অনেক রাত অবধি জেগে কাজ করি বলে আমি চিরকালই একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ সকালে হঠাৎ আমাদের বাড়ির দরজায় ঘা দিতে থাকে ভেটকি। নিচে তখন থাকত মোস্তাফা। সে দরজা খুলে দিতে ভেটকি উঠোন থেকে চেঁচিয়ে আমায় ডাকতে থাকে। আমি বেরিয়ে এসে দেখি ভেটকি অঝোরে কাঁদছে। ওর মুখেই শুনলাম শক্তিদা আর নেই। সেদিন ভোরবেলা শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়। ভেটকির মুখে সেদিন আমি স্বজন হারানোর যন্ত্রণা দেখেছিলাম। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রাণবন্ত শক্তিদার অসংখ্য স্মৃতি। চলচ্চিত্রের মতো পরপর যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ফেলে আসা দিনের নানা ঘটনা।
২৯.
১৯৭৭ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয় বাংলা কবিতার সে-সময়ের মুকুটবিহীন রাজা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নতুন কবিতার বই– ‘কবিতার তুলো ওড়ে’।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামটা শুনলেই একরাশ স্মৃতি আমাকে ঘিরে ধরে। প্রথমেই মনে পড়ে দে বুক স্টোরের গলি দিয়ে ঈষৎ স্খলিত স্বরে আমার নাম ধরে ডাকতে-ডাকতে তাঁর এগিয়ে আসা। বহুদিন তিনি ‘সুধাংশু, সুধাংশু’ বলে ডাকতে-ডাকতে এই গলি দিয়ে আমাদের দোকানে এসেছেন। পরের দিকে আবার জোরে-জোরে কোনও কবিতার লাইন বলতে-বলতেও এসেছেন আমাদের দে’জ পাবলিশিং-এর কাউন্টারে। সন্ধে গড়িয়ে যাওয়ার পর অনেকবার এমন হয়েছে আমি তাঁকে কলেজ স্ট্রিট থেকে ট্যাক্সি করে ১৯ নম্বর কর্নেল বিশ্বাস রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সেই ট্যাক্সিতেই নিজের বাড়ি ফিরে এসেছি। আসলে মানুষকে ভালোবাসবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল শক্তিদার। তাঁর আবদার ফেলবার কথা আমি ভাবতেও পারতাম না।
শক্তিদার সঙ্গে আমার দুই দাদার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আমার সঙ্গে শক্তিদার প্রথম পরিচয় অবশ্য বিশ্ববাণী প্রকাশনীর ব্রজকিশোর মণ্ডলের দৌলতে। ব্রজদার সঙ্গেও শক্তিদার বেশ বন্ধুত্ব ছিল। বিশ্ববাণী থেকে তাঁর বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্ববাণী-র সূত্রেই সম্ভবত শক্তিদার আমাদের দোকানে আসা-যাওয়া শুরু হয়। একসময় ভারবি প্রকাশনীর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজটিও তিনি দেখতেন বলে শুনেছি। আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ প্রকাশনায় আসার আগে থেকেই।
দে’জ পাবলিশিং শুরু করার পর প্রথম কয়েক বছর তাঁর বই পাইনি। কিন্তু ১৯৭৭ সালে তিনি আমাদের দিলেন একেবারে নতুন কবিতার বই ‘কবিতার তুলো ওড়ে’। এই বইয়ের নাম-কবিতাটা পড়লেই আমার কেমন যেন মনে হয় শক্তিদাকেই দেখতে পাচ্ছি–
‘কবিতার তুলো ওড়ে সারারাত্রি মনের ভিতরে
হাওয়া লেগে
খেলাভোলা শিশু
এক খেলা ফেলে রেখে এ-নতুন উৎক্ষিপ্ত খেলায়
সমর্পণ করে সব– অশ্রুহাসি স্বপ্ন পরিশ্রম
কবিতার তুলো ওড়ে সারারাত্রি মনের ভিতরে
শুধু ওড়ে না শিশু
ছুঁয়ে থাকে মাটির বাস্তব?
কিন্তু তা কী করে হবে…
ও যে নখে বালিশ ছিঁড়েছে!’
এই বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন শক্তিদার আরেক বন্ধু পূর্ণেন্দুদা (পূর্ণেন্দু পত্রী)। পূর্ণেন্দুদার সঙ্গে শক্তিদার আলাপ বোধহয় সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই। পূর্ণেন্দুদা তাঁর বন্ধু সম্পর্কে লিখেছিলেন– “প্রেসিডেন্সির ছাত্র। বই বেরোয়নি কোনও কবিতার। পত্র-পত্রিকায়ও সাড়া তোলেনি তার কবিতা। থাকে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ওপর শ্রীমানী মার্কেটের দোতলার এক প্রান্তের একটা ঘরে। কলেজ পালিয়ে প্রায়ই চলে আসত সে দুপুরের দিকে। পড়ে শোনাত সদ্য-লেখা কবিতাগুচ্ছ। অধিকাংশই সনেট। নিজের চোখে কবিতাগুলো আর-একবার পড়ব বলে একদিন তার হাত থেকে টেনে নিই মোটা এক্সারসাইজ খাতাটা। পাতা ওলটাতেই চমকে উঠি। পর পর তিন-চারটে পাতায় ডিকশনারি ঘেঁটে-ঘেঁটে যত রাজ্যের কঠিন ইংরেজি শব্দ টুকে গেছে সে। পাশে বাংলা মানে। এগুলো কী রে? কেন টুকেছিস এ-সব? লাজুক হেসে শক্তি বললে, ‘শিক্ষিত হতে হবে তো খানিকটা, তাই…”– এরকমই ছিলেন শক্তিদা।
যে-প্রশ্নের যে-উত্তর আর পাঁচটা মানুষ দেবে, শক্তিদা সবসময় তার থেকে অন্য কিছু বলবেন। তবে তাঁর এই অন্যরকম হওয়াটা কিন্তু লোক দেখানোর জন্য নয়। একেবারে স্বতঃফূর্তভাবে ঘটত তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই। তাঁকে আমি কোনওদিন সাংসারিক বিষয়ে কথা বলতে শুনিনি, কিন্তু তাঁর চেনা-পরিচিতদের সুখ-দুঃখের হাঁড়ির খবর তিনি রাখতেন। তখন বোঝা যেত না মানুষটির এই যে কিংবদন্তি-তুল্য বোহেমিয়ান ইমেজ, তা কি আদৌ সত্যি? নইলে তিনি অন্যের এমন খুঁটিনাটি মনে রাখেন কী করে! এত ভালোবাসতেও পারে কোনও মানুষ?
শক্তিদার কথা ভাবতে গেলে আরও অসংখ্য মুখ মনে ভেসে ওঠে, যারা নিজেরা হয়তো লেখকও না, কিন্তু শক্তিদার সঙ্গে অদ্ভুত ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। আমাদের পাড়াতেই তেমন এক ছেলে ছিল ‘ভেটকি’। তার আসল নাম বোধহয় সিদ্ধার্থ দাস। শক্তিদাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসত, অনর্গল তাঁর কবিতা মুখস্থও বলতে পারত। শক্তিদার সঙ্গেই আমাদের দোকানে তার আসা-যাওয়ার শুরু। ভেটকিকে দিনের প্রায় সবসময়েই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখা যেত। কফিহাউসে, প্রেসিডেন্সি কলেজে বা এমনিই বইপাড়ায় ঘুরে বেড়াত সে। চোখে চশমা, গোল মুখ– আত্মভোলা মানুষ ভেটকি। মহাত্মা গান্ধী রোডে তাদের পারিবারিক একটা চশমার দোকান ছিল বলে শুনেছি, কিন্তু তাতে তার এতটুকুও উৎসাহ ছিল বলে মনে হয় না। আমাদের দোকানে সন্ধেবেলা প্রায়ই সে হাজির হত– খানিক নেশাগ্রস্ত, মুখে একটা পান আর কষ দিয়ে পানের পিকের আভাস। দে’জের কাউন্টারের পাশে চুপটি করে বসে থাকত অনেকক্ষণ। তারপর বাড়ি চলে যেত।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার রসায়নও ছিল অন্য কবিদের থেকে আলাদা। তিনি অবশ্য কবিতার বদলে ‘পদ্য’ শব্দটাই ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতাসংগ্রহের নামও তিনি রেখেছিলেন ‘পদ্যসমগ্র’। ১৯৮৩ সালে ‘আজকাল’ পত্রিকায় ‘আমি এখন যা লিখছি’ নামে গদ্যে তিনি লিখেছিলেন–
‘অনেকের মনে যেমন কবিতার পঙ্ক্তি গুনগুনিয়ে ওঠে। একের পর এক, ধাপের পর ধাপ–তেমনটা আমার নয়। শুনেছি বাসে যেতে যেতে বা এমনই হাঁটতে হাঁটতে, বসে-শুয়ে থাকতে থাকতে কবিতার প্রথম লাইন থেকে ধীরে ধীরে, গোটা কবিতাটাই উঠে আসে নির্মাণ হয়ে যায়। আমার কিছুতে হয় না। কোনদিনই হয় না। হয়তো ইচ্ছেটা তেমন নয় বলেই, হয় না। এবং না হতে হতে মরচে পড়ে গেছে। এ অভ্যাসের কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক– সে তর্কে যাচ্ছি না। গিয়ে লাভও নেই। যার যেমন।
আমায় সাদা কাগজের সামনে বসে থাকতে হয়। বসেই থাকতে হয়। কলম নিয়ে কাগজের একপাশে কাটাকুটি খেলি। তারপর সহসা আক্রমণ। সশস্ত্র আক্রমণ। পাহাড় থেকে প্রপাতের মত নেমে আসে পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি সাবলীলভাবে। দূর থেকে কেউ যদি দেখেন, তাহলে ভেবে নেবেন অনায়াসেই যে, এ নির্মাণ নতুন নয়, পুরানো এবং মুখস্থ। পুনর্লিখিত হল মাত্র।
কিন্তু, ঠিক নয়। প্রথমত, পদ্য যা যা কিছু মুখস্থ করার ক্ষমতা আমার একেবারে নেই। সেই ৫৭ থেকে ৮৩ পর্যন্ত পদ্য লিখে মাত্র দু-তিনটিই কণ্ঠস্থ। এ কোনো বাহাদুরি নয়। জাস্ট, আমি পারি না। আমারই অক্ষমতা। অনেকে পারেন। অনেকে টেলিফোন নাম্বার পর্যন্ত গড়গড় করে বলে যেতে পারেন– শ্লথ বা স্থগিত হয়ে নয়, একনিশ্বাসে। তবে, একটি ব্যাপার জাঁক করে বলতে পারি, আমি মানুষের মুখ একবার দেখলে সচরাচর ভুলি না। অনেক সময় নামও। তবে, বার্ধক্য সে ক্ষমতা কাড়ার তালে আছে। অনেকটা সিঁদ কেটেও ফেলেছে ইতিমধ্যে। কাটুক।…’
দে’জ পাবলিশিং থেকে শক্তিদার প্রথম বই অবশ্য ‘কবিতার তুলো ওড়ে’ নয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ছেপেছিলাম ‘পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতা’। চার ফর্মার ক্রাউন সাইজের বইটিতে মোট ২৯টি অনুবাদ কবিতা। এই বইটিতে মলাট তো বটেই, পূর্ণেন্দুদা দুটি পাতা-সহ একটি গোলাপের মোটিফ দিয়ে বইটিকে সাজিয়েছিলেন। অনেক পরে, ১৩৯৫ সালের নববর্ষে (এপ্রিল, ১৯৮৮) আমাদের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজে প্রকাশিত হয় ‘পাবলো নেরুদার শ্রেষ্ঠ কবিতা’।
শক্তিদা ঠিক ঘরে বসে চিঠি লেখার মতো মানুষ ছিলেন না। তাই বিশেষ সমস্যা না থাকলে তিনি একেবারে সামনে এসে কথা বলতেই পছন্দ করতেন। সে-কারণেই আমার সংগ্রহে দেখছি তাঁর চিঠি খুব বেশি নেই। কিন্তু ‘পাবলো নেরুদার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রসঙ্গে একটি চিঠি পাচ্ছি ১১ জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে লেখা–
‘সুধাংশু,
তোমাকে ফোনে কিছুতেই পাচ্ছি না।নেরুদার কিছু পাণ্ডুলিপি পাঠালাম তাপসের হাতে। আরও তৈরি করছি। বইমেলায় বের করার জন্য তাড়া করো না। আস্তে ধীরে বেরুবে।…’
এই বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন অজয় গুপ্ত, আর কবি বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর শিল্পী-বন্ধু ‘দুলুকে’ (পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়)। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লেখেন– “কয়েক বছর আগে পাবলো নেরুদার প্রেমের কবিতাগুলি অনুবাদ করি। সে বই গ্রন্থ হিসেবে বাজারে আছে। প্রেমের একটি বিশিষ্ট গুচ্ছলেখা ছাড়াও আমাদের কবির অসংখ্য ভালো কবিতা নানা গ্রন্থে মুদ্রিত আছে। আমি এবারে সেই সব গ্রন্থ থেকে বাছাই করে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজে তাঁর বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করে দিলাম। এই অনুবাদের কাজে মূল স্প্যানিশ থেকে আমায় সাহায্য করেছেন আমাদের বন্ধু বিক্রমণ নায়ার। তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনুবাদ মূলানুগ করতে গিয়ে প্রকাশনার কিছু দেরি হল।”
প্রসঙ্গত বলে রাখি, ভূমিকায় উল্লিখিত বিক্রমণ নায়ার হলেন ‘দুই ইউরোপের দিনলিপি’ ও ‘পশ্চিম দিগন্তে, প্রদোষকালে’-র লেখক এবং আনন্দবাজার পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক। তিনি শক্তিদার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। ১৯৮৬ সালে দে’জ থেকে প্রকাশিত শক্তিদার ‘হাতি ধরিয়ে নায়ার’ নামে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাসটির নামকরণে বিক্রমণ নায়ারের ভূমিকা কতদূর আমার জানা নেই। শক্তিদা ও মীনাক্ষী বউদির দুই সন্তানের সঙ্গেও বিক্রমণ নায়ারের দারুণ সম্পর্ক ছিল। তাদের নায়ারকাকুই শক্তিদার লেখায় হাতি-ধরিয়ে হিসেবে এসেছেন কি না, তা বলা কঠিন।
১৯৭৭ সালেই দে’জ পাবলিশিং থেকে শক্তিদার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ পুনর্মুদ্রিত হয়। বইটি তার চার বছর আগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ভারবি থেকে। নতুন দে’জ সংস্করণের ভূমিকায় কবি লিখেছিলেন–
‘এই পরিবর্ধিত সংস্করণের ভূমিকা প্রকৃতপক্ষে অবান্তর। প্রথম গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু পদ্য বাদ দিয়ে নতুন অনেকগুলি পদ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। চার বছর আগেকার ভারবি-প্রকাশিত বইটি দে’জ পাবলিশিং বের করতে আগ্রহী হলেন। এই চার বছরে অন্তত আমার দেড় ডজন পদ্যের বই বেরিয়েছে। তাদের কয়েকটির মধ্যে থেকে বেছে কিছু পদ্য, যা আমার মন্দ লাগে না পড়তে, পুনর্মুদ্রিত করা হলো। বেশ কয়েকটি বই থেকে বাছাই করা সম্ভব হলো না, শুধুমাত্র বইয়ের প্রস্থ বেড়ে যাবে, এই ভয়ে। দাম বেড়ে যাবে। পূর্ববর্তী কোনো সংস্করণে প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন শিল্পী প্রকাশ কর্মকার। তিনি এখন কার্যব্যপদেশে এলাহাবাদবাসী। পূর্ণেন্দু পত্রী আমাদের দীর্ঘদিনের কবিবন্ধু। তাঁর দক্ষিণ-বাহু আমাদের বহু প্রচ্ছদপটে। আমার একার, বা আমাদের কোন দুজনের না, বাংলা কবিতার বই তাঁর বর্ণলাঞ্ছন ছাড়া বেরুবার জো নেই।’
কবিতাকে শক্তিদা বলতেন ‘জলজ দর্পণ’, তাঁর নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা সিরিজে যত বই আছে তার মধ্যে শক্তিদার বইটি অন্যতম পাঠক-প্রিয় বই বলা চলে। ২০২৪ পর্যন্ত এই বইটির ৩০টা মুদ্রণ হয়েছে।
১৯৭৯ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছ-খানি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। প্রথমেই পুনর্মুদ্রিত হয় তাঁর প্রবাদপ্রতিম তিনটি কবিতার বই– ‘সোনার মাছি খুন করেছি’, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ এবং ‘অঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল’।
‘সোনার মাছি খুন করেছি’ ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে ভারবি থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন–
“অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের অব্যবহিত পূর্বে ও পরে যে-সব কবিতা লিখেছি এবং যেগুলি এতদিন নানা পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই ছড়িয়েছিলো তা থেকে সাতাশটি এই বইয়ের জন্য বাছাই করা হয়েছে। বলা যায় সবগুলিই সাম্প্রতিককালের রচনা।
আমি পারতপক্ষে, পরিমার্জনা স্বীকার করি না– যেমনভাবে চিত্র ও সংগীতময় পঙ্ক্তি আসে, ঠিক তেমনভাবেই কাগজের উপর বসিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। এই বইয়ের কোনো রচনায় পরিমার্জনার স্পর্শ নেই।
বর্তমান গ্রন্থের নামকরণ শ্রীযুক্ত বিরাম মুখোপাধ্যায়ের। কবিতাগুলি বাছাই করেছেনও তিনি। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করতে ইচ্ছুক নই।”
বিরাম মুখোপধ্যায় আর নাভানা প্রকাশনীর কথা বইপাড়ার সন্ধানী মানুষ আজও ভোলেননি। এককালে নাভানার শোভন-সুন্দর সেইসব বইপত্রে বিরামবাবুর বুড়ো আঙুলের ছাপ ছিল। ‘সোনার মাছি খুন করেছি’ বইটির উৎসর্গের পাতায় লেখা আছে– ‘মীনাক্ষী-কে’। এই মীনাক্ষী যে পরবর্তীকালে কবিপত্নী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, তা বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। শুধু তথ্যের খাতিরে বলে রাখি শক্তিদা আর মীনাক্ষী বউদির বিয়ে হয় ১৯৬৭ সালেরই ১৫ অগাস্ট।
বিয়ের কথা যখন উঠেই গেল, তখন আমার বিয়ের কথাও মনে পড়ে গেল। আমার বিয়ের আগে যদিও শক্তিদার কোনো বই আমি প্রকাশ করিনি, তবু তিনি বিয়েতে এসেছিলেন এবং আমাদের বিয়ের পুস্তিকা ‘শুভাশীর্বাদ’-এ লিখেছিলেন– ‘দীর্ঘদিন একা থেকে আর ভালো লাগে না যেহেতু/ সুধাংশু চলেছে আজ রাজবেশে, সঙ্গে চলে সব/ পাত্রমিত্র সভাসদ, অর্বাচীন, প্রাচীন। পুরীতে/ সেজেছে রাজার কন্যা বধূবেশে, কুমারী সুন্দরী/ রীতা নাম্নী একজনা। সুধাংশু, বন্ধনে পারো নিতে?/সুনিশ্চিত সুখী হবে–আমি এই প্রার্থনা জানাই॥’
‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ বইটি প্রথমবার ১৯৬৯ সালে পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদে অরুণা থেকে বিকাশদা (বিকাশ বাগচী) প্রকাশ করেন। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন পঞ্চাশের বিশিষ্ট কবি সুধেন্দু মল্লিককে। সুধেন্দু মল্লিক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের নাতি। কবিতার পাশাপাশি কর্মজীবনে তিনি প্রথমে অর্থনীতির অধ্যাপনা করেছেন, পরে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছিলেন।
‘অঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল’ প্রথম কোন প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল এখন আর মনে পড়ছে না। তবে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এই বইতে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘ক্যাডিশ’ বই থেকে ছোট্ট একটি অংশও অনূদিত হয়েছে।
১৯৭৯-র ছ’-টি বইয়ের মধ্যে নতুন তিনখানি হল– ‘ভাত নেই, পাথর রয়েছে’, ‘হাইনের প্রেমের কবিতা’ এবং ‘লোরকার কবিতা’। এর মধ্যে ‘লোরকার কবিতা’ বইটি শক্তিদা আর অমিতদার (অমিতাভ দাশগুপ্ত) যৌথ অনুবাদ। তবে শক্তিদার মাত্রই চারটে অনুবাদ এই বইতে আছে, বাকি কবিতাগুলি অমিতদারই অনুবাদ করা।
‘হাইনের প্রেমের কবিতা’গুলো শক্তিদার অসুস্থতার সময়ে অনুবাদ করা। এমনিতেই তিনি বহুবার লিখেছেন, যখন কবিতা আসে না, তখনও কবিতার মধ্যে থাকার জন্য অনুবাদই হল সেরা উপায়। তাঁর নিজের কথায়– ‘আমার ধারাবাহিক পদ্য লেখায় যখন-যেমন ছেদ পড়ে, তখনই এই ধরনের পরের দুয়ারে ধরনা দিই।’ ‘হাইনের প্রেমের কবিতা’-র ভূমিকা-তুল্য গদ্যে কবি লিখেছিলেন– ‘বাংলায় হাইনের অনুবাদ অনেকেই করেছেন। তাঁর গদ্য নয়। গদ্যের অনুবাদ আমার চোখে পড়েনি। আমার ভাষায় তাঁকে ভাষান্তরিত করা খুব কঠিন বলে বোধ হয় না। অনেকেই করেছেন– তার মধ্যে আমার সমসাময়িক বন্ধুবান্ধব আছেন, অগ্রজ কবিরা আছেন। নীলরতন সরকার হাসপাতালের ক্যাবিনে একা-একা তাঁকে পড়ে, ইচ্ছা হয়েছিলো, তার কিছু কবিতা, নিজের মতো করে বাংলায় রূপান্তরিত করি। তাই করেছি।’
হাইনের আত্মধ্বংসী প্রতিভা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্যারিসে গিয়ে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৪৮ থেকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন হাইনে। ১৮৫৬ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আর বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। শারীরিক অসুস্থতায় হাসপাতাল-বন্দি অবস্থায় শক্তিদার অনুবাদ করা বইটির শেষ কবিতাটিও অনবদ্য–
“আমায় ভালোবাসবে, না, তা
ছোট্ট কথা
মুখটি দেখাও, তখন আমি
সাজবো রাজা।
‘ঘেন্না করি’ বললে তোমার
মুখ্খি-মুখে
দাও দিকিনি মুখ বাড়িয়ে–
দিচ্ছি সাজা।”
১৯৮১, ’৮২ এবং ’৮৩ সালে পর পর শক্তিদার তিনটি অনুবাদ-কবিতার বই আমি প্রকাশ করি– ‘১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো কবিতা’, ‘মায়াকোভ্স্কির শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং রাইনার মারিয়া রিলকের ‘দুইনো এলিজি’।
তিনটি বইয়েই শক্তিদার সঙ্গে অনুবাদক হিসেবে ছিলেন মুকুল গুহ। ‘মায়াকোভ্স্কির শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন কবি সিদ্ধেশ্বর সেনও। এই বইটিতে শক্তিদার অনুবাদ বরং কমই আছে– একটাই দীর্ঘ কবিতা ‘জেল পাঠের গান’। শঙ্খদা-র (শঙ্খ ঘোষ) ‘বটপাকুড়ের ফেনা’য় প্রচারবিমুখ, নিবিড় বোধের কবি সিদ্ধেশ্বর সেনের কথা পড়লে হয়তো মানুষটাকে খানিকটা ছোঁয়া যাবে।
সিদ্ধেশ্বর সেন পঞ্চাশের দশক থেকেই মায়াকোভ্স্কি অনুবাদ করেছেন। এই বইয়ের জন্য কিছু নতুন অনুবাদও করে দিয়েছিলেন। আর, মুকুল গুহ ছিলেন সাংবাদিক ও কবি– ‘কলেজ স্ট্রীট’ পত্রিকার সঙ্গে শুরুর দিন থেকে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ‘বাংলা প্রকাশনার সেকাল ও একাল’ বইটি। অনুবাদ-কবিতায় তিনি পরিচিত নাম। তাঁর নিজস্ব কবিতার বইও আছে বেশ কিছু। আমিও ১৯৯৩ সালে মুকুল গুহ-র ‘শব্দদূষণ’ নামে একটি কবিতাবই ছেপেছিলাম।
সজ্জন, অমায়িক মুকুলদার সঙ্গে শক্তিদার সূত্রেই আমার আলাপ হয়। তাঁদের দু’জনের যৌথ অনুবাদ-গ্রন্থ রাইনার মারিয়া রিলকের ‘দুইনো এলিজি’-তে কিন্তু দুই অনুবাদকের সমান-সমান অনুবাদ আছে। এই বইটির ভূমিকা-গদ্য, ‘দু-কথায়’, দুই অনুবাদকের নাম দিয়ে ছাপা হয়েছে– ‘আমাদের দুজনের কেউই জর্মন জানি না। তবে, লাইশমানের ইংরিজি-রিলকে প্রায় জর্মন-রিলকের মতই। বাংলাতে রিলকেকে আনা প্রায় অবাস্তব। করলাম, যেহেতু, ভালোবাসি। যেহেতু, ভয় করি। আমাদের বন্ধু বিক্রমণ নায়ারের কিছু সাহায্য নিয়েছি– জর্মন ভাষা ও সাহিত্যখাতে রিলকের কবিতা বাংলায় আনতে যদি পুনরপি পরিশ্রম দরকার হয়, বারংবার করব। একই কবিতা ফিরে-ফিরে, বারবার। ভুলত্রুটি কিছু থাকলে, তা অশিক্ষার জন্যেই, ইচ্ছাকৃত নয়।’
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু-কে। যাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল অনুবাদ-কবিতা। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে কালিদাস, বোদলেয়র, হেল্ডার্লিন, রিলকে না-পড়লে বাংলা অনুবাদ-সাহিত্যের অনেকটাই অজানা থেকে যায়। সেই সঙ্গে ওই সব কবি ও তাঁদের কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেবের গদ্যও বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় সম্পদ। শক্তিদার সঙ্গে বুদ্ধদেবের বহুকালের সম্পর্ক। এই উৎসর্গ এক অর্থে গুরুর কাছে ঋণ স্বীকার বলেও আমার মনে হয়।
১৩৮৩-র ‘দেশ’ সাহিত্য সংখ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘গদ্যের গার্হস্থ্যে’ নামে লেখাটিতে তিনি লিখেছেন– “বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় একটা বদখৎ সনেট লিখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে, আমার পদ্যজীবনের প্রথম জিনিস ওটা। নাম ‘যম’। মোদ্দা ব্যাপার যম কালো, আমার প্রণয়িনী, তিনিও কালো। যম সকলের মৃত্যুর, আমার তিনি, আমার মৃত্যুর। এই ব্যাপার। বুদ্ধদেব সঙ্গে-সঙ্গে চিঠি দিলেন। দুটি শব্দ বদল করলে ছাপতে পারেন। কীভাবে বদলাতে হবে তিনি জানালেন। আমি মেনে নেওয়ামাত্র ছাপা হলো। এবং তারপর, যতোদিন ‘কবিতা’ জীবিত ছিলো এবং তিনি আমাদের কাছে ছিলেন, কখনো হাড়াছাড়ি হয়নি। তিনিই প্রথম অগ্রজ কবি যাঁর সঙ্গে আমাদের অনেকের গভীর সখ্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে আদেশ করলেন। তুলনামূলক সাহিত্য নতুন খোলা হয়েছে। বললাম, স্যার পয়সা? সে ভাবনা আমার। তিনি একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করলেন, আর আমি বইপত্তর না কিনে সেই পয়সায় মাসের প্রথমভাগে কটা দিন শুধু বীয়র ভোগ করে চললাম। কেলাশ করতেও যেতাম সেই অবস্থায়। তিনি রিলকে পড়াতেন। ছোট দলে প্রায় মনে-মনেই পড়াতে ভালোবাসতেন। আমি তাঁর সঙ্গে রিলকের দূরূহ নিঃসঙ্গতায় ডুবে যেতাম। আমার প্রতি তাঁর সামান্য প্রশ্রয় ছিলো। সেই অধিকারে অবিবেচক আমি, তাঁকে যখন-তখন বিরক্ত করে ফেলেছি। মনে আছে, একদিন রাত তখন দুটোর বেশি, কোথা থেকে ঠিক মনে পড়ছে না, তাঁকে ফোন করি। বলি, স্যার এক্ষুনি আপনার কাছে যাচ্ছি। ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমার অবস্থাটা ঠাহর করে বারংবার অনুরোধ, দোহাই শক্তি, আজ নয়, এক্কেবারেই না, আমি ভীষণ ক্লান্ত, কাল সকালেই চলে এসো। সারাদিন গল্প করা যাবে। কী, আসছো তো তাই? আমি নাছোড়বান্দা। একসময় নিজেই বুঝতে পারি– ব্যাপারটা কুচ্ছিত হয়ে গেছে। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে রিসিভার নামাই। যথারীতি পরদিন যাওয়া হয়নি। সে রাতে তাঁর বিশ্রামও হয়নি একতিল। দেখা হলে বলেছিলেন, জানো, সেদিন তুমি যদি চলে আসতে মন্দ হতো না। আসলে, কীভাবে আসবে? এই ভেবেই তোমায় বারণ করেছিলাম।”
২১ ডিসেম্বর ১৮৮৪ সালে আমাকে লেখা ছোট্ট একটা চিঠিতে দেখছি শক্তিদা লিখছেন–
‘সুধাংশু,
কবিতার বই-এর কিছু আলগা কভার যদি দিতে পারো Exhibition-এ লাগবে। ১৬ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি প্রদর্শনী ও কবিতা উৎসব চলবে।’
চিঠিটা তিনি লিখেছিলেন ‘আবৃত্তিলোক’ সংস্থার প্যাডে। নিচে দেখছি আমি মন্তব্য করেছি ‘শুধু কবিতার বইয়ের কাভার চাই’। এখন আর স্পষ্ট মনে নেই, তবে কবিতা বইয়ের মলাট পাঠিয়েছিলাম বলেই মনে হচ্ছে।
১৯৯৬-এর বইমেলা থেকে ১৯৯৭-এর নভেম্বরের মধ্যে দে’জ পাবলিশিং থেকে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘গদ্যসংগ্রহ’। এই বইটির সময় মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বউদির উদ্যোগ ছাড়া চার খণ্ড বই প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। চারটি খণ্ডের মধ্যে প্রথম খণ্ডের উপশিরোনাম ছিল ‘নিরুপমের আখ্যান’। নিরুপম শক্তিদার উপন্যাসে বারবার ফিরে আসা চরিত্র। এই খণ্ডে আছে– ‘কুয়োতলা’, ‘অবনী বাড়ি আছো’, ‘নিরুপম একাকী’, ‘হৃদয়পুর’, ‘আমি চলে যাচ্ছি’, ‘দাঁড়াবার জায়গা’ এবং ‘বিবি-কাহিনী’। দ্বিতীয় খণ্ড ‘অখ্যানবিচিত্রা’-তে আছে– ‘লুসি আর্মানীর হৃদয় রহস্য’, ‘হাই সোসাইটি’, ‘কিন্নর কিন্নরী’, ‘নিরুপমা একাকী’র সঙ্গে ২৩টি গল্প এবং প্রথম জীবনে রূপচাঁদ পক্ষী ছদ্মনামে রচিত চারটি গদ্যলেখা। গদ্যসংগ্রহের চতুর্থ খণ্ড হল ‘ভ্রমণবিচিত্রা’ যাতে আছে– ‘উইক এণ্ড’, ‘চলো বেড়িয়ে আসি’ (দু-খণ্ড), ‘রূপকথার কলকাতা’ এবং ‘জঙ্গলে পাহাড়ে’। চতুর্থ খণ্ডটিতে আছে কিশোর সাহিত্য ও অগ্রন্থিত রচনা।
১৯৯৮ সালে দে’জ পাবলিশিং থেকে বউদির উদ্যোগেই দু’-মাসের মধ্যে শক্তিদার তিনটি অনুবাদ-কবিতার বই পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম– ‘গালিবের কবিতা’, ‘কুমারসম্ভব কাব্য’ এবং ‘ওমর খৈয়ামের রুবাই’। এর মধ্যে ‘গালিবের কবিতা’য় সহ-অনুবাদক ছিলেন আয়ান রশীদ– শক্তিদার কবিতাপ্রেমী বন্ধু এবং আইপিএস আয়ান রশীদ খান। একসময় তিনি রাজ্য পুলিশের ডিজি-ও হয়েছিলেন।
ওমর খৈয়ামের রুবাইগুলির অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছিল মীনাক্ষী বউদি এবং রুচিরা শ্যামের পত্রিকা ‘সখী সংবাদ’-এ। এ-বইয়ের প্রথম রুবাইটি একবার পড়লে আর ভোলা যায় না– ‘যৎসামান্য শুকনো রুটি, পাত্রভরা প্রাণমদিরা/ পদ্যমাখা পুস্তিকাটির সঙ্গে তুমি সই রুচিরা/ আর কী থাকে জবরদস্ত; কুঞ্জবনে মত্ত হাতির?/এই বিজনের গান করেছে স্বর্গ– মিছে দিবসরাতির।’ বইটি তিনি উৎসর্গও করেছেন রুচিরা শ্যামকে।
শক্তিদাকে নিয়ে সমরজিৎ ও ইনা সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘শক্তির কাছাকাছি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬-এর বইমেলার সময়। আর ১৯৯৭-এর ২৫ নভেম্বর শক্তিদার জন্মদিনে প্রকাশ করেছিলাম দেবতোষ বসুর সম্পাদনায় সাক্ষাৎকার ও প্রকীর্ণ গদ্য রচনার সংকলন– ‘এই কাব্য এই হাতছানি’।
অনেক রাত অবধি জেগে কাজ করি বলে আমি চিরকালই একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ সকালে হঠাৎ আমাদের বাড়ির দরজায় ঘা দিতে থাকে ভেটকি। নিচে তখন থাকত মোস্তাফা। সে দরজা খুলে দিতে ভেটকি উঠোন থেকে চেঁচিয়ে আমায় ডাকতে থাকে। আমি বেরিয়ে এসে দেখি ভেটকি অঝোরে কাঁদছে। ওর মুখেই শুনলাম শক্তিদা আর নেই। সেদিন ভোরবেলা শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়। ভেটকির মুখে সেদিন আমি স্বজন হারানোর যন্ত্রণা দেখেছিলাম। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রাণবন্ত শক্তিদার অসংখ্য স্মৃতি। চলচ্চিত্রের মতো পরপর যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ফেলে আসা দিনের নানা ঘটনা।
শক্তিদার প্রয়াণের পর বহু মানুষের লেখা নানা কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ২৬ মার্চ আজকালে প্রকাশিত শঙ্খদার ছোট্ট একটা লেখা অবিস্মরণীয়। শক্তিদাকে নিয়ে ‘কবি ও কাঙাল’ নামের লেখাটিতে শঙ্খদা বলেছিলেন– ‘কবি ও কাঙাল– একটা কবিতায় লিখেছিল শক্তি। সত্যিই সে ছিল আদ্যন্ত কবি আর আদ্যন্ত কাঙাল। ভালোবাসার কবি আর ভালোবাসার কাঙাল। এত বেশি জীবনের কবিতা লেখেনি আর কেউ। এত বেশি মৃত্যুরও কবিতা কেউ লেখেনি আর কখনো। জীবন মৃত্যুতে মেলানো এই কবি জীবনকালেই ছিল এক কিংবদন্তি– বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন কোনো কিংবদন্তি দেখা গেছে বলে তো মনে হয় না। বেঁচে ছিল কবির মতো, মৃত্যুও তার কবির মতো। আমাদের গর্ব শুধু এই যে আমরাও তাকে ভালোবেসেছিলাম। এত ভালোবাসা সর্বস্তরের সব মানুষের এত সর্বাঙ্গীন ভালোবাসা সেও বুঝি আর পায়নি কেউ কখনো। শক্তি কি কখনও মরতে পারে?’
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
……………………ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব…………………
পর্ব ২৮।পিঁপড়ে কালিতে চুবিয়ে সাদা পাতায় ছাড়া হয়েছে, এমন পাণ্ডুলিপি ছিল বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের!
পর্ব ২৭। নিজস্ব ঈশ্বরভাবনা থাকলেও শঙ্কু মহারাজের লেখার মূল বিষয় ছিল মানুষের আলো-আঁধারি জীবন
পর্ব ২৬। বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও একুশে বইমেলায় কখনও স্টল পাইনি
পর্ব ২৫। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুহূর্তের রক্ত-ঘাম-হাসি-কান্নার এক জীবন্ত দলিলচিত্র ছেপেছিলাম
পর্ব ২৪। রাখাল ছেলে যেমন বাঁশি বাজায়, আমিও তেমন নিজের খুশিতে লিখি, বলেছিলেন যাযাবর
পর্ব ২৩। রয়্যালটি-মুক্ত বইয়ের ওপর প্রকাশকদের ঝোঁক চোখে পড়ছে বইমেলাতেও
পর্ব ২২: শেষমেশ রেগে গিয়ে আমাকে চিঠিই লিখে ফেলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ!
পর্ব ২১: ৩০০০ কপি বিক্রির মতো জীবিত বা মৃত লেখক আর হয়তো নেই
পর্ব ২০: কম বয়সে আমাদের রোববারের আড্ডা ছিল ২৮ নম্বর প্রতাপাদিত্য রোড, আশুদার বাড়িতে
পর্ব ১৯: ‘লেখা বড় হচ্ছে’ অভিযোগ আসায় খুদে হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপি দিতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী
পর্ব ১৮: দু’বছরের মধ্যে সংস্করণ না ফুরলে অন্য জায়গায় বই ছাপার চুক্তি ছিল শরদিন্দুর চিঠিতে
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম