চারপাশে পুলিশ বাড়ছে। এত বড় ঘটনা আবার, ফোর্স ঢুকছে। তল্লাশি শুরু, কমরেড ব্রহ্মা কোথায়, বিদ্যুৎ কোথায়? পুলিশের ব্যস্ত ছোটাছুটির মধ্যেই ধীরপায়ে হেঁটে রেশমিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চলল পোস্টমাস্টার সুমিত। কিন্তু তার মাথায় ততক্ষণে অন্য চিন্তা ঘুরছে। বিষ্ণু, সুনেত্রা ধরা পড়েছে। পুলিশ তাদের হেফাজতে নিলে তারা মুখ খুলবে না তো? সময় আসছে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমাজের মধ্যে, সমাজের কাঠামোতেই আত্মগোপন করেছিল থেকে লড়াই যেমন চলছে, তাই চলবে? নাকি, সব ছেড়ে পুরোপুরি জঙ্গলের জীবনে থেকে লড়াই?
২৯.
হামলাটা হলই। রাত ন’টা নাগাদ। একটু বেপরোয়াভাবে।
বিদ্যুৎ জানত রাহুলের নেতৃত্বে পুলিশ উত্তরবঙ্গে বিষ্ণু, সুনেত্রাকে ধরতে ব্যস্ত। আর বিষ্ণুরা ধরা পড়ায় মাওবাদীরা ব্যাকফুটে। বাবা বাঁশরীলালের হত্যা, তার নিজের কুসুমডিহা ছেড়ে থাকতে বাধ্য হওয়া, এসব আর হজম করে থাকতে পারছিল না বিদ্যুৎ। একে ব্যবসার লেনদেনের ক্ষতি; তার ওপর একেবারে সম্মান বিসর্জন। মাধাই আর ওর দলবলকে শেষ করে বুঝিয়ে দিতে হবে বিদ্যুৎ আছে বিদ্যুতেই। আর আচমকা বহিরাগত হামলায় কিছু হলে পুলিশ বিদ্যুৎকে জড়াতেও পারবে না।
খানিকটা প্রস্তুতি ছাড়াই বিদ্যুতের তাড়ার চোটে কুসুমডিহায় হামলা করল দুষ্কৃতীবাহিনী। মাধাই বাড়ি ছিল না। মারধর, অগ্নিসংযোগ হল। ক্যাম্পে মাত্র দু’জন পুলিশ। তারা থানাকে খবর দিতে ব্যস্ত। মাধাইয়ের সঙ্গী একটি ছেলেকে গুলি করল গুন্ডারা।
রেশমি আর বাহা একজনের বাড়ি ঘুরে ফিরছিল। আচমকা ওদিক থেকে দৌড়ে পালাতে গিয়ে খবরটা দিয়ে গেল, বিদ্যুতের বাহিনী তাণ্ডব করছে। রেশমি ভয় পেয়ে গেল। এবার এদিক দিয়ে ফিরবে কী করে? গুলি, বোমার আওয়াজ আসছে। পুলিশের রাহুলবাবুও তো বাইরে। মাওবাদীদের কোমর ভেঙেছে। এখন একতরফা খুনোখুনি করে যাবে বিদ্যুৎরা। মাধাইদের জন্য চিন্তা হল রেশমির।
গোলমালের শব্দটা এগিয়ে আসছে। লোকজন পালাচ্ছে।
‘দিদি, বাইরে থেকো না। এখানে ঢুকে পড়ো।’ ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিমা বললেন। ভীত রেশমি আর বাহা ঢুকে গেল ঝুপড়ি ঘরে।
বাইরে আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। যেন যুদ্ধ চলছে। বাইরে কে যেন ছুটতে ছুটতে বলে গেল, পুলিশ ঢুকেছে, মাওবাদীরাও মারছে।
রেশমিরা বুঝল, তার মানে যাই ঘটুক, একতরফা ঘটছে না।
ঝুপড়ি ঘরের সামনে দিয়ে দৌড়ঝাঁপের শব্দ, টুকরো সংলাপ ছিটকে আসছে।
প্রতিমাকেও মনে হল একটু চঞ্চল। কারও জন্য অপেক্ষা করছেন কি? উঁকিঝুঁকিও মারছেন। গুলি, বোমার আওয়াজ চলছে।
হঠাৎই ঝড়ের বেগে প্রতিমার ঝুপড়িতে ঢুকল একজন। মুখ ঢাকা, শুধু চোখ খোলা, গায়ে জলপাইরঙা জ্যাকেট, হাতে পিস্তল।
এরপর বিস্মিত চোখে রেশমিরা দেখল, ঝুপড়ির ভেতরে যেখানে উনুন, তার পিছনে কিছু জঞ্জাল সরিয়ে একটা আধুনিক বন্দুক বের করে প্রতিমা আগন্তুককে বললেন, ‘এই নাও কমরেড।’
প্রতিমার ঝুপড়িতে থাকত মাওবাদীদের একটা একে ফর্টিসেভেন! রেশমি হতবাক।
মুখোশ পরা আগন্তুক প্রতিমাকে বলল, ‘ভয় নেই। সব ঠিকঠাক। বিদ্যুতের লোকজন শেষ। লোকটা নিজে গ্রামের বাইরে গাড়িতে বসে এসব করাচ্ছিল। কমরেডরা ওকে তুলে নিয়ে উত্তরের জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছে। ওর গল্প আর বেশি বাকি নেই। সমস্যা হল পুলিশ এখন আমাদের পিছনে পড়েছে।’
আগন্তুকের গলার শব্দ আর কথা শুনে রেশমির মাথায় বাজ পড়ছে। এ কে?
আগন্তুক রেশমিকে যেন দেখতেই পাচ্ছে না।
মুহূর্তের মধ্যে ঝুপড়ির বাইরে অনেক বুটের আওয়াজ। মাইকের ঘোষণা, ‘কমরেড ব্রহ্মা, পুলিশ আপনাকে ঘিরে ফেলেছে। আত্মসমর্পণ করুন। না হলে গুলি চলবে। কিষাণজির হাল করে দেব।’
এবার আগন্তুক, মানে কমরেড ব্রহ্মা রেশমিকে বলল, ‘একটু সাহায্য করবেন? অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।’
রেশমির ঘোর কাটেনি। কমরেড ব্রহ্মা এ, অথচ এত কাছে থেকেও চেনা যায়নি?
রেশমি বলল, ‘বলুন কী করতে হবে।’
এরপর মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্র মাটির নিচে লুকোনো হল। মুখ ঢাকা টুপি, জ্যাকেট জঞ্জালের নিচে গেল।
ঝুপড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল রেশমি, বাহা, প্রতিমা আর পোস্টমাস্টার সুমিত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
চারপাশে পুলিশ বাড়ছে। এত বড় ঘটনা আবার, ফোর্স ঢুকছে। তল্লাশি শুরু, কমরেড ব্রহ্মা কোথায়, বিদ্যুৎ কোথায়? পুলিশের ব্যস্ত ছোটাছুটির মধ্যেই ধীরপায়ে হেঁটে রেশমিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চলল পোস্টমাস্টার সুমিত। কিন্তু তার মাথায় ততক্ষণে অন্য চিন্তা ঘুরছে। বিষ্ণু, সুনেত্রা ধরা পড়েছে। পুলিশ তাদের হেফাজতে নিলে তারা মুখ খুলবে না তো? সময় আসছে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘কোথায় ব্রহ্মা? আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি আর পোস্টমাস্টারবাবু একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। গোলমাল শুনে ভয়ে এঁর ঝুপড়িতে ঢুকেছিলাম। দেখে নিন। আর কেউ নেই। কয়েকটা লোক তো সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।’
রেশমি বলল পুলিশকে।
ইন্সপেক্টর কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। চলো জঙ্গলের দিকে।’ পুলিশ ফোর্স দৌড়ল।
সুমিত রেশমিকে বলল, ‘ধন্যবাদ।’ তারপর হালকা রসিকতায় বলল, ‘আমার আবার গোলমাল সহ্য হয় না। আমি একটু ভিতু টাইপ।’
রেশমীর চোখে জল। ধরা গলায় বলল, ‘আমাকে এভাবে বোকা বানালেন কেন? আমি আপনার কোন্ ক্ষতি করেছি? আমি জানলে কি কাউকে বলে দিতাম?’
সুমিত হাসল। বলল, ‘বলা যায় না। সবটা বলতে নেই। আপনি ভিতু সুমিতকেই চিনে রাখুন। কমরেড ব্রহ্মা কখনও সখনও আসে, আসতে হয়, তাকে চিনে রেখে লাভ কী? চলুন ফেরা যাক। আমাদের লোকেরাও অপারেশন শেষে সব ব্যাক করে যাচ্ছে। সিচুয়েশন আন্ডার কনট্রোল। যা দেখলেন, ভুলে যান।’
‘আর বিদ্যুৎ?’ বাহা বলল।
‘কাল সকালে গ্রামের বাইরে ওর ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখা যাবে। যাক, এর বাইরে আর কোনও কথা নয়।’
রেশমি বলল, ‘আমার কিন্তু কিছু কথা বলার আছে।’
সুমিত বলল, ‘পরে সময়মতো শোনা যাবে। চলুন আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসি। মাধাইটা গেল কোথায়, সেটাও দেখতে হবে।’
চারপাশে পুলিশ বাড়ছে। এত বড় ঘটনা আবার, ফোর্স ঢুকছে। তল্লাশি শুরু, কমরেড ব্রহ্মা কোথায়, বিদ্যুৎ কোথায়? পুলিশের ব্যস্ত ছোটাছুটির মধ্যেই ধীরপায়ে হেঁটে রেশমিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চলল পোস্টমাস্টার সুমিত। কিন্তু তার মাথায় ততক্ষণে অন্য চিন্তা ঘুরছে। বিষ্ণু, সুনেত্রা ধরা পড়েছে। পুলিশ তাদের হেফাজতে নিলে তারা মুখ খুলবে না তো? সময় আসছে। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমাজের মধ্যে, সমাজের কাঠামোতেই আত্মগোপন করেছিল থেকে লড়াই যেমন চলছে, তাই চলবে? নাকি, সব ছেড়ে পুরোপুরি জঙ্গলের জীবনে থেকে লড়াই? বাবার সঙ্গে একবার যোগাযোগ করতেই হবে। বাবা অধ্যাপক সমরেশ মাওবাদী বন্দি, এখন সম্ভবত দমদম জেলে আছেন। তিনিও একসময় অধ্যাপনা করতে করতেই সংগঠনে জড়ান। পরে একসময় সব ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে। ছেলেও একই আদর্শে। অধ্যাপকের পরামর্শ ছিল, যতদিন সম্ভব, সিস্টেমের ভেতরে থেকেই কাজ। তারপর সময় এলে সব ছেড়েছুড়ে গরিবের স্বার্থে লড়াই। শ্রেণিশত্রু খতম। সুমিত সিস্টেমের মধ্যে থেকে কাজ করেছে বহুদিন। এবার কি সময় আসছে সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধের?
আর রেশমি? সে কী বলতে চায় সুমিতকে?
কুসুমডিহায় যখন গভীর রাত, তখনও অন্তত দু’জন জেগে। সুমিত আর রেশমি। বাকি যারা জেগে, তারা টহলদার বাহিনী, কমরেড ব্রহ্মাকে ধরতে হবে। পালাতে গেলে গুলি করে মারতে হবে। নির্দেশ এসে গিয়েছে।
( চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৮: নিজেদের তৈরি ফাঁদে নিজেরাই আটকে সুনেত্রা ও বিষ্ণু
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৭: কুসুমডিহার চারপাশে পুলিশি তৎপরতা শিথিল, এই সময়েই আক্রমণ করতে হবে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৬: যদি ওই মহিলা সত্যিই সুনেত্রা হয়, তাহলে অবশেষে তাকে দেখা গিয়েছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৫: ছায়ার মৃত্যুর খবর গেল শঙ্করের কাছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৪: মলিন চেহারার এই মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!