আসলে বহুক্ষেত্রেই মাওবাদী বন্দিদের সমস্যাটা ঘরে-বাইরে। যাঁরা বিপ্লবের নেশায় ঘর ছাড়েন, অনেকের বাড়ির লোক সমর্থন করেন। অধিকাংশেরই উল্টো হয়। পুলিশ আসা যাওয়া, জেরার উপদ্রব জ্ঞাতিরা এসব সহ্য করতে পারে না। বিপদ জটিল চেহারা নেয়।
২৩.
দমদম জেল। মাওবাদীদের জটলা, সেল ওয়ার্ডের দালানে। পাশে বেলগাছ।
আগেরদিন সকালে মনীশ নামে এক বন্দি কোর্টে বেরনোর সময় একটা বেল পড়ল। কী কাণ্ড, মনীশ কোর্টে বেলও পেয়ে গেল। এই নিয়ে একটু হাসাহাসি।
গত চারদিন ধরে দুপুরে ভাতের সঙ্গে ওলের ঝোল চলছে। অসহ্য। অধ্যাপক সমরেশ কেস-টেবিলে গিয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছেন।
এসব কথার মধ্যেই উঠল কুসুমডিহার প্রসঙ্গ। মাস্টারমশাই অমিয় সাউ বললেন, ‘কুসুমডিহা মনে হয় আপাতত ঠিক আছে। কোনও গোলমালের খবর তো পাই না।’
কারখানার শ্রমিক নরেন বলল, ‘যে সরকার এখন ক্ষমতায় এসেছে, তারাই যদি গরিবের স্বার্থ দেখে, জোরজুলুম না করে, তাহলে তো আর আমাদের আন্দোলন করতে হয় না।’
বিরক্ত হলেন সমরেশ। এই হল সচেতনতার অভাব। আজ কী হচ্ছে, শুধু তাই দেখে বিচার করা। তিনি বললেন, “তোমাদের ভুল ধারণাটা কাটাও। এটা হল শ্রেণিসংগ্রাম। শাসক একটা শ্রেণি, আমরা আরেকটা শ্রেণি। আজকের সরকার সদিচ্ছা দেখাচ্ছে মনে হলেও সেটা রাখতে পারবে না। নতুন শোষক শ্রেণি তৈরি হয়ে যাবে। বহু মধ্যসত্ত্বভোগী সরকারের ছায়ায় গিয়ে ভিড়বে। ক’দিন পর দেখবে মুখ বদলেছে, সমস্যা বদলায়নি। এই যে কুসুমডিহা, সরকারের চাপে আপাতত সব ঠান্ডা দেখালেও বিদ্যুৎ কি বংশীলালের মৃত্যুর শোধ তুলবে না? বিদ্যুতের পোষা লোকগুলো ছোবল মারবে না? সব পুলিশ কি রাতারাতি সাধু হয়ে গেল? ওরা আছে, সাপের মতো শীতঘুমে, হঠাৎ আবার জাগবে। তাই আমাদেরও সংগঠন করতে হবে, আন্দোলনকে জিইয়ে রাখতে হবে। যখন-তখন কাজে নামার দরকার হতে পারে।”
সমরেশ অমিয়কে বললেন, ‘মাস্টারমশাই, আপনার বাড়ির সমস্যাটা কী দাঁড়াল?’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এটা হল শ্রেণিসংগ্রাম। শাসক একটা শ্রেণি, আমরা আরেকটা শ্রেণি। আজকের সরকার সদিচ্ছা দেখাচ্ছে মনে হলেও সেটা রাখতে পারবে না। নতুন শোষক শ্রেণি তৈরি হয়ে যাবে। বহু মধ্যসত্ত্বভোগী সরকারের ছায়ায় গিয়ে ভিড়বে। ক’দিন পর দেখবে মুখ বদলেছে, সমস্যা বদলায়নি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে বহুক্ষেত্রেই মাওবাদী বন্দিদের সমস্যাটা ঘরে-বাইরে। যাঁরা বিপ্লবের নেশায় ঘর ছাড়েন, অনেকের বাড়ির লোক সমর্থন করেন। অধিকাংশেরই উল্টো হয়। পুলিশ আসা যাওয়া, জেরার উপদ্রব জ্ঞাতিরা এসব সহ্য করতে পারে না। বিপদ জটিল চেহারা নেয়। এই যে মাস্টারমশাই, তিনি নিঃসন্তান। একটি মামলায় যাবজ্জীবনের রায় হয়েছে, আপিল করেছেন মকুবের। অন্য মামলায় বিচার চলছে। একে তো বন্দিজীবন, মামলার ঝামেলা। তার ওপর তাঁদের বসতবাটিতে তাঁর অংশের ঘরটা দখল করতে চাইছে ভাই। তাঁর স্ত্রীকে চরম নির্যাতন ও অপমান করে বের করে দিতে চাইছে। মহিলা যাবেন কোথায়? তাঁর ভাইয়ের পরিবার তাঁকে নিতে নারাজ। মহিলা এসে মাস্টারমশাইয়ের কাছে কাঁদেন। মাস্টারমশাই সজল চোখে শোনেন। তিনি যা বিপ্লবের মন্ত্র শিখেছিলেন, তাতে তো এই সমস্যার সমাধানের পথ লেখা ছিল না।
সমরেশকে অমিয় বললেন, ‘অবস্থা ওই একই। প্রিজনার্স পিটিশনে কোর্টকে বলেছি, যদি একটু পুলিশকে নির্দেশ দেন বিষয়টা দেখতে। তবে কোর্ট কী আর এভাবে বলবে? আমার ভাইটা কেমন পাল্টে গেল।’ এই যন্ত্রণা চেপে কথা একটু ঘুরিয়ে অমিয় বললেন, ‘আমাদের সংগঠনটাকে আবার মুঠোর মধ্যে ধরে শক্তিশালী করতে হবে। না হলে এই সমাজটার কিসসু হবে না। সর্বত্র অবক্ষয়, লোভ, সুবিধাবাদ। মামলা সামলে যদি বেরতে পারি, আবার কাজ করব দলের। ব্রহ্মার কোনও খবর পেলেন?’
সমরেশ বললেন, ‘কমরেড বিশাল আর রুদ্র নিশ্চয়ই জানবেন। আমার তো কুসুমডিহার হালচাল শুনে মনে হয় আপাতত সব চুপচাপ। পুলিশের চাপও কম। বরং উত্তরবঙ্গে চা বাগান বেল্টে আমাদের কমরেডদের কিছু মুভমেন্ট আছে বলে শুনছি। থাকলেই ভালো।’
সেপাই অরবিন্দ হেলতে দুলতে আসছিল। শিফট চেঞ্জ। ওর শুরু। লোকটা নানারকম খবর রাখে এবং সেটা রীতিমতো জাহির করে।
–‘কী স্যর? শুনলেন কিছু?’ অপরেশকে বলল অরবিন্দ। তার মানে ও শোনাতে চায়।
–‘না , সেরকম কিছু শুনিনি তো। তুমি বলো শুনি।’
–‘সে কী, আমি তো একটু আগে টিভিতে শুনলাম। জেল অফিসেও সবাই বলাবলি করছে। শঙ্করবাবুর স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছেন।’
থমকে গেলেন অপরেশ, অমিয়রা।
শঙ্কর বারিক তাঁদের সহকর্মী কমরেড। বেসরকারি কুরিয়র সংস্থায় কাজ করতেন। তারপর একাধিক মামলায় জড়িয়ে ফেরার, পুরো জঙ্গলজীবন। এই জীবনেই জঙ্গলকন্যা ছায়ার সঙ্গে আলাপ। তারপর বিয়ে। দু’জনেই সংগঠন করতেন, অ্যাকশনেও থাকতেন। ঝাড়গ্রামের জঙ্গলে তাঁদের একটা ক্যাম্পে পুলিশ আর কেন্দ্রীয় বাহিনী আচমকা হামলা করে। হতাহত অনেক। শঙ্কর ধরা পড়ে যান। কিন্তু তখন থেকে নিখোঁজ ছিলেন ছায়া। শঙ্কর পাথরের মতো বসে থাকতেন। কোথায় ছায়া? সেদিন জঙ্গলেই নিহত, না পলাতক, নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে? জানা ছিল না কারও। টিভিতে নাকি বলেছে, এতদিন কোনওরকমে গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর ছায়া কিছু সাহায্যের জন্য রাতে বাপের বাড়ির গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই কেউ পুলিশকে খবর দেয়। ভোরবেলা বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। ছায়া ধরা পড়েন।
অমিয় বললেন, ‘নিজের লোকেরাই ধরিয়ে দিল।’
অপরেশ বললেন, ‘শঙ্কর খবর পেল কী? সে তো বোধহয় এখন হুগলি জেলে।’
অমিয় বললেন, ‘যতটুকু জানি ছায়া তো কিছুদিন কুসুমডিহার দিকটাতেও ছিল। ও কতটা কী জানে, পুলিশকে কিছু বলে ফেলছে কি না, এ তো চিন্তার ব্যাপার হল।’
অরবিন্দ বলল, ‘খবর আরেকটা আছে। আপনাদের ওই বিশাল, প্রেসিডেন্সি জেলে কীসব করেছিলেন, তাই জেল ট্রান্সফারের অর্ডার হয়েছে। আপাতত দমদমে আসছেন। আপনাদের জমবে ভালো।’
ওদিকে, ত্রিপাঠী সাহেব তখন রাহুলকে ফোনে বলছেন, ‘কনগ্র্যাটস। তোমার সোর্স ঠিক খবর দিয়েছে। ছায়া মহিলাটি গ্রেপ্তার হয়েছে। একদম বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। গরিব খুব। আর চাপ নিতে পারছে না। বেশ কিছু ইনফর্মেশন দিয়েছে। পরে নোট পাঠাচ্ছি। রেডি হও। সাসপেক্টদের একটা বাড়ি আমাদের লোকেরা ঘিরে রেখেছে সিভিলে। তুমি পৌঁছও। হোয়াটসঅ্যাপ দেখো।’
(চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!