয়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় নায়ক যেমন মুখের ওপর চাকরি প্রত্যাখ্যান করেছিল। হয়তো পাহাড় বলেই পেরেছিল। রকেট বাসের লাল-সবুজ আলো আর বিকট হর্নের দাপাদাপিতে যতবার ঘুম ভাঙছিল, প্রতিবারই মনে মনে শপথ নিচ্ছিলাম, তারার চাকরিটা টুক করে ছেড়ে দেব ফিরেই।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?