ডিসেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য মাস রাশিয়ার ইতিহাসে। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাশিয়া বেলোরাশিয়া ও উক্রাইনার উদ্যোগে প্রথম গঠিত হয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের সংঘ– পৃথিবীর ইতিহাসে এক অতুলনীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোক্তা ওই তিন প্রজাতন্ত্রেরই প্রধান প্রজাতন্ত্রসমূহের সংঘ ভেঙে দিয়ে গঠন করলেন স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ। সে-বছর বড়দিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম এবং শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচ্যোভকে হটিয়ে দিয়ে ক্রেমলিনের কর্তা হয়ে বসলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন।
৬২.
পুরাতন ও নতুনের সন্ধিক্ষণ
মস্কো, জানুয়ারি ১৯৯৩
সেদিন চমকে উঠেছিলাম মস্কোর লেনিন অ্যাভিনিউয়ের দক্ষিণ প্রান্তে একের পর এক বাজির ফোয়ারা আকাশে উড়তে দেখে। ৩০ ডিসেম্বর, সময়টা অসময়– সন্ধ্যা ৭:৩০ টা।
একটি সোভিয়েত ঐতিহ্য ছিল কোনও উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সামাজিক উৎসব উপলক্ষে সন্ধ্যা সাতটায়, একই সময়ে দেশের বড় বড় শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর পর তোপ দেগে রংবেরঙের হাউইয়ের ফুলঝুরি ছেড়ে জনসাধারণকে অভিনন্দন জানানো। সোভিয়েত রাজনৈতিক উৎসবগুলি তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ায় ইদানীং সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর উৎসব ছাড়া আর কোনও উৎসব উপলক্ষেই এরকম আতসবাজি ছাড়া হয় না।
এই হাউইগুলি উড়ছে একই জায়গা থেকে। ৯টা বাজতে এখনও ঢের দেরি, বর্ষবিদায় বা বর্ষবরণ উপলক্ষে এরকম বাজি ছোড়ার রেওয়াজ নেই এদেশে। তাছাড়া আজ ৩১ ডিসেম্বরও না। তাহলে?
……………………………………….
১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঠিক এই মুহূর্তে কাস্তে-হাতুড়ি লাঞ্ছিত লাল সোভিয়েত পতাকা নামিয়ে দেওয়া হয়, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন। অনেকটা যেন পিতৃভূমির তর্পণ উপলক্ষেই ঠিক ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দূরদর্শনে দেখানো হল মিখাইল গর্বাচ্যোভের ওপর তিন ঘণ্টার একটি দলিলচিত্র। সমাপ্তি ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বরের সেই দিনটি দিয়ে।
………………………………………
রাস্তায় কৌতূহলী জনতার ভিড়। কারণটা জিজ্ঞেস করতে সকলে একবাক্যে বলে উঠল আজ ৩০ ডিসেম্বর– সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের সত্তর বছর পূর্তি উৎসব। না, সরকারিভাবে উদযাপিত হচ্ছে না, কিছু স্থানীয় উৎসাহী উদ্যোক্তার এই আয়োজন। কিন্তু এ তো অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান। মাত্র সত্তর বছর পরমায়ু।
ডিসেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য মাস রাশিয়ার ইতিহাসে। ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাশিযা বেলোরাশিয়া ও উক্রাইনার উদ্যোগে প্রথম গঠিত হয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের সংঘ– পৃথিবীর ইতিহাসে এক অতুলনীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোক্তা ওই তিন প্রজাতন্ত্রেরই প্রধান প্রজাতন্ত্রসমূহের সংঘ ভেঙে দিয়ে গঠন করলেন স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ। সে-বছর বড়দিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম এবং শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচ্যোভকে হটিয়ে দিয়ে ক্রেমলিনের কর্তা হয়ে বসলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন।
ভবিষ্যৎ মিউজিয়াম কর্মীরা সম্পূর্ণ সুবিচার করবেন যদি ক্রেমলিনে গর্বাচ্যোভের অফিস ঘরের ঘড়ির কাঁটা ১৯:৩২ মিনিটে থামিয়ে রেখে ঘরটাকে তাঁরা একটি স্মৃতিকক্ষে পরিণত করেন। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঠিক এই মুহূর্তে কাস্তে-হাতুড়ি লাঞ্ছিত লাল সোভিয়েত পতাকা নামিয়ে দেওয়া হয়, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করেন। অনেকটা যেন পিতৃভূমির তর্পণ উপলক্ষেই ঠিক ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দূরদর্শনে দেখানো হল মিখাইল গর্বাচ্যোভের ওপর তিন ঘণ্টার একটি দলিলচিত্র। সমাপ্তি ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বরের সেই দিনটি দিয়ে। ছবির বহুলাংশ জুড়ে ধ্বনিত হয়েছে ইউনিয়ন রক্ষার জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্টের নিষ্ফল হা-হুতাশ।
ডিসেম্বরের একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশ Terra– প্রকাশ ভবন কর্তৃক প্রকাশিত সংকলনগ্রন্থ– ‘যে জয়ন্তী উদযাপিত হল না।’ সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন ও তার পতন সম্পর্কে স্তালিন, ত্রোৎস্কি থেকে শুরু করে সাখারভ্, সোলঝেনিৎসিন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্লেষণধর্মী রচনার একটি সংকলন এটি। এছাড়াও স্থান পেয়েছে সেইসব অগণিত সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, যাঁরা জন্মেছিলেন এমন একটা দেশে, যে-দেশ আর নেই। আছে সেইসব রুশি-উক্রাইনীয়-আর্মেনীয়-তাজিক আর উজবেকদের মোহভঙ্গের কাহিনি, যাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন সোভিয়েত মহাজাতি গঠনের, যাঁরা নব উদ্ভূত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে আজ অবাঞ্ছিত।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বর থেকেই পরিবর্তন ঘটল আরও একটি সোভিয়েত ঐতিহ্যের। গত কয়েক দশক হল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নববর্ষের রাত্রে সোভিয়েত জনগণকে অভিনন্দন জানাতেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধার। রাত বারোটার কয়েক মিনিট আগে বেতার ও দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হত তাঁর ভাষণ। তাঁর ভাষণের শেষ কথাটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেমলিনের ঘণ্টা রাত বারোটা ঘোষণা করে পুরাতন বর্ষকে বিদায় জানিয়ে নতুন বর্ষকে আহ্বান করত।
সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান সরে যেতে ১৯৯১ সাল থেকে জাতির উদ্দেশে অনুরূপ ভাষণ দিয়ে আসছেন রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর রাতে নয়, ৩০ ডিসেম্বর। বেছে বেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের দিনটিতে।
ভোজের টেবিল সাজিয়ে বসার সামর্থ্য রাশিয়ার আজ অনেকেরই নেই, তাই হয়তো সংগত কারণেই প্রেসিডেন্ট নববর্ষের শুভেচ্ছাবাণী প্রদানের সময়ের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। যদিও কারণ ব্যাখ্যা করে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, পুরাতন ও নতুনের এই সন্ধিক্ষণটিতে মানুষকে চাপা উত্তেজনার মধ্যে রাখা তাঁর অভিপ্রায় নয়।
অনেকের মুখে এই উপলক্ষে শোনা যাচ্ছে চুটকি গান:
নতুন বছর করছি বরণ,
নেই কো তাতে রুশি ধরন–
মিখাইল নিল ভোদকা কেড়ে,
বরিস দিল ভাত মেরে।
চোখের জলে ভোলার পাত্র তিনি নন
মস্কো ৯ মে ১৯৯৩
পোল্যান্ড সীমান্ত রাশিয়ার দুর্গনগরী ব্রেস্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রেস্ত দুর্গের মুষ্টিমেয় কয়েকজন সৈনিক সীমান্ত রক্ষার জন্য আপ্রাণ লড়াই করে প্রবাদপুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। ব্রেস্ত কেল্লার রক্ষাকারীদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন তিমিরগেন জিনাত। গত বছর অক্টোবরে এসেছিলেন ব্রেস্তে। অনেকক্ষণ হাঁটেন ফাঁকা দুর্গের ভেতরে, ব্রেস্তের রাস্তায় রাস্তায়। তারপর… আত্মহত্যা করেন চলন্ত ট্রেনের চাকার তলায় মাথা পেতে দিয়ে। ‘তখন যুদ্ধের সময় যে-আঘাত আমি পেয়েছিলাম তাতে যদি আমার মৃত্যু হত তাহলে অন্তত জানতে পারতাম জন্মভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছি– চিরকুটে এই কথাগুলি তিনি লিখে যান। তিনি তাঁর মৃত্যুকে বিশাল দেশের ভাঙনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলে সকলকে জানাতে অনুরোধ করেন।
……………………………………
মাস দুয়েক আগেকার ঘটনা: মস্কোর বেলারুস্ স্টেশনে রেলের কামরা থেকে ছোটোখাটো সুটকেস হাতে নিয়ে নামলেন গ্রেট ব্রিটেনের মিলিটারি attach tour সেরে ফিরছেন। সঙ্গে সঙ্গে কুলি ছিনিয়ে নিল তাঁর হাতের সুটকেস। বয়ে নিয়ে চলল প্রতীক্ষমাণ মোটরগাড়ির কাছে, ইংরেজ বড়োলোকটি কুলির সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে মানিব্যাগ খুললেন। কিন্তু হা ভগবান! এ কী! কোথায় ডলার-পাউন্ড?
……………………………………
গর্বাচ্যোভের পেরেস্ত্রৈকা ইয়েলৎসিনের সংস্কারনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগে রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন ঘোষণা করেছিলেন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তিনি রেলের চাকার তলায় প্রাণ দেবেন। প্রাণ এখন দিচ্ছেন অন্যেরা– সমস্ত কিছুর ওপর আস্থা হারিয়ে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে। সাধারণ মানুষ যত আস্থা হারিয়ে ফেলছে নিজের ওপর ততই বেশি বিশ্বাস অর্জন করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। দেশের পাঁচ ভাগের দুই ভাগ মানুষ বর্তমান রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে গণভোটে অংশগ্রহণ করলেন না, তাদের উদাসীনতার দরুন আস্থভোটে জিতে গেলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি রোধ করতে পারছেন না রুবলের অধোগতি। সর্বত্র তৃতীয় শ্রেণির বিদেশি জিনিসের ছড়াছড়ি। কোনও জিনিসের কোনও গ্যারান্টি নেই, যেমন গ্যারান্টি নেই দেশের মুদ্রার। ভবিষ্যতের একমাত্র গ্যারান্টি ডলার।
মাস দুয়েক আগেকার ঘটনা: মস্কোর বেলারুস্ স্টেশনে রেলের কামরা থেকে ছোটোখাটো সুটকেস হাতে নিয়ে নামলেন গ্রেট ব্রিটেনের মিলিটারি attach tour সেরে ফিরছেন। সঙ্গে সঙ্গে কুলি ছিনিয়ে নিল তাঁর হাতের সুটকেস। বয়ে নিয়ে চলল প্রতীক্ষমাণ মোটরগাড়ির কাছে, ইংরেজ বড়োলোকটি কুলির সাগ্রহ দৃষ্টির সামনে মানিব্যাগ খুললেন। কিন্তু হা ভগবান! এ কী! কোথায় ডলার-পাউন্ড? মানিব্যাগ খুলে তিনি কুলির হাতে ধরিয়ে দিতে গেলেন ১০০ রুবলের একখানা নোট (১ ডলারে ৪০০ রুবল)। কুলি সেই নোট ঘৃণাভরে ফেলে দিয়ে ভদ্রলোকের গায়ে থুতু ছিটিয়ে স্থান ত্যাগ করল। পরে দূতাবাস থেকে স্টেশন-মাস্টারের কাছে অভিযোগ করা হয়। তবে কোনও ফল পাওয়া যায়নি। স্টেশনমাস্টারের জবাব: থুতু অনেকেই ছিটোয়। তা ঠিক, কিন্তু সে-থুতু যে নিজের গায়েই এসে পড়ছে! এ বোধ আজ আর অনেকের নেই।
মস্কোয় কী না বিক্রি হচ্ছে? লেনিন স্মৃতিসৌধের মুখোমুখি জ্বলজ্বল করছে ফরাসি বিজনেস হাউজ লাফাইয়েতের বিজ্ঞাপন। সর্বত্র প্রাইভেট ব্যাংক, যৌথ উদ্যোগ, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি বা জুয়াখেলার ঘর। কবি আলেক্সান্দ্র ব্লোকের নামে Casino হয়েছে, চ্যেখভ্ স্ট্রিটে Cherry Orchard একটা ব্যাংকের নাম। শিল্প-সংস্কৃতি সবই পণ্য সামগ্রী।
মেট্রোর সাবওয়েতে টুপি হাতে বসে আছেন এক বৃদ্ধ, বুকে শোভা পাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদক– একসময় বুক দিয়ে রক্ষা করেছিলেন দেশকে। টুপিতে পড়ে আছে মাত্র কয়েকটা রুবল– একটা কালো রুটি কেনার পক্ষেও যথেষ্ট নয়। বৃদ্ধের গাল বয়ে বড় বড় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের তা চোখে পড়ে না। তাছাড়া, ওই চোখের জলে ভোলার পাত্রও তিনি নন।
মস্কো, ১৪ জুন, ১৯৯৪
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দরুণ রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন (বিদেশে কেন যে রাশিয়া বা সোভিয়েত রাশিয়া নামে পরিচিত, তা দুর্বোধ্য) এককালে নানাদিক থেকে দুর্বোধ্য ছিল বাইরের দুনিয়ার কাছে। রাশিয়া আজ আর সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে দেশটার তো অস্তিত্বই নেই, তবু নিত্য, নতুন প্রহেলিকা সৃষ্টি করে শুধু বিদেশ কেন, দেশের জনসাধারণকে চমকে দিচ্ছে রশিয়া।
সম্প্রতি নতুন এক প্রহেলিকা সৃষ্টি হয়েছে রাশিয়ার নব প্রবর্তিত জাতীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে। জাতীয় উৎসব বলতে এই সেদিনও প্রচলিত ছিল ৭ নভেম্বর।
বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, গুলিগোলা, সীমানার পুনর্বিন্যাস, বাজারে প্রবেশাধিকার লাভেরজন্য বেপরোয়া প্রয়াস– গত কয়েক বছরে রাশিয়ার জীবনে এই সমস্ত উদ্দাম ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দেশবাসীর বুঝি বা ভাবনাচিন্তার অবকাশই ছিল না যে, তিন বছর হল তাদের জাতীয় উৎসব বলতে কিছু নেই।
জুনের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তাঁর হুকুমনামাবলে গত চার বছর আগে পুরনো পার্লামেন্টে গৃহীত রুশ ফেডারেশনের সার্বভৌমত্ব ঘোষণার দিনটিকে রাশিয়ার জাতীয় দিবস বলে ঘোষণা করলেন।
পাঁচ বছর আগে দেশের জাতীয় পতাকা ও প্রতীকের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য, জাতীয় সংগীত ও প্রধান জাতীয় উৎসব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে স্কুলের যে কোনও ছেলেমেয়ে উত্তর দিতে পারত। আজ সেই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অধিকাংশ বয়োজ্যেষ্ঠ এমনকী আইনকানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সরকারি আমলা পর্যন্ত থতমত খেয়ে যান।
প্রেসিডেন্টের হুকুমনামার কথা শোনার পর মস্কোর বিদেশি কূটনীতিবিদরা রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রণালয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠান এখন থেকে ১২ জুন বাস্তবিকই রাশিয়ার জাতীয় উৎসব কি না। যদি তা-ই হয়, তাহলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দনবার্তা পাঠানো উচিত কি না। ওই দিন মস্কোর বিদেশি দূতাবাসগুলি বন্ধ থাকবে না কাজ করবে?
উত্তর মেলে শুধু শেষ প্রশ্নের– বন্ধ রাখা গেলেও যেতে পারে। আর অভিনন্দনবার্তা?–পাঠাতে পারেন।
বিদেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের নিজেদের কাছেই তখন পর্যন্ত যা পরিষ্কার নয় তার সঠিক ব্যাখ্যা তাঁরা দেবেন কী করে? জাতীয় উৎসব ঘোষিত হল, ১২ তারিখ রবিবার পড়ায় পরদিন ছুটি ঘোষিত হল সেই সোভিয়েত ঐতিহ্য মেনে– ছুটি কখনও মার যেতে পারে না। কিন্তু উৎসবটা কীসের, কী উপলক্ষে, সরকারি প্রশাসন সঠিক করে বলতে পারে না, যেহেতু তার ওপর বৈধ কোনও দলিল নেই, অনুমোদনের জন্য পার্লামেন্টে কোনও প্রস্তাব ওঠেনি।
প্রেসিডেন্টের প্রশাসন দপ্তর দিনটিকে স্থির করে রাশিয়ার স্বাধীনতা দিবস হিসেবে। বিচিত্র উৎসব। বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে যে সমস্ত দেশ মুক্তি পেয়েছে, একমাত্র সেখানেই প্রচলিত আছে এ-ধরনের উৎসব। যে-রাশিয়া অন্তত গত পাঁচ শতাব্দী ধরে সুবিস্তীর্ণ এলাকা ও বহু জাতি নিয়ে স্বাধীনতা উপভোগ করে আসছিল চার বছর আগে, সে কিনা হঠাৎ স্বাধীনতা ঘোষণা করল তার নিজের ভূখণ্ড ও রাষ্ট্র থেকে, তারই নিজের সৃষ্টি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে! বিচিত্র যুক্তি: চার বছর আগে রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে এবং তার দেড় বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটিয়েই রাশিয়ার ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়।
সে যাই হোক, উৎসব সাধারণ মানুষ উদ্যাপন করুক, বা না করুক, পর পর তিন দিনের ছুটি (শনিবার থেকে শুরু করে সোমবার) সকলেই উপভোগ করেছে– বিশেষত গ্রীষ্মকালের ছুটি– তবে ঘরে বসে, কারণ প্রকৃতি বিমুখ।
বাইরে প্রবল বর্ষণ।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬১। প্রকাশের স্বাধীনতার আমলে সোভিয়েত থেকে হারিয়ে গেল চুটকি বা হাস্যরস
পর্ব ৬০। রুশ দেশের হাস্যরস যেন লোকসাহিত্যের এক অফুরান ভাণ্ডার
পর্ব ৫৭। গুরুগম্ভীর থেকে হাস্যকরের তফাত মাত্র একটি পদক্ষেপের
পর্ব ৫৬। রুশ দেশের অনেক খবরই আজকাল গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই পাওয়া শুরু করেছে
পর্ব ৫৫। মার্কিন দেশে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে এসেছিল একজন গর্বাচ্যোভের মুখোশ পরে, অন্যজন মাইকেল জ্যাকসনের
পর্ব ৫৪। হাজার হাজার কৌতূহলী জনতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই মহাদৃশ্য
পর্ব ৫৩। নাম বদলের গোলকধাঁধায় অসঙ্গতি বেড়েছে, ঐতিহ্যকে রক্ষা করা যায়নি
পর্ব ৫২। মস্কোর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মিছিলে ভারতের পতাকা থাকবে না-ই বা কেন?
পর্ব ৫১। পত্র-পত্রিকায় ঘোষণা করা হল কাস্ত্রো আসছেন, তবে ইনি মেক্সিকোর সোপ অপেরা স্টার
পর্ব ৫০। খোলা হাওয়ায় মানুষের আর কোনও কিছু নিয়েই চিন্তা নেই, অন্ন চিন্তা ছাড়া
পর্ব ৪৯। সোভিয়েত-মুক্ত রাশিয়াকে কে রক্ষা করবে?
পর্ব ৪৮। বর্ষশেষে মানুষ পেল দারিদ্র, এখন লোকে ধার-দেনা করে চা-কফি খাওয়া শুরু করেছে
পর্ব ৪৭। মুক্ত দিনে ব্যালের দেশ রাশিয়ায় ‘আধুনিক ব্যালে’ শেখাতে আসছে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রুপ
পর্ব ৪৬। অক্টোবর বিপ্লবের উচ্ছ্বাস কোনও দেশে কমলে, অন্য দেশে বাড়তে থাকে
পর্ব ৪৫। ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ আর পালিত হবে না, পালিত হবে বড়দিন– চোখের সামনে বদলে যাচ্ছিল সোভিয়েত
পর্ব ৪৪। রাজনীতিতে অদূরদর্শিতার ফল যে কত সুদূরপ্রসারী, তার প্রমাণ আফগানিস্তান
পর্ব ৪৩। জানলা দিয়ে পূর্ব জার্মানি দেখতে দেখতে গর্বাচ্যোভ বলেছিলেন, তাহলে এখানেই শেষ!
পর্ব ৪২। পেরেস্ত্রৈকা শুরু হলে বুঝেছিলাম ‘প্রগতি’ ‘রাদুগা’– এসব কিছুই থাকবে না
পর্ব ৪১। কল্পনা যোশীর তুলনায় ইলা মিত্রকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছে
পর্ব ৪০। বেসরকারিকরণের শুরু দিকে রাস্তাঘাটে ছিনতাই বেড়ে গেছিল, কারণ সব লেনদেন নগদে হত
পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি