১৯৭৭-’৭৮ সাল নাগাদ স্থায়ী পদের জন্য পরীক্ষা হল। নির্বাচিত হলাম শর্মিষ্ঠাদি, আমি আর ত্রিবেণী থেকে আসা একটি নতুন মেয়ে, নাম যতদূর মনে পড়ছে, কাকলী, ও দু’-তিনদিন মাত্র ক্যামেরা ফেস করেছিল। কোনও অজানা কারণে এই নির্বাচন ‘Null n Void’ হয়ে যায়। ১৯৭৯-এর গোড়ায় স্থায়ী পদের জন্য পরীক্ষায় আবার বসতে হল, স্ক্রিন টেস্ট, ভাইভা (viva) ইত্যাদি।
প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিটি অনন্ত দাসের মেকআপ করার। বলা বাহুল্য, সঙ্গের ভদ্রলোক দেবাশিস রায়চৌধুরী নন।
৬.
তখন ট্রান্সমিশনের শেষ ঘোষণার আগে হত ইংরেজি সংবাদ। নিউজ রিডারদের মধ্যে ছিলেন, এন. বিশ্বনাথন, জয়ন্ত কৃপালিনী, রীতা ভিমানী, শর্মিষ্ঠা গুহ, ইন্দ্রাণী রায়, জিজা ভট্টাচার্যি, রত্না দত্ত এবং লীনা সেন। লীনা খবরটা শেষ করে এমন একটা মিষ্টি হাসি হাসত যেটা দেখার জন্য দর্শক বসে থাকতেন, অদ্ভুত একটা চার্ম ছিল। ওর কথা খুব মনে হয়, অমনি সুন্দরী আর কোথায় আছে!
রীতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। জয়ন্ত আর রত্নাদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিছুদিন আগে। ইন্দ্রাণীর সঙ্গেও পরে যোগাযোগ হয়েছিল, ও তখন দিল্লি দূরদর্শনে ছিল। জিজাদির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অনেকদিন। ১৯৮৮-এ রাজা যখন “Tagore’s Dream: Our Dream” তথ্যচিত্র করে তখন জিজাদি তাতে ভাষ্যপাঠে ছিলেন। শর্মিষ্ঠার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল, ও তখন সেন্ট জেমস-এ পড়াত, মেকআপ রুমে আমাদের আড্ডা হত। সেন্ট জেমস বলতেই মনে পড়ল মি. মেসনের কথা, জন মেসন, ক্যুইজ কনডাক্ট করতে আসতেন, কী যে দারুণ লাগত ওঁকে! নীল ও’ব্রায়েন আসতেন কখনও কখনও ক্যুইজ মাস্টার হিসেবে। ‘QuizTime’ অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের।
ইংলিশ নিউজ রিডার, যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের সঙ্গে পরে যোগ দিয়েছিল কৃষ্ণা ব্যানার্জি আর অদিতি রায়। অদিতির কথা প্রথম পর্বেই বলেছি, সেই যে প্রথম দিন লাইভ অনুষ্ঠান করেছিলাম, ১৫ আগস্ট, ও ছিল সেদিন ঘোষণায়। পরে নিউজে এল, ততদিনে ও অদিতি লাহিড়ী। নিউজ প্রোডিউসার ফানি, ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ীর নাম আগে করেছি, ওরা বিয়ে করল। সহকর্মীদের মধ্যে ওটাই প্রথম বিয়ে। তারপর সমীর-সরিতা, শর্মিষ্ঠাদি-পঙ্কজদা, মালতী-নির্মলেন্দুদা, অনেক পরে মালিনী-গৌতম ভৌমিক। অদিতি-ফানির বিয়ে অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, অদিতি বহুদিন বিদেশে, নামকরা ভাষাতত্ত্ববিদ। ওর সঙ্গে কয়েক বছর আগে দেখা হয় এক অনুষ্ঠানে।
……………………………………………………………..
বিপ্লব দাশগুপ্ত আমাদের প্রেজেন্টেশন সেকশনে ছিল, পরে ঘোষক থেকে সংবাদ পাঠক হল। কমলিকা ভট্টাচার্য, জয়া বসু– এমন কয়েকজন সংবাদ পাঠিকাও ছিল। বিপ্লবের কথা যখন এল তখন বলি, একটা সময় বিপ্লব, শাশ্বতী আর আমার মধ্যে মাসে দশদিন করে ৩০ দিনের ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হত, এভাবেই বেশ কয়েক মাস চলে ছিল, সেই সময় সেকশন দেখতেন বিশ্বনাথদা।
……………………………………………………………..
বাংলা খবর পড়তে আকাশবাণী থেকে তরুণ, ছন্দা যেমন এসেছিল তেমনই কিছুদিনের জন্য এসেছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে দেবাশিস বসুও এল রেডিও থেকে। ছিল দেবরাজ রায়, দীপক চক্রবর্তী (আজকের চিরঞ্জিত)। বিপ্লব দাশগুপ্ত আমাদের প্রেজেন্টেশন সেকশনে ছিল, পরে ঘোষক থেকে সংবাদ পাঠক হল। কমলিকা ভট্টাচার্য, জয়া বসু– এমন কয়েকজন সংবাদ পাঠিকাও ছিল। বিপ্লবের কথা যখন এল তখন বলি, একটা সময় বিপ্লব, শাশ্বতী আর আমার মধ্যে মাসে দশদিন করে ৩০ দিনের ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হত, এভাবেই বেশ কয়েক মাস চলে ছিল, সেই সময় সেকশন দেখতেন বিশ্বনাথদা। নতুন যারা আসত তারা আমাদের সঙ্গে থাকত প্রথমে অবজার্ভার হিসেবে, তারপর তাদের ছোট ছোট ঘোষণা করতে দেওয়া হত।
আমার সঙ্গে একদিন ডিউটিতে এল অল্পবয়সি একটি ছেলে, গোঁফও ওঠেনি তার, নাম দেবাশিস রায়চৌধুরী। শিপ্রা রায় এলেন মেকআপ রুমে, অনন্তদাকে (সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যিনি মেকআপম্যান ছিলেন সেই অনন্ত দাস, আমাদের এখানে মেকআপ হেড ছিলেন) বললেন, ‘ওকে গোঁফ এঁকে দাও নয়তো বড্ড বাচ্চা বাচ্চা লাগছে’, যেমন নির্দেশ তেমন কাজ। কবেকার কথা এসব, সেই দিন থেকে যে হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল তা আজও অম্লান, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বেড়েছে বই কমেনি। দেবাশিস অবশ্য ঘোষণায় বেশিদিন থাকেনি। ও গেল প্রোডাকশনে, অভিজিৎ দাশগুপ্তকে অ্যাসিস্ট করত। দূরদর্শন ছেড়ে পরে চলে গেল অধ্যাপনা করতে।
সম্ভবত সেবারের অডিশনেই রীতা কয়রাল এল। ঝকঝকে চেহারা, সুন্দর বাচনভঙ্গী, ক’দিনেই রপ্ত করল ঘোষণার ধারা। কিছুটা অনুসরণ করত আমাকে। দারুণ স্মরণশক্তি ছিল ওর, কতখানি লেখা যে ও না দেখে বলতে পারত! পরে মেগা সিরিয়াল করতে গিয়ে এই গুণ ওর কাজে লেগে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। রীতা ছাড়া আর যে আমাদের সঙ্গে অনেক দিন অবধি কাজ করেছে সে হল শর্বরী দাশগুপ্ত, স্নিগ্ধ সুন্দর চেহারা, নম্র কথা বলার ভঙ্গী, ইংরেজি বাংলা দুটো ভাষাতেই সমান পারদর্শী। এল আরেক সুন্দরী, নাম তার আভেরী দত্ত। পরবর্তীতে যে বহুরূপীর মৃচ্ছকটিকের বসন্তসেনারূপে খ্যাত। ওদের সকলের সঙ্গে আমার স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠল।
প্রায় এই সময় দিয়েই অরুন্ধতী রায়, প্রণতি মিত্র মুস্তাফি, অজন্তা সেনগুপ্ত এবং রুমা চ্যাটার্জি। আরেক রুমাও এল অল্প ক’দিনের জন্য,পরে বিপ্লব দাশগুপ্তের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়। ’৭৭-’৭৮ সাল নাগাদ স্থায়ী পদের জন্য পরীক্ষা হল। নির্বাচিত হলাম শর্মিষ্ঠাদি, আমি আর ত্রিবেণী থেকে আসা একটি নতুন মেয়ে, নাম যতদূর মনে পড়ছে, কাকলী, ও দু’-তিনদিন মাত্র ক্যামেরা ফেস করেছিল। কোনও অজানা কারণে এই নির্বাচন ‘Null n Void’ হয়ে যায়। ১৯৭৯-এর গোড়ায় স্থায়ী পদের জন্য পরীক্ষায় আবার বসতে হল, স্ক্রিন টেস্ট, ভাইভা ইত্যাদি।
তখন সদ্য আমার বিয়ে হয়েছে। রাজা বম্বে HTA-তে, আমিও ছুটি নিয়ে চললাম সেখানে। বেশ ঘুরে বেড়িয়ে কাটাচ্ছিলাম, এমন সময় কলকাতা থেকে বাবার ফোন এল, আমি উত্তীর্ণ, ‘in order of merit’ আমার নামই প্রথমে, কিন্তু দু’দিনের মধ্যে ফিরে যদি জয়েন করতে পারি তবেই ‘in order of joining’ আমি প্রথমে থাকব।
.…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..
খবরটা পেয়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া, চোখ জল, না, আনন্দে নয়। এখন থেকে আমায় ১০টা-৫টা অফিস করতে হবে সেটা ভেবেই মনখারাপ ! কিন্তু সময় যে হাতে নেই, প্লেনে ফিরতে হবে, অথচ তখন আমার আর রাজার যা অবস্থা, সেটাও চিন্তা করতে হয়, যা হোক উপায় বের হল। রবিবার রাতে পৌঁছে সোমবারে একেবারে ফার্স্ট আওয়ার-এ রাধা স্টুডিও-তে হাজির। স্থায়ী পদের জন্য নানারকম নিয়ম নির্দেশিকা থাকে, সেসব রীতি মেনে ওথ (oath) নিয়ে যোগ দিলাম । আমার সঙ্গে নির্বাচিত হয়েছিল রুমা চ্যাটার্জি, রুমা সম্ভবত সেদিনই বেলার দিকে জয়েন করল। ঠিক দু’মাসের মাথায় স্থায়ী পদে যোগ দিল শাশ্বতী।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব …………………………….
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে