ড. বাত্রার সাফল্যের মধ্যেও এক আশ্চর্য সরলতা আছে। তিনি ভালোবাসেন চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি, সংগীত, কবিতা ভালোবাসেন জীবনকে উদ্যাপন করতে। কর্মক্ষেত্রে যতই শৃঙ্খলা আর দূরদর্শিতা থাক, ব্যক্তিজীবনে তিনি এক বিনম্র, হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। বিশ্বাস করেন, সুখ ছড়িয়ে দিলেই তা বাড়ে। পজিটিভ হেলথ অ্যাওয়ার্ড, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে জীবনযুদ্ধে বেঁচে ওঠার সাফল্যের উৎসব। তারকাদের নিয়ে শো। নিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠান। শহরের আধুনিকতম প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উনি সেলিব্রিটি এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আয়োজন করে সে এক মহা উৎসব করেন যেটি একটি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরে। টক অফ দ্য টাউন।
৩৫.
খুব ছোটবেলায় বাবার স্কুল ছিল আমাদের গ্রাম থেকে দূরে অন্য গ্রামে। অতদূর রোজ যাওয়া যেত না বলে ওখানেই থেকে যেত কারও বাড়িতে। তাদের ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। শনি-রবিবারে বাড়িতে আমাদের সঙ্গে। যে ক’দিন থাকত না, সে ক’দিন মাঝে মাঝে লুকিয়ে বাবার জিনিসপত্র ঘাটতাম তার মধ্যে বাবার বিয়ের সময়ের ঘড়ি, কলম। ‘পার্কার’ কলমের ক্লিপটা ছিল ধনুকের তীরের মতো। কলমটার পিছন থেকে পাম্প করে কালি ভরার ব্যবস্থা আর নিবটা ছিল সোনার। ঘড়িটা ছিল, ‘ওয়েস্ট অ্যান্ড ওয়াচ’ কোম্পানির। গোল, ভারী আর মজবুত। আমরা বলতাম আম-পাড়া ঘড়ি। কারণ, ঢিলের মতো ওই ঘড়িটা দিয়ে আম পাড়লেও ওই ঘড়িটার কিছুই হবে না, এতই মজবুত। ডায়ালের সংখ্যাগুলো বেশ বড় বড় আর কাটা দুটো ছিল চকচকে ঘন নীল রঙের।
বাবার একটা ছোট সাইজের সুন্দর ডায়েরি ছিল। আর ছিল একটা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বই। ‘বায়োকেমিক কম্পারেটিভ মেটেরিয়া মেডিকা’। সেই বইতে অল্প কয়েকটা ওষুধে অনেকগুলো রোগ সারানোর ব্যাপারে লেখা ছিল। আসল উদ্দেশ্য কত কম খরচে এবং অল্প আয়োজনে নিজেই ডাক্তারি করা যায়। একটু বড় হয়ে হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা ‘হ্যানিম্যান’-এর ইংরেজি বিদঘুটে বানানে অকারণ বাড়তি কন্সোন্যান্ট আর ‘হোমিওপ্যাথি’ শব্দটাতে অনেকগুলো ভাউয়েল কেমনভাবে আছে দেখতে মজার লাগত এবং মুখস্ত করে ফেলেছিলাম।
মুম্বইয়ে এসে বছরখানেকের মাথায় ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া’ ম্যাগাজিনের পাতায় আমার প্রতিবেশী হলেন ড. মুকেশ বাত্রা। মানে, আমাদের দু’জনেরই কলাম ছিল ওই ম্যাগাজিনে পাশাপাশি পৃষ্ঠায়। আমার কমিক্স ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিন’ আর ডক্টর বাত্রা-র ‘গার্হস্থ্য জীবনে হোমিওপ্যাথি’। ওঁর সঙ্গে যেদিন মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেদিন আলাপের সময় বলেওছিলাম, আপনি আমার প্রতিবেশী। সেই থেকে, অর্থাৎ মুম্বই বসবাসের একেবারে গোড়া থেকেই, ড. মুকেশ বাত্রা আমার সমবয়সি বন্ধু হলেন।
………………………………….
পজিটিভ হেলথ ক্লিনিক– এই নামকরণেরও একটা যথার্থতা আছে, সেটাও লক্ষ্য করলাম। হোমিওপ্যাথিতে যেমন শুরুতে শ’খানেক প্রশ্ন করা হয়, এখানেও তাই আছে। তফাত যেটা, রোগীর সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য এখানে কম্পিউটারে নথিবদ্ধ করা হয়। যে অসুখের জন্য আসা হয়েছে সেটা ছাড়াও বাড়তি অসোয়াস্তির তথ্যগুলোও নথিবদ্ধ করে রাখেন। পরবর্তীকালে আবার চিকিৎসার জন্য এলে পুরো পিছনের ইতিহাসটা ডাক্তারের সামনে মনিটরে, তাই সময় নষ্ট কম, গপ্পো বেশি।
………………………………….
আজকের ভারতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে মুকেশ বাত্রা একজন ‘সেলিব্রিটি ডাক্তার’ শুধু নন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশ-বিদেশে ওঁর উন্নতির বহর দেখলে অবাক হতে হয়। ড. বাত্রা, ১৯৮২ সালে মুম্বইয়ের চৌপাট্টিতে, ভারতীয় বিদ্যাভবনের সামনে ‘পজিটিভ হেলথ ক্লিনিক’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে সেটা বিশ্বের বৃহত্তম হোমিওপ্যাথি চেইনে পরিণত হয়, যার ২০০টিরও বেশি শাখা রয়েছে দেশে-বিদেশে।
পজিটিভ হেলথ ক্লিনিক– এই নামকরণেরও একটা যথার্থতা আছে, সেটাও লক্ষ্য করলাম। হোমিওপ্যাথিতে যেমন শুরুতে শ’খানেক প্রশ্ন করা হয়, এখানেও তাই আছে। তফাত যেটা, রোগীর সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য এখানে কম্পিউটারে নথিবদ্ধ করা হয়। যে অসুখের জন্য আসা হয়েছে সেটা ছাড়াও বাড়তি অসোয়াস্তির তথ্যগুলোও নথিবদ্ধ করে রাখেন। পরবর্তীকালে আবার চিকিৎসার জন্য এলে পুরো পিছনের ইতিহাসটা ডাক্তারের সামনে মনিটরে, তাই সময় নষ্ট কম, গপ্পো বেশি। এছাড়া সব ক্লিনিকে সে তথ্য অনলাইনে জানানোর ব্যবস্থা। প্রয়োজনে অন্য শহরে বা অন্য ব্রাঞ্চেও চিকিৎসা অব্যাহত থাকতে পারে। ভালো না?
সময়টা এমন ছিল, যখন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত না। অনেকেই একে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমকক্ষ মনে করতেন না। অথচ সেই সময়েই এক তরুণ চিকিৎসক বিশ্বাস করেছিলেন– এই প্রাচীন পদ্ধতির ভেতরে ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞান লুকিয়ে আছে। আজ তিনি শুধু হোমিওপ্যাথির একজন পুরোধা নন, বরং একজন সফল উদ্যোক্তা, সমাজসেবক এবং একজন সৃষ্টিশীল মানুষ, যিনি জীবনকে আনন্দময় ও অর্থবহ করে তুলতে চান।
ড. বাত্রার জন্ম এক সাধারণ পরিবারে, কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল অসাধারণ। ওর বাবা-মাও ছিলেন চিকিৎসক। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথ এবং মা অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসক, যার ফলে তিনি ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসা পেশার সঙ্গে পরিচিত। তিনি মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোমিওপ্যাথিতে স্নাতক। শুরু থেকেই উপলব্ধি করেন– এই চিকিৎসাব্যবস্থার অসীম সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে হাঁটা সহজ ছিল না। একদিকে চিকিৎসাক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতির প্রতি অন্ধ আস্থা, অন্যদিকে সমাজের অবজ্ঞা– সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। ২০১২ সালে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অবদানের জন্য ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন এবং তিনি ‘হিলিং উইথ হোমিওপ্যাথি’ আর “দ্য নেশন’স হোমিওপ্যাথ” সহ অন্যান্য গ্রন্থের রচয়িতা।
প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আসেন, তাই ওঁর সম্পর্কে খুব একটা বিজ্ঞাপনের মতো ভাষা প্রয়োগের দরকার নেই। কিন্তু এই হোমিওপ্যাথি ব্যাপারে ওঁর ছোট ছোট অবদানের যে মজার দিক, তার একটা অন্তত বলে আপাতত চলে যাব রক্তমাংসের মানুষটি সম্পর্কে আনন্দ-ফূর্তি আর জীবনযাপন বিষয়ে।
সাদা সাবুদানার মতো দেখতে মিষ্টি দানার ওষুধ দিয়ে থাকেন হোমিওপ্যাথির ডাক্তারবাবুরা। শিশির গায়ে কাগজের লেবেল এঁটে লিখে রাখা নাম। আর্নিকা, নাক্স ভোমিকা, অ্যাকোনাইট, ক্যালি ফস, রাস টক্স ইত্যাদি অনেকের মুখস্থ। ছোট্ট ওই আদরের কাচের শিশিটা সবার প্রিয়। আমরা তো ওইগুলোকে জড়ো করে আঠা দিয়ে এঁটে নানা রকম খেলনা বানাতাম। মেয়েরা ওর মধ্যে সূঁচ রাখে, খেলনা রাখে, এমনকী নাকের, গানের গহনা। বাংলায় হয়তো হোমিওপ্যাথি শিশির দুর্গা বলে বিশাল এক প্রতিমাও কোথাও বানানো হয়েছিল। আমার মনে নেই।
ড. বাত্রা এক অভিনব পথ বের করেছেন। শিশিতে নয়, উনি ওষুধ দিচ্ছেন ব্লিস্টার প্যাকে। অর্থাৎ, খুপরি খুপরি করা অ্যালোপ্যাথিক ট্যাবলেট রাখার যেমন পাকেজ হয় তেমন। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ফোসকার মতো দেখতে পকেটগুলোর মধ্যে রাখা হয় ওষুধের দানা। ওপরে একটা পাতলা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে আটকে দেওয়া। খুব সহজে এগুলো ব্যবহার করা যায়। দানাগুলো কম বেশি হওয়ার ভয় নেই, পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। এছাড়াও একটা খুব স্মার্ট চেহারা। এদিক-ওদিক নিয়ে যাওয়ার জন্য, ব্যাগে রাখা, পকেটে রাখা, ক্যুরিয়ার করে যত্রতত্র পাঠানো ইত্যাদি নানা বিষয়ে বেশ সহজ আর সুবিধের।
যেটা বলা হয় না, গোপনে সেটাই বলছি, আমার ধারণা, ব্লিস্টার প্যাকে ওষুধ দেওয়ার ফলে হোমিওপ্যাথির অদ্ভুতুড়ে ডোজের মস্ত সমাধান হল। হোমিওপ্যাথি ওষুধের ডোজ খুব অদ্ভুত ধরনের হয় কখনও কখনও। যেমন, এক্ষুনি এক ডোজ এবং সেটা মাত্র একবারই খেতে হবে। তারপরে একদিন বাদে, তিন দিন বাদে, এইটা একদিন, পরদিন ওইটা, তার পরের দিন আগেরটা, ১৫ দিন পর ইত্যাদি করে লম্বা সময়। ধরা যাক, একবারে দু’-সপ্তাহ বা চার সপ্তাহের ওষুধ দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে ব্লিস্টার প্যাকের মধ্যে ওষুধ রাখার সময় প্রথম খুপরিতে প্রথম দিনের জন্য, তিন দিনের মাথায় তিন নম্বর খুপরিতে ওষুধ এবং সাত দিনের মাথায় ওষুধ থাকছে সাত নম্বর খুপরিতে। বাকিগুলো শুধু ফাঁকা, ওষুধ ছাড়া দানা দিয়ে ভরা। রোজ খাও। দিন ভুলে যাওয়ার কোন ভয় নেই। প্যাকের গায়ে লেখা দরকারি তথ্য। তাছাড়া আজকাল ব্যস্ত নাগরিক জীবনে এই আধুনিকতার এবং কারও ভুলোমনের দায়িত্ব নেওয়ার মূল্য অনেকখানি।
আমার বন্ধু ভাগ্য ভালো সে কথা বারবার বলেছি। বন্ধুত্বের পুরনো সংজ্ঞা– উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে… ইত্যাদি। আধুনিক কালে, পরিণত বয়সে পিছনে তাকিয়ে দেখছি, পরিবেশ এবং সংস্কৃতি মিলিয়ে মোট চারটি প্রধান ভাগে বন্ধু পেয়েছি। প্রথমত, আমার গ্রাম এবং কলকাতা জীবনে বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ। প্রতিবেশী-স্কুল কলেজ-অফিস কাছারি। যাকে বলে, হাঁকে ডাকে, ধান ফুরোলে, পান ফুরোলে পাশাপাশি বেঁধে বেঁধে থাকা বন্ধু।
বাংলা ত্যাগ করে, সংস্কৃতির শিকড় ছিঁড়ে যখন পরিযায়ী হলাম, তখন পেলাম দ্বিতীয় জাতের বন্ধু। চলে গেলাম দক্ষিণ ভারতে। মানুষগুলো হঠাৎ আলাদা হয়ে গেল। জল-হাওয়া, শিল্প-সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ইত্যাদি মিলিয়ে যেন ইতিহাসের অন্য অধ্যায়। অজানা মানুষ আপন হয়েছে। পেয়েছি সংযত বন্ধু।
পশ্চিমে এলাম। মুম্বই। মানুষের চরিত্রে গেল বদলে। প্রাচুর্য-বিলাসিতা-আনন্দ-উৎসব। উন্মাদনা-উত্তেজনা-চূড়ান্ত সুখ। প্রচ্ছন্ন থেকে যায় ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট। ‘আমরা সবাই রাজা’ মেজাজ। ধনীদের দেখলাম। জীবনে সফল অসংখ্য মানুষকে দেখলাম। নানা বিষয়ে তারকাদের দেখলাম। কখনও মঞ্চে, কখনও তাঁদের বাড়িতে। আন্তরিক ভাবে, ঘরোয়া ভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়, একই মানুষগুলোকে রক্তমাংসের করে চেনা যায়। এখানেই আমি বন্ধু ড. মুকেশ বাত্রার কাছে ঋণী। ধনী সমাজের মানুষের প্রাচুর্যের মধ্যেও অনেককেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার সেতু, ড. বাত্রা।
চতুর্থ জাতের বন্ধু পেলাম এমন, যাদের কখনও চোখেও দেখিনি। প্রযুক্তির উন্নতিতে এবং আমাদের এই পৃথিবীর সবচেয়ে সফলতম সময়ে যে বসবাস করছি, তার জন্য ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। নেশায় ও পেশায়, ক্ষুদ্র ক্ষমতায়, পৃথিবীতে আজ আমার অসংখ্য ভালো বন্ধু, যারা দূর থেকেও সাহায্যের হাত বাড়ায়।
ড. বাত্রার প্রতিটি পজিটিভ হেলথ ক্লিনিকের সজ্জা অতি আধুনিক। সমস্ত ক্লিনিকে ও বাড়িতে যত ছবি শিল্পকর্ম আছে, তা সমকালীন শিল্পীদের। সবই উনি সংগ্রহ করেছেন। উনি ছবির প্রদর্শনীতে নিয়ম করে আসেন। আমার যত ছবি বিভিন্ন ক্লিনিক এবং বাড়িতে আছে তার একটাও দাতব্য নয়, উনি কিনেছেন। প্রথম ক্লিনিক, যেটা ওর সবচেয়ে প্রিয় সেই ক্লিনিকে, ক্যানভাসে নয় দেওয়ালে ছবি এঁকেছেন এম এফ হুসেন।
সখের ইয়ট কিনেছেন ড. বাত্রা। বহুমূল্য, বিলাসবহুল প্রমোদতরণী। সুযোগ পেলেই বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তিনি চলে যান আরবসাগরের গভীরে, সমুদ্রের জল যেখানে বিচের দিকের মতো ঘোলা নয়, রঙিন। দিনের আলোতে জলের রং দেখে, সূর্যাস্ত দেখে, রাতের খাদ্য পানীয়ের সঙ্গে আনন্দ করে ফিরে আসার সুযোগ।
নিজের ফটোগ্রাফি শো করেন। চ্যারিটির কাজে যুক্ত এই প্রদর্শনী। পিরামল গ্যালারি, এন.সি.পি.এ, কিতাবমহল এবং অন্যান্য নানা গ্যালারিতে। নানা দেশ ভ্রমণের ছবি। জনজীবনের খুঁটিনাটি থেকে প্রকৃতির বিশালত্ব। সেটাও একটা নিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
ড. বাত্রার সাফল্যের মধ্যেও এক আশ্চর্য সরলতা আছে। তিনি ভালোবাসেন চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি, সংগীত, কবিতা ভালোবাসেন জীবনকে উদ্যাপন করতে। কর্মক্ষেত্রে যতই শৃঙ্খলা আর দূরদর্শিতা থাক, ব্যক্তিজীবনে তিনি এক বিনম্র, হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। বিশ্বাস করেন, সুখ ছড়িয়ে দিলেই তা বাড়ে।
পজিটিভ হেলথ অ্যাওয়ার্ড, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে জীবনযুদ্ধে বেঁচে ওঠার সাফল্যের উৎসব। তারকাদের নিয়ে শো। নিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠান। শহরের আধুনিকতম প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উনি সেলিব্রিটি এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আয়োজন করে সে এক মহা উৎসব করেন যেটি একটি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শহরে। টক অফ দ্য টাউন।
নিজে গান গাইতে ভালোবাসেন ড. বাত্রা। মাস্টার রেখে গান শিখেছেন। মনে আছে প্রথম ওঁর কাফ প্যারেডের বাড়িতে গান শুনতে শুনতে ঘরে বানানো, গুড়োমশলা মাখা, মুচমুচে ঢ্যাঁড়শ ভাজা খেয়েছিলাম। খাওয়াতে ভালোবাসেন। নামীদামি ভালো খাবারের সঙ্গে নতুন নতুন অনেক ঘরোয়া খাবার আমরা খেয়েছি। ঘরোয়া গানের আসর থেকে বাড়ির ছাদে গান। বড় বড় গজল গাইয়েদের দিয়ে গানের আসর। দেশ বিদেশের সেলিব্রিটি শ্রোতা-দর্শক, খাওয়া দাওয়া, মৌজ-মস্তি। এমনকী, বড় অডিটোরিয়ামে ‘ইয়াদোঁ কি বাহার’ নামে নিজের গানের রুটিন বার্ষিক অনুষ্ঠান চলছে অনেক বছর ধরে।
অ্যাম্বি ভ্যালি নগরীতে একদিন সারাদিন । ‘অ্যাম্বি ভ্যালি’ একটি বিলাসবহুল প্রাইভেট আবাসনের বড়সড় স্বয়ংসম্পূর্ণ নগরী। কী নেই সেখানে! দোকানপাট, হোটেল বড় অনুষ্ঠান করার হল। আছে গল্ফ কোর্স। আর আছে মানুষের হাতে বানানো পাহাড় কেটে বিশাল লেক, দেখলে পাহাড়ি নদী মনে হবে। তার ধারে ধারে আছে বানানো বালির বিচ এবং নৌকাবিহারের আয়োজন। পাহাড়ের কোলে আদিবাসীদের গ্রাম, হাতে তৈরি শিল্পকর্মের বাজার। সব মিলিয়ে একটি শহর, যেখানে বাইরে না এলেও সবকিছুই পাওয়া যায়। চিকিৎসা, স্কুল, বাজার ঘাট, আন্তর্জাতিক মানের অতি উৎকৃষ্ট বাড়িঘর, মায় নিজস্ব এয়ারপোর্ট পর্যন্ত। সমস্ত কিছুই ধনীদের বসবাসের জন্য। বাংলার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও বাংলো আছে ওখানে। সাহারা পরিবারের সুব্রত রায়ের পরিকল্পনায় এই প্রজেক্ট।
জায়গাটা পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় লোনাভ্লার কাছে। এটাকে দেখতে সাধারণ মানুষের টিকিট কেটে যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। অত্যাধুনিক হোটেল আছে। তবে সেখানে বসবাসকারীদে বন্ধু হিসেবে, অতিথি হিসেবে যাওয়া যায়। আমরা সেভাবেই গেছিলাম ড. বাত্রার এই বাংলো-বাড়িতে। জলের ধারে চমৎকার কাঠের বাংলো। গান-বাজনা, খাওয়া দাওয়া ছাড়াও উনি নিজে গাড়ি চালিয়ে, আমাদের পরিবারের সকলকে সারা শহরটা দেখিয়েছিলেন সেদিন।
পরিশেষে বলতে হয়, এ কাহিনি শুধু ড. বাত্রার নয়। এটি সেই সব মানুষের কাহিনি, যাঁরা অন্তরের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন পথ গড়েন। যারা প্রথা ভাঙেন, এবং সৃষ্টিশীলতা ও মানবিকতার এক নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেন।
‘তুমি যদি সত্যিই কোনও কিছুকে ভালোবাসো– তবে সাহসী হও। তুমি একা হলেও, ইতিহাস হতে
আমি তাঁকে বহু বছর ধরে চিনি– একজন চিকিৎসক হিসেবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসেবে। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বাস্থ্যসেবা কোনও বিলাসিতা নয়– এটা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই তিনি এমন বহু ক্লিনিক চালু রেখেছেন, যেখানে অসহায় মানুষ চিকিৎসা পান বিনামূল্যে। তিনি এই দায়িত্বকে দয়া হিসেবে দেখেননি, তিনি একে নিজের কর্তব্য মনে করেন। যেখানেই যান, হৃদয়ের উষ্ণতা ছড়িয়ে দেন। ওঁর সাফল্য চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো, অথচ তাঁর চোখে আপনি দেখতে পাবেন এক শিশুর সরলতা। শুধু একজন চিকিৎসক বা উদ্যোক্তা নয়, বরং খুঁজে পাওয়া যাবে একজন নিঃস্বার্থ হৃদয়ের অধিকারী, বন্ধু মানুষকে।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৩৪। শক্তিদার ব্র্যান্ড কী? উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাংলায় কোনও ব্র্যান্ড হয় না’
পর্ব ৩৩। পত্রিকা পড়তে ছোটদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়, খেয়াল রাখতেন নীরেনদা
পর্ব ৩২ । কে সি দাশের ফাঁকা দেওয়ালে আর্ট গ্যালারির প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বীরেনদা
পর্ব ৩১। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে, আমার জন্য তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন নিয়ে এসেছিলেন অহিদা
পর্ব ৩০। হাতের লেখা ছোঁয়ার জন্য আপনার ছিল ‘ভানুদাদা’, আমাদের একজন ‘রাণুদিদি’ তো থাকতেই পারত
পর্ব ২৯। পুবের কেউ এসে পশ্চিমের কাউকে আবিষ্কার করবে– এটা ঢাক পিটিয়ে বলা দরকার
পর্ব ২৮। অন্ধকার নয়, আলো আঁকতেন গণেশ পাইন
পর্ব ২৭। প্রীতীশ নন্দীর চেয়েও কলকাতা ঢের বেশি চেনা অমিতাভের!
পর্ব ২৬। রুদ্রদা, আপনার সমগ্র জীবনযাত্রাটাই একটা নাটক, না কি নাটকই জীবন?
পর্ব ২৫। ক্ষুদ্রকে বিশাল করে তোলাই যে আসলে শিল্প, শিখিয়েছিলেন তাপস সেন
পর্ব ২৪: নিজের মুখের ছবি ভালোবাসেন বলে জলরঙে প্রতিলিপি করিয়েছিলেন মেনকা গান্ধী
পর্ব ২৩: ড. সরোজ ঘোষ আমাকে শাস্তি দিতে চাইলেও আমাকে ছাড়তে চাইতেন না কখনও
পর্ব ২২: মধ্যবিত্ত সমাজে ঈশ্বরকে মানুষ রূপে দেখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল