বিদেশের হোমরা-চোমরা কমিউনিস্ট নেতারা এদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অতিথি হয়ে পার্টির যে সমস্ত অতিথিশালায় উঠতেন, সেখানেও থাকা-খাওয়ার এরকম অঢেল ব্যবস্থা দেখতে পেয়েছি। তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে ফলমূল এবং ভালোমন্দ খাবার-দাবারে ঠাঁসা ফ্রিজও থাকত। এমন সমস্ত খাদ্যবস্তুও থাকত যা বাজারে সহজলভ্য নয়– এমনকী আদৌ লভ্য নয়।
৩৪.
আমজনতা ও বিশেষ সুবিধাভোগী
এক সময় সংবাদমাধ্যমে না হলেও আমাদের দেশের কমরেডদের মুখে মুখে ওদেশের হাসপাতাল সম্পর্কে তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু পরে এখানে আসার পর বুঝতে পারলাম যে হাসপাতালের কথা তাঁরা বলছেন তা সোভিয়েতের আমজনতার হাসপাতাল নয়। সেটার অবস্থানও শহরের কেন্দ্রস্থলে বা কোন প্রকাশ্য স্থানে নয়, শহরের একপ্রান্তে– সাধারণের নাগালের বাইরে। কোনও গাইডবুকে তার উল্লেখ নেই। লোকের মুখে পার্টি হাসপাতাল নামে পরিচিত– অবশ্য যে কোনও পার্টি-সদস্যের জন্য নয়, সেখানে ভর্তি হতে গেলে পার্টির অনেক ওপর মহলের লোক হতে হয়, এছাড়া বিদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির সদস্যরাও তাদের দেশের পার্টির ওপরমহলের সুপারিশে সেখানে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হতে পারেন। এই হাসপাতালে রোগীকে দেখতে গেলেও আগে থাকতে অনুমতিপত্র জোগাড় করতে হয়। আমাদের দেশের দু’-একজন চিকিৎসাধীন পার্টি সদস্যকে দেখতে গিয়ে এই হাসপাতালের সুব্যবস্থার যে প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছি, তা বাস্তবিকই মুগ্ধ হওয়ার মতো। যেমন ভেতরে তেমনই বাইরেও সব কিছু ঝকঝকে তকতকে। পাঁচতারা হোটেলের মতো সাজানো গোছানো সব কেবিন, মেঝেতে কার্পেট পাতা, ট্রলি করে কেবিনে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা, টেবিলে সাজানো ফলমূল, অত্যাধুনিক চিকিৎসার সরঞ্জাম– কী-না আছে? বাইরের বিশাল চত্বরে তরুবীথি আর ফুলের কেয়ারি, তারই মাঝে মাঝে মাথার ওপর ছাউনি দিয়ে তলায় চেয়ার টেবিল পাতা– বনভোজনের আদর্শ জায়গা। গ্রীষ্মকালে রোগীদের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাদের সঙ্গে নিয়ে এই রকমই চেয়ার টেবিলে বসে বাড়ি থেকে আনা খাবার ও পানীয়ের সদ্ব্যবহার করতে করতে দিব্যি আড্ডাও দিয়ে এসেছি।
বিদেশের হোমরা-চোমরা কমিউনিস্ট নেতারা এদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অতিথি হয়ে পার্টির যে সমস্ত অতিথিশালায় উঠতেন, সেখানেও থাকা-খাওয়ার এরকম অঢেল ব্যবস্থা দেখতে পেয়েছি। তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে ফলমূল এবং ভালোমন্দ খাবার-দাবারে ঠাঁসা ফ্রিজও থাকত। এমন সমস্ত খাদ্যবস্তুও থাকত যা বাজারে সহজলভ্য নয়– এমনকী আদৌ লভ্য নয়। বাজারে ভেটকি মাছ দুষ্প্রাপ্য হলেও এখানে ভেটকি ফ্রাই সহজেই পাওয়া যেত। আমাদের সহকর্মী দ্বিজেনদা তাই ভেটকি মাছের নামই দিয়েছিলেন ‘পার্টি ফিশ’।
এসব হোটেল বা অতিথিশালার নাম-ঠিকানা বা উল্লেখ কোনও গাইড বুকে নেই। একবার এরকম একটা হোটেল খুঁজে বের করতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। নির্দিষ্ট মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে অনুসন্ধান বিভাগে খোঁজ করতে গিয়ে বেকুব– অনুসন্ধান বিভাগের কর্মীর বলে দিলেন, ওরকম কোনও হোটেল সম্পর্কে কোনও তথ্য তাঁদের জানা নেই। কিছুক্ষণ এলোপাথালি খোঁজাখুঁজির পর দেখা গেল সেটা মেট্রো স্টেশন থেকে মাত্র হাত কয়েক দূরে।
এছাড়া পার্টির বিশেষ শপও ছিল। সেখানেও যেসব সামগ্রী মিলত, তা বাজারে দুষ্প্রাপ্য, অথচ দামেও সস্তা। মস্কোতে বসবাসকারী আমাদের দেশের অনেকেই দেশ থেকে আগত পার্টি কমরেডদের দিয়ে সেসব দোকান থেকে দামি দামি জিনিসপত্র কিনেও নিতেন, বিদেশি কমরেডদের সঙ্গে স্থানীয় যে সমস্ত দোভাষী থাকতেন, তাঁরাও তাঁদের ধরে সেই সুবিধা আদায় করে নিতেন।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিশেষ সুবিধাভোগী সম্প্রদায়! চোখ বুজে এটুকু মেনে নিলে সোভিয়েত সমাজব্যবস্থায় আর সব কিছুই ভালো ছিল। সাধারণের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য-পরিষেবা, ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন পরিষেবা থেকে শুরু করে সর্বস্তরে অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি, সকলের জন্য বাসস্থান ও কর্মসংস্থান– এগুলিকে সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার বড় রকমের সিদ্ধি বলে স্বীকার করতেই হয়। আমার ফ্ল্যাটের আয়তন ৭৭ বর্গমিটার– মোট তিনটে ঘর মিলিয়ে ৫৬ বর্গমিটার; এছাড়া হলঘর; রান্নাঘর, বাথরুম, করিডর এই হিসাবের মধ্যে পড়ে না। সব মিলিয়ে ভাড়া সাকুল্যে মাসে ২০ রুবল, টেলিফোনের ভাড়া আড়াই রুবল– কল ফ্রি; ইলেকট্রিসিটির ইউনিট ৪ কোপেক, গ্যাসের জন্য দিতে হয় মাসে ২ থেকে ৩ রুবল। আমার নিজেরই গড়পড়তা মাসিক আয় ৬০০ রুবল, স্ত্রীর রোজগারের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। সোভিয়েত নাগরিকদের গড় মাসিক আয় ১৫০ রুবল।
সোভিয়েত সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা বলতে কিছু ছিল না ঠিকই, মানুষের হাতেও পুঁজি বলতে এমন কিছু ছিল না যা দিয়ে অন্যের ওপর শোষণ চালিয়ে মুনাফা অর্জন করা যেতে পারে। ফাটকাবাজি বা কালোবাজারি একরকম নির্মূলই হয়ে গিয়েছিল, থাকলেও সে ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বাড়িঘর-জমিজমা কোনওটাই কেনাবেচার সামগ্রী ছিল না। এসবই নির্ধারিত হত সরকারি হিসাব মতো, ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি আনুকুল্যে পাওয়া personal property (নিজস্ব সম্পত্তি)– private property বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তাই কেনাবেচার সামগ্রীও নয়। ভাড়া বলতে যেটা বোঝায়, সেটা আসলে একধরনের property tax. বাড়িঘর বর্তমানে বেসরকারিকরণের ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অর্থাৎ কেনাবেচার সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু property tax বা সম্পত্তি কর সেই আগের মতোই দিতে হয়।
.…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
এমনকী, স্কুল-কলেজে বিনামূল্যে যে পাঠ্যবই দেওয়া হত, তাও পড়াশুনা শেষ হয়ে গেলে ফেরত দিতে হত– বইয়ে কোনও আঁচড় কাটা যেত না, পেনসিল দিয়ে দাগালে সে দাগ মুছে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিতে হত। মানুষ ছোটবেলা থেকে জিনিসের যত্ন নিতে শেখে, সেদিক থেকে তো ভালোই। কিন্তু মানুষকে বাধ্য করা এক কথা, আর তাকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা বা তার মানসিকতা পাল্টানো আরেক কথা। সোভিয়েত শিক্ষার এই ব্যাপারে, অর্থাৎ নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে কোথায় যেন একটা খামতি থেকে গিয়েছিল। চে গুয়েভারা একবার কোনও এক জায়গায় ঠিকই বলেছিলেন, ‘‘মানুষকে খাওয়ানো পরানোটা যদি একমাত্র সমস্যা হয়, তাহলে নয়া পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বুদ্ধি করে কোনও না কোনও ভাবে তার সুরাহা করে দিতে পারে। এরা ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু সেটা আমাদের লক্ষ্য নয়, আমাদের লক্ষ্য নতুন মানুষ তৈরি করা, যে মানুষ অন্যের জন্য বাঁচার মধ্যে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাবে। তা না হলে মানুষ হয়ে বেঁচে কোনও লাভ নেই।’’ কিন্তু যাঁরা সে পথ দেখাবেন, তাঁরাই যদি বিশেষ সুবিধাভোগী হন, তাহলে আর কিছু করার এখানে থাকে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে এই শ্রেণির মানুষের ক্ষুধাই দেখতে দেখতে একসময় সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করল। তাদের বিরুদ্ধে আমজনতার ক্ষোভও থেকে থেকে বড় আকার ধারণ করায় সোভিয়েত সমাজব্যবস্থাটাই ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গেল।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved