এপ্রিল মে মাস এলেই কনস্ট্যান্স আর মেরি ভাবতে শুরু করেন নিজের চোখে দেখে যাওয়া বাংলার গ্রামে গ্রামে আমের বাগান। গাছে গাছে আম পাকছে। আমবাগানে খেলে বেড়াচ্ছে বাচ্চারা। গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাচ্ছে। মার্কিন বাচ্চারা কি জীবনে পাবে সেই মজা? বাঙালি বন্ধুর বাড়িতে কনস্ট্যান্স আর মেরি দু’জনেই খেয়েছেন কাঁচা আম ঝাল-নুন দিয়ে। খেয়েছেন কাঁচা আমের চাটনি। আমের আচার। তৈরি হয় বাংলার বাড়িতে। বিক্রি হয় বাংলার বাজারে।
৪৪.
এক যে আছেন মেয়ে। আর আছেন অন্য এক মেয়ে। এঁদের কীর্তি শুনলে অবাক হবেন। এবং তাঁদের লেখা বই না পড়ে পারবেন না।
দুই মেয়ে পাগলের মতো প্রেমে পড়েছেন। প্রেমে পড়েছেন বাংলার আমের। যাকে বলে পাগলপারা প্যাশন। ‘ম্যাঙ্গো’ ছাড়া আর কোনও ফলে এঁদের রুচি নেই। বাংলার আমের নধর শরীরের রসের জন্য এঁরা পাগল!
দুই মেয়ের নাম– কনস্ট্যান্স কারকে ও মেরি নিউম্যান। প্রথম জন পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন অধ্যাপক। পড়াতেন শিল্পের ইতিহাস। দ্বিতীয় জন অধ্যাপনা করতেন ওহায়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয়, এনভায়রনমেন্টাল হেলথ।
এঁদের মহৎ কীর্তি হল, এঁদের অধ্যাপনা ও গবেষণার বিষয় থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলে এখন তাঁরা আমকে করেছেন তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। এবং আমেরিকায় আম-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে বদ্ধপরিকর এঁরা। ফোঁটা ফোঁটা করে আমের রস এঁরা ফেলতে চান মার্কিন জিভে। এবং এর ফলে ঘটেছে এক বলার মতো ঘটনা। সেই গল্পটা কিছুটা অন্তত বলতে চাই আজকের কাঠখোদাই-এ। আমার লেখার টেবিল সেই ইচ্ছেটাই চাপিয়ে দিয়েছে আমার ওপর, ২০২৫-এর এই ভরপুর আম-ঋতুতে! এবার আমার টেবিলের ইচ্ছে থেকে যাওয়া যাক এই দুই আমেরিকান মেয়ের লেখার টেবিলের হৃদয় কথায়।
দুই বন্ধু কনস্ট্যান্স আর মেরির মনে এক অদ্ভুত বাসনা জেগেছে। তাঁরা এক সঙ্গে থেকে এক লেখার টেবিলে জম্পেশ হয়ে একটা এমন বই লিখবেন, যা আগে কেউ লেখেনি। বিষয়– তাঁদের জীবনের তীব্রতম প্রেম। অর্থাৎ, বাংলার আম। তাঁরা করেছেন কী জানেন? এই বই লেখার জন্য তাঁরা একটা নতুন রাইটিং টেবিল কিনেছেন। কমদামের হালকা-পলকা টেবিল। তার ওপরে তাঁরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন নতুন ল্যাপটপ। আর একদিন মধ্যরাতে দু’জনে টেবিলে বসে ল্যাপটপের বুকে লিখে ফেলেন, যে বই তাঁরা লিখতে চলেছেন তার নাম: ‘MANGO A GLOBAL HISTORY’.
বইয়ের নাম তো দেওয়া হল। কিন্তু বইয়ের প্রথম লাইন, সেটা তো মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। দু’জনের মনে প্রথম লাইন নিয়ে একই ভাবনা! কিন্তু সাহস করে প্রথমেই কি ঝেড়ে কাশাটা ঠিক হবে? টেবিল থেকে একটা আলোর রেখা তক্ষুনি ঢুকে গেল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। আর ফুটে উঠল বইয়ের প্রথম লাইন। না, অত সহজে ঘটেনি ব্যাপারটা।
আসল কথাটাই তো বলতে ভুলেছি। দুই বন্ধু টেবিলের ওপর ল্যাপটপের পাশে রেখেছেন একটি নধরকান্তি রসালো আম। এক বাক্স লাল-হলুদ মুর্শিদাবাদী আম বাংলা থেকে পাঠিয়েছে এক অভিজাত বন্ধু। টেবিলে রাখা এই আম তাদের একটি। টেবিলে রাখা আম হাতে তুলে নেন মেরি। কনস্ট্যান্স হাত রাখেন আমের গায়ে আদর মিশিয়ে ছোঁয়ায়। আর তখুনি যেন দুই বন্ধুর মনের কথা ফুটে ওঠে ল্যাপটপের আলোকিত বুকে, বইয়ের প্রথম বাক্য হয়ে:
There is a good chance that if you live in the United States or Europe, you have never seen a tree full of ripe mangoes.
এটাই তো সত্যি কথা। খাঁটি সত্যি। আমেরিকা প্রচার করে, পৃথিবীর যা কিছু স্বাদে-গন্ধে-রসে মন মজিয়ে দিতে পারে, সব পাওয়া যায় আমেরিকার সুপার মার্কেটে। সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার! এটা মিথ্যা প্রচার না হলে কি আমের ঋতু এলেই মনে পড়ত বাংলার কথা? কোথায় সেই বাংলা বাজারের আম আমেরিকায়?
এপ্রিল মে মাস এলেই কনস্ট্যান্স আর মেরি ভাবতে শুরু করেন নিজের চোখে দেখে যাওয়া বাংলার গ্রামে গ্রামে আমের বাগান। গাছে গাছে আম পাকছে। আমবাগানে খেলে বেড়াচ্ছে বাচ্চারা। গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাচ্ছে। মার্কিন বাচ্চারা কি জীবনে পাবে সেই মজা? বাঙালি বন্ধুর বাড়িতে কনস্ট্যান্স আর মেরি দু’জনেই খেয়েছেন কাঁচা আম ঝাল-নুন দিয়ে। খেয়েছেন কাঁচা আমের চাটনি। আমের আচার। তৈরি হয় বাংলার বাড়িতে। বিক্রি হয় বাংলার বাজারে। কোথায় আমেরিকায় সেই আম-সংস্কৃতি! কোথায় আমেরিকায় আমের বাজারে সেই স্বাদ-গন্ধ-রং তরিবত? যে ফল আম বলে বিক্রি হয় আমেরিকার বাজারে সেটা কি আম না দুঃস্বপ্ন?
‘The relatively sad and antiseptic form in which mangoes are presented in (American) supermarkets, neatly cut and packaged tightly in clear plastic containers or bags’, ওইগুলো আম না আমের মড়া?
আম বলতে অধিকাংশ বাঙালি একটা টোটাল অভিজ্ঞতা বোঝে। অর্থাৎ, আমের সৌরভ-স্বাদ-স্পর্শ-শরীর এবং সন্নিবেশ। সব মিলিয়ে এক অনস্বীকার্য আমত্ব। মজার ব্যাপার, দুই আমেরিকান লেখিকাকে তাঁদের লেখার টেবিল বাঙালির চোখ দিয়েই যেন আমকে জানতে, বুঝতে, উপভোগ করতে শিখিয়েছে। এক বাঙালি বন্ধু এই দুই আমেরিকান মেমসাহেবকে একদিন বলেছিলেন, ‘The consumption of a ripe, fresh mango is a full- body experience.’ এই কথা শোনার পরে দুই মার্কিন লেখিকার মনে একটি প্রশ্ন: আমেরিকা ফুল বডি মালিশ বুঝবে। কিন্তু ‘ফুল বডি ম্যাঙ্গো এক্সপেরিয়েন্স’ জন্মে বুঝবে কি? কেননা, আমেরিকায় সেই টাটকা আম কোথায়?
ইউরোপের আমের বাজারও দুঃস্বপ্ন, হঠাৎ যেন বলে ওঠে লেখার টেবিল। আর ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফুটে ওঠে হাসির ঝলক। আর সেই হাসির বুকে এই গল্প:
ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তখন তরুণী। বাকিংহাম প্যালেসের আমে তাঁর অরুচি। না আছে স্বাদ, না আছে সুগন্ধ! রানি বললেন, আমি নিজে ফলের বাজারে গিয়ে আম কিনব। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা রানিকে ফলের বাজারে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু লন্ডনের আমের বাজারে এ কি আমের ছিরি! কিছু ঘেয়ো পচা আম তাঁর চোখের সামনে! সেই ছবি বেরল কাগজে। রানি বললেন, বাকিংহাম প্যালেসের বাগানে আমগাছ লাগাও। কিন্তু বিলেতের শীতে আম পাকবে কী করে? বাংলার গরমি ছাড়া কি আমের পাক ধরে?
‘ম্যাঙ্গো: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি’ বইটা হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে এই ভাষায়: ‘The ecstatic praise for fresh mangoes makes people in the Western world a bit uncomfortable.’ কারণ তারা তো টাটকা আমের স্বর্গীয় স্বাদ কোনওদিন জানল না! তারা তো চড়া দামের আমের ফসিল কিনে প্লেটে সাজিয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে খায়! ‘ম্যাঙ্গো: এ গ্লোবাল হিস্ট্রি’ গতবছর প্রকাশিত হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ম্যাকমিলন প্রকাশনের সৌজন্যে সবে পৌঁছেছে কলকাতায়। আর আমার প্রিয় শুড়িখানার সান্ধ্য-স্নিগ্ধ ছায়া ছায়া পরিবেশে সেই আমসংহিতা তরুণ পৌঁছে দিল আমার হাতে। জীবন এখনও কত দেয়! আমি কৃতজ্ঞ!
ছায়া ছায়া আলোয় পড়লাম বইটার প্রচ্ছদে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর অপূর্ব ইংরেজিতে এই প্রশংসা: ‘A great gift for the food-lovingest reader or the book- lovingest cook in your life!’
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৪৩: দু’পায়ে দু’রকম জুতো পরে মা দৌড়ে বেরিয়ে গেল, ইবতিসম্-এর উপন্যাসের শুরু এমনই আকস্মিক
পর্ব ৪২: অন্ধকার ভারতে যে সিঁড়িটেবিলের সান্নিধ্যে রামমোহন রায় মুক্তিসূর্য দেখেছিলেন
পর্ব ৪১: বানু মুশতাকের টেবিল ল্যাম্পটির আলো পড়েছে মুসলমান মেয়েদের একাকিত্বের হৃদয়ে
পর্ব ৪০: গোয়েটের ভালোবাসার চিঠিই বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সুইসাইড প্রবণতা
পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে
পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?
পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল