Robbar

লোকখেলার মধ্যে মিশে রয়েছে হাজার বছরের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 3, 2025 8:53 pm
  • Updated:December 3, 2025 8:53 pm  

পাণিনি, বাৎসায়ন, বৌদ্ধ সাহিত্য তথা জাতকে এবং সংস্কৃত সাহিত্যে ‘অনুক্রীড়া’, ‘পরিক্রীড়া’, ‘সংক্রীড়া’ ইত্যাদি খেলার পারিভাষিক শব্দের পাশাপাশি পাশাখেলা, দাবাখেলা, আম্রভাঞ্জিকা, ইক্ষুভাঞ্জিকা, উদক খেড়িকা, মাদারি খেল, বাঁশবাজি প্রভৃতি লোকখেলার কথা জানা যায়। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যেও অসংখ্য লোকখেলার নাম পাওয়া যায়– গুলি-ডাণ্ডা, ধুলোখেলা, ভেঁটাখেলা, তিনাতা, ইড়িক, পুতুলখেলা ইত্যাদি। এইসকল খেলার মধ্যে অনেকগুলি বর্তমানে লুপ্ত হয়ে গেছে।

স্বপনকুমার ঠাকুর

১২.

শহরের তুলনায়, খেলাধুলো, বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী লোকখেলাগুলি একসময় গ্রামগঞ্জে অতি পরিচিত দৃশ্য ছিল। ছোট ছেলেমেয়েরা দুপুরে-বিকেলে লুকোচুরি, ভুসরে ভুস, গোল্লাছুট, কিতকিত, ভু রে ভু, খেঁটে খেলা, কানামাছি, জল-ডিঙাডিঙি, নুনদারী, মারবেল, ভেঁটা, গুলিডান্ডা এমন কত খেলায় মাতিয়ে তুলত বাড়ির উঠোন কিংবা ফাঁকা এক চিলতে স্থান। 

মেয়েরা খেলত পুতুল, জোগাড় করত মা-দিদিদের হরেক প্রকার রঙিন কাপড়ের টুকরো, কাঁচের চুড়ি ভাঙা। মাটির তৈরি পালকি, খেলনা কড়াই-হাঁড়ি আর ধুলো-বালি-কাদা, ইঁট, খোলামকুচি, বুনোপাতায় জমে উঠত কান্না-হাসির খেলাপাতুনির (পুতুলখেলা) সংসার। কিন্তু ইদানীং গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারে দ্রুত স্থান দখল করছে ভিডিও গেম বা নানা ধরনের খেলার গ্যাজেট।

পুতুলখেলার দোকানদারি

শহরাঞ্চলে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানাচ্ছে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের ভিডিও গেমে আসক্তি এখন মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। খেলাধুলোর মাধ্যমে শিশুদের দৈহিক পুষ্টি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, সামাজিকতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতার মতো যে সামাজিক গুণাবলির বিকাশ হয়, তার বদলে জন্ম নিচ্ছে একাকীত্ব, সহিংসতা, উত্তেজনা, অকাল যৌনতা ইত্যাদি। তবু এর মধ্যে আশার আলো হল আমাদের রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার সিলেবাসে কিতকিত, কানামাছি ইত্যাদি লৌকিক খেলাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

বিশ্ব সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান ঐতিহ্যবাহী লোকখেলা। বঙ্গসংস্কৃতিও তার ব্যতিক্রম নয়। ঐতিহ্যবাহী লোকখেলাগুলি অতীত থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ধারাবাহিকভাবে সাংস্কৃতিক সম্পদ রূপে চলে আসছে। কিন্তু পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিস্তার, মূল্যবোধের পরিবর্তন ইত্যাদি নানা কারণে অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষ তথা দুই বাংলায় সাম্প্রতিক কালে ঐতিহ্যবাহী লোকখেলাগুলি লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। 

কানামাছি খেলা

অথচ খেলাগুলির সঙ্গে শুধুমাত্র অবসর বিনোদনের নির্ভেজাল আনন্দ নয়, জড়িয়ে রয়েছে শিশুশিক্ষার বুনিয়াদ, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি ইত্যাদি বহুবিধ বর্ণময় প্রেক্ষিত। ঐতিহ্যবাহী লোকখেলার মধ্যে নিহিত আছে আমাদের শত শত বছরের যাপনের বৈচিত্রময় লোক-ইতিহাস।

ক্রীড়া-গবেষকদের মতে সংস্কৃতির অনেক রূপ বা উপাদান এসেছে ঐতিহ্যবাহী লোকখেলা থেকে। তাঁদের মতে, সভ্যতা বা সংস্কৃতির থেকেও খেলাধুলো আরও প্রাচীন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ভারতবর্ষের প্রচলিত মূর্তি-ভাস্কর্য বা স্থাপত্যের অন্যতম মোটিফ হল ‘শালভঞ্জিকা’। বিশেষজ্ঞদের মতে, আদিতে এটি ছিল মেয়েদের উদ্যান-ক্রীড়ার অঙ্গ। ঐতিহ্যবাহী লোকখেলাগুলির ধারক ও বাহক যুবক-যুবতী, এমনকী গ্রামীণ বয়স্ক মানুষ হলেও, মূল ধারাটি অতীত থেকে বহন করে নিয়ে আসছে আমাদের রঙিন শৈশব তথা কিশোর-কিশোরীরা।

হিন্দু শালভঞ্জিকার মোটিফ, মথুরা

খেলাধুলো হল শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি। ন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েসন ফর দ্য এডুকেশন অফ ইয়ং চিলড্রেন (NAEYC) দাবি করেছে– শিশুশিক্ষায় সর্বাপেক্ষা কার্যকরী মাধ্যম হল খেলাধুলা। মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন ১৯৮৯ সালে খেলাধুলাকে শিশুর মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দান করেছে।

তবে একেবারে লোকখেলার জগৎ মিলিয়ে গেছে এমন কথা অতিশয়োক্তি। বিশেষ করে লোকখেলা আজও টিকে রয়েছে গ্রামের নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখা যায়, গ্রামগঞ্জের নিম্নমধ্যবিত্ত বা প্রান্তীয় লোকসমাজের অন্তর্গত ছেলেপুলেরা অবসর বিনোদনে নানা ধরনের লোকখেলায় ভরিয়ে তোলে তাদের মাটির বাড়ির উঠোনখানি। 

লৌকিক খেলাকে সংশ্লিষ্ট জাতির সাংস্কৃতিক সম্পদ বলা হয়। শিশুর সার্বিক বিকাশে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাগুলি শিশু-কিশোর পরম্পরায় এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, অতীত থেকে বর্তমানে চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। লোকখেলায় কোনও খরচসাপেক্ষ সাজসরঞ্জাম লাগে না। শারীরিক কসরৎ, হাত-চোখের সমন্বয়, সুসম টিমওয়ার্ক, বিনোদন, শিশুর স্বাধীনতা, সর্বোপরি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবোধ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে।

লাউকাটাকাটি খেলা

দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাসের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে ঐতিহ্যপূর্ণ খেলাগুলি। নানা ধরনের লৌকিক খেলাধুলোর কথা জানা যায় প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে। বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত ‘শমন’ উৎসবকে অনেকেই অলিম্পিকের মতো বর্ণাঢ্য ক্রীড়া-উৎসব বলেছেন।

পাণিনি, বাৎসায়ন, বৌদ্ধ সাহিত্য তথা জাতকে এবং সংস্কৃত সাহিত্যে ‘অনুক্রীড়া’, ‘পরিক্রীড়া’, ‘সংক্রীড়া’ ইত্যাদি খেলার পারিভাষিক শব্দের পাশাপাশি পাশাখেলা, দাবাখেলা, আম্রভাঞ্জিকা, ইক্ষুভাঞ্জিকা, উদক খেড়িকা, মাদারি খেল, বাঁশবাজি প্রভৃতি লোকখেলার কথা জানা যায়। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যেও অসংখ্য লোকখেলার নাম পাওয়া যায়– গুলি-ডাণ্ডা, ধুলোখেলা, ভেঁটাখেলা, তিনাতা, ইড়িক, পুতুলখেলা ইত্যাদি। এইসকল খেলার মধ্যে অনেকগুলি বর্তমানে লুপ্ত হয়ে গেছে।

ডাঙার খেলা লাঙলচষা

আমাদের সমাজে প্রচলিত নানা উৎসব-প্রথার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে খেলার মতো বিচিত্র ক্রিয়াত্মক অনুষ্ঠান, যেগুলি লোকমুখে খেলা নামেই পরিচিত। এর মধ্যে পড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে বরবধূর কড়ি খেলা বা সুতো খেলা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে লাঠিখেলা ইত্যাদি। তবে বর্তমানে ‘খেলা’ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট অর্থ আছে। খেলা বিনোদনমূলক ক্রিয়াত্মক বিষয় হলেও, বিশেষ নিয়ম-নীতি যুক্ত, এবং জয়-পরাজয়সূচক অনুষ্ঠান– যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এগুলিকেই বলা হয় ‘শিষ্টখেলা’। 

শিষ্টখেলার জন্ম লোকখেলা থেকে। যেমন হাডুডু থেকেই কবাডি খেলার উদ্ভব হয়েছে। ফোক ফুটবল থেকে আধুনিক ফুটবল খেলার জন্ম। অনেকেই বলেন ড্যাংগুলি থেকেই ক্রিকেট খেলার সূচনা। লোকখেলাতেও নিয়ম-নীতি এবং জয়-পরাজয়ের বিষয়টি থাকে। সেগুলি আরও বৈচিত্রময় হলেও চরিত্রগত দিক থেকে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত।

ডাংগুলি

আনন্দ-বিনোদন খেলার মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলেও হাজার হাজার বছরের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিকে প্রকাশ করার স্বভাবগত তাগাদা খেলার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। অনেক সময় গোষ্ঠী বা জাতির ঐতিহ্য প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে। লোকখেলার ভুবন এককথায় জল-স্থল-অন্তরীক্ষ জুড়ে বিস্তৃত। কিছু লোকখেলা স্থলে, অর্থাৎ বাড়ির আনাচে-কানাচে, মাঠে-উঠোনে হয়– ড্যাংগুলি, মার্বেল, সাতকটিং, এলাটিং-বেলাটিং, আঙ্গাআঙ্গা, বাঘবন্দি ইত্যাদি। কিছু খেলা হয় জলে– জলডুবোডুবি, নানা ধরনের সাঁতার, পুকুরে ডুব দিয়ে মাটি তোলা ইত্যাদি। আবার আকাশের খেলা বলতে বোঝায় ঘুড়ি ওড়ানো, পায়রা ওড়ানো ইত্যাদি। ঝোল-ঝাঁপ্পির মতো গাছের খেলাও রয়েছে। মধ্যযুগে খেলাটির নাম ছিল ‘ঝালি’ খেলা। এমন অনেক খেলা আছে, যেগুলি আউটডোরের হলেও বাড়ির উঠোনে বা খামারবাড়িতে খেলা যায়। যেমন– কিতকিত, কুমিরডাঙা, লাল্টুর-ভাই-পল্টু ইত্যাদি। আবার কতগুলি ইনডোর গেম– পুতুলখেলা, চুড়িখেলা, কানদোলাদুলি ইত্যাদি। 

বাঘবন্দি খেলার ছক

নুনগাদি, খেঁটেখেলা, গোল্লাখেলা, খো-খো ইত্যাদি কিছু খেলার জন্য চাই ধানকাটা জমি বা খোলা মাঠ। আবার কিছু খেলা রয়েছে মূলত বোর্ডের– লুডো, বাঘবন্দি, সাতগাবু ইত্যাদি। বোর্ডের ছক অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাটিতে চক দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়। 

লোকখেলা যেন শিশু-কিশোর-কিশোরীদের বিচিত্র বোধের ভুবন। সেই ভুবনে যেমন গাছপালা জল-জঙ্গল আকাশ উন্মুক্ত মাঠ আছে, তেমনই জীবজন্তু– বিশেষ করে বাঘ, ছাগল, শিয়াল ছাড়াও পাখি, সাপ, কুমির, ইঁদুর ব্যাঙ, রাজারানি, কানামাছি, চোর-ডাকাত, পুলিশ, দারোগা, বুড়ি, হাড়ি, মুচি সকলেই স্থান পেয়েছে। লোকখেলা, লোকভাষা তথা আঞ্চলিক শব্দাবলির ভাণ্ডার। খেলার উপকরণ সামান্য– ধুলো, বালি, কাদা, কাঁইবিচি, ঘটিং, কড়ি, লাটু, খোলামকুচি, রাখালের পাঁচন, কাঠিকুটি, লোহার টুকরো, সুতো, বুনো লতাপাতা, ফলের বিচি, মার্বেল, ভেঁটা ইত্যাদি। 

জলের খেলা মাছ মাছ

খেলার নিয়মকানুন যেখানে যেমন, সেখানে তেমনভাবে গড়ে উঠেছে; তবে আন্তঃশৃঙ্খলাটি বজায় আছে। অঞ্চলভেদে খেলার সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। লোকখেলায় কোনও রেফারি বা আম্পায়ারের ভূমিকা নেই। নিজেরাই খেলা করে নির্দিষ্ট নিয়মশৃঙ্খলা মেনে। গণতান্ত্রিক চেতনার শুভ উন্মোচন ঘটাতে সাহায্য করে ঐতিহ্যবাহী লোকখেলাগুলি।

………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..

পর্ব ১১: অঘ্রানের নবান্ন মূলত নববর্ষেরই উৎসব ছিল

পর্ব ১০: বারবণিতাদের আরাধনার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল কাটোয়ার কার্তিক লড়াই

পর্ব ৯: শিশুঘাতক থেকে কেন শিশুরক্ষক দেবতা হয়ে উঠলেন কার্তিক?

পর্ব ৮: তেনাদের পুজো, তেনাদের মেলা-মোচ্ছব

পর্ব ৭: প্রেত মানেই ভূত বা অতীত, কিন্তু সকল প্রেতই ভূত নয়!

পর্ব ৬: কেবল কালী নন, লৌকিক লক্ষ্মী ঠাকরুনও দাঁড়ান স্বামী নারায়ণের বুকে পা রেখেই

পর্ব ৫: মহিষাসুরমর্দিনী নন, কৃষিপ্রধান বাংলায় আদিপূজিতা ছিলেন শস্যদেবী নবপত্রিকা

পর্ব ৪: পুকুরের দেবতা পুকুরের ভূত

পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস

পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর

পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প