ফিওনা এই মুহূর্তে ব্রিটেনের অন্যতম ফেমিনিস্ট অ্যাকাডেমিক। তিনি মেইনস্ট্রিম অনলাইন পর্নোগ্রাফির ওপর আলোচনা করেন ‘বিবিসি’-তে, লেখেন ‘গার্ডিয়ান’, ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘সানডে টাইমস’ এবং ‘টেলিগ্রাফ’-এ। এবং পর্ন ও তার প্রভাব, প্রসার ও নারীর চাহিদার ওপর কয়েকটি তথ্যচিত্রের পরিচালকও তিনি। তাঁর ‘উইমেন অন পর্ন’ বইটির উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘WOMEN this book is for you.’
৩৩.
পর্নোগ্রাফিকে কোন চোখে দেখে মেয়েরা? পুরুষরাই কি শুধু পর্নোগ্রাফি দেখতে, পড়তে ভালোবাসে? আর মেয়েরা? তারা পর্ন ছবিতে অংশ গ্রহণ করে, হয়ে ওঠে পর্ন তারকা। অথচ তারা না দেখে পর্ন, না পড়ে পর্নো? হতে পারে? এই তুমুল বিষয়টি নিয়ে পেঙ্গুইন থেকে একেবারে টাটকা প্রকাশিত বইটা পড়ে ফেললাম হাতে গরম।
লেখিকা ডক্টর ফিওনা ভেরা-গ্রে এই বিষয়কে ঘিরে একেবারে খোলাখুলি রস ও রতির ১০০টি গল্প বলেছেন তাঁর দুঃসাহসী ‘উইমেন অন পর্ন’ বইয়ে। এই বইয়ের শুরুতেই লেখিকার এই দুর্বার উচ্চারণ: ‘Porn is everywhere: in our bedrooms, our boardrooms, our pockets, our parliament. One of the leading sites claims that a third of its users are women, figure that is steadily increasing.’
কিন্তু পর্ন বলতে আমরা বেশিরভাগ সময় পুরুষকেই বুঝি পর্ন-এর দর্শক, পাঠক, লেখক এবং পরিচালক হিসেবে। মেয়েদের যেন কোনও রুচি আগ্রহ নেই পর্নতে। ফিওনা কিন্তু এই পুরনো ধারণা মানছেন না: ‘Yet when we think about porn today, we still mostly think about men. Men are the producers and the consumers. Women as the product.’
কিন্তু তা তো নয়। ফিওনা আমাদের পর্ন সম্পর্কে নারীর লাজলজ্জাহীন মনের কথার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন। কথায় কথায় মেয়েরা স্বীকার করছে তাদের যৌন ইচ্ছের সঙ্গে কেমন আগুন সুতো বুনে দিচ্ছে আধুনিক পর্নোগ্রাফি। তাদের বিছানাসুখে কীভাবে পর্নোমুভি জুড়ে দিচ্ছে নতুন মাত্রা। আধুনিক নারী কীভাবে পেরিয়ে এসেছে– ‘the one last taboo, the porn! In this book each woman delves deep into the intimate relationship between sex and porn, pleasure and shame.’ রমণীর যৌন তাড়না ও উপভোগ এবং মাঝখানে বেয়াড়া লজ্জার রেখা, ওই বাধাটুকু মুছে দিয়েছেন ফিওনা।
আমার মনে হয় বইটির গুরুত্ব বোঝাতে প্রথমেই লেখিকার পরিচয়টুকু ছোট করে দিয়ে রাখি।
তিনি এই মুহূর্তে ব্রিটেনের অন্যতম ফেমিনিস্ট অ্যাকাডেমিক। তিনি মেইনস্ট্রিম অনলাইন পর্নোগ্রাফির ওপর আলোচনা করেন ‘বিবিসি’-তে, লেখেন ‘গার্ডিয়ান’, ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘সানডে টাইমস’ এবং ‘টেলিগ্রাফ’-এ। এবং পর্ন ও তার প্রভাব, প্রসার ও নারীর চাহিদার ওপর কয়েকটি তথ্যচিত্রের পরিচালকও তিনি। তাঁর ‘উইমেন অন পর্ন’ বইটির উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছেন, ‘WOMEN this book is for you.’
ফিওনার লেখার স্টাইল প্রথম থেকে পাকড়ে ফেলে। দুটো বাচ্চা মাছ সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। উল্টো দিক থেকে একটা সিনিয়র মাছ সাঁতার কেটে আসছে। বাচ্চা মাছগুলোর সঙ্গে সিনিয়র মাছের দেখা হয়। ‘গুড মর্নিং স্যর’, বলে বাচ্চা মাছ দুটো। সিনিয়র মাছ বলে, ‘গুড মর্নিং কিডস, হাউ ইজ দ্য ওয়াটার?’ বাচ্চা দুটো সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়। তারপর ঘাবড়ে গিয়ে বলে, ‘হোয়াট দ্য হেল ইজ ওয়াটার?’
এটা লিখেই বিষয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ফিওনা: “The basic elements of our lives get lost in the background and can’t be seen. Today, porn is a big part of that background. It seems fairly obvious to say that porn is everywhere. But like the water it goes mostly unmentioned.”
পর্ন সর্বব্যাপী। কিন্তু পর্ন নিয়ে কেউ কিছু বলে না। যেন বিষয়টার মধ্যে জানার মতো কিছু নেই। ‘সাত বছর আগে আমি প্রথম মেয়েদের প্রশ্ন করতে শুরু করি পর্নোগ্রাফি নিয়ে’, লিখছেন ফিওনা। ঠিক কী জানতে চেয়েছিলেন তিনি? পর্নের রাজনীতি নয় অবশ্যই । তিনি খুঁড়তে চেয়েছিলেন নারীর যৌন জীবনে পর্নের স্থান, ‘porn as a personal practice.’ ফিওনা লিখেছেন এই ক’টি শব্দ: ‘all women have a porn story.’ সব মেয়ের জীবনে একটা পর্নের গল্প আছেই। আমার এই বই এমন ১০০টা পর্ন কাহিনি নিয়ে। একটু খুঁড়লেই মেয়েরা বলে। বলতে ভালোবাসে।
মেয়েটির নাম আনা। আনা পর্ন নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে ভালবাসে। “what she watches, what she doesn’t.” সে কেমন পর্ন দেখতে ভালোবাসে? আর কেমন পর্ন দেখে না?’ যেমন সে দেখে না যেগুলো কে বলা হয় ‘উইমেন ফ্রেন্ডলি পর্ন’। আনা বলছে, ‘আমি সেই ধরনের পর্ন দেখি, যা দেখে আমি শারীরিক উত্তেজনা ও আনন্দ পাই, আমার মন হালকা হয়, ব্লাড প্রেশার কমে, টেনশন কমে, সেক্স পজিটিভিটি বাড়ে।’
ভিক্টোরিয়া আইরিশ মেয়ে। বয়স ৪০। পর্ন দেখতে সে ভালোবাসে এবং কোনও রকম কুণ্ঠা নেই এই কথা স্বীকারে। তার কথা হল, ‘Women need to get their finger out and start being a bit more honest about the fact that they are human.’ পর্ন ভিক্টোরিয়াকে এই পেলব দর্শন থেকে মুক্তি দিয়েছে: ‘we are moral, we are wonderful, we have no pleasure and thank God for the fucking menopause.’
ভিক্টোরিয়া এই কথাও বলেছে যে, পর্ন তাকে শিখিয়েছে, ‘polite sex is a prison that would have us celebrate our impotence.’ সুতরাং, ভিক্টোরিয়া একদিন তার পুরুষ পার্টনারকে বলল, ‘আমি যদি তোমাকে জাস্ট ব্যবহার করে মজা পাই, তোমার আপত্তি আছে?’ সে বলল, ‘না, কোনও আপত্তি নেই।’
ভিক্টোরিয়ার মুখ থেকে কথাটা শোনার যাক: ‘the turning point for me in my life and I am about to be very graphic : I got on top of him and I turned round to him and I said, Do you mind if I just use you? And he said, No not at all, and I took myself off to a degree that I had never ever experienced before.’
এইভাবে ভিক্টোরিয়া স্বীকার করেছে, সে রাগমোচনের এমন এক শীর্ষ উত্তেজনা আর আনন্দ পৌঁছল যেখানে সে আগে পৌঁছতে পারেনি। এবং এই অনেস্টি সে শিখেছে পর্নের কাছে, ন্যাকামি-বর্জিত যৌন সততা। ভিক্টোরিয়ার আটপৌরে ঘরোয়া কিন্তু মারাত্মক সৎ ভাষায়: ‘stick him down on the ground and use the equipment how you will.’
ফিওনা এবার পর্নের যৌন দর্শন ও শিক্ষায় যাচ্ছেন। মেয়েদের মধ্যে ছোটবেলা থেকে একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে, তাদের রাগমোচন বা অর্গাজম অতি জটিল ব্যাপার। সেক্সের আনন্দ পুরোটাই যেন পুরুষের। ওদের ‘ওটা’ হয়ে গেলেই নোটে গাছটি মুড়োল। পর্ন কিন্তু মেয়েদের শিখিয়েছে, মেয়েদের নিজেদের অর্জন করতে হবে রাগমোচনের শীর্ষ উন্মাদনা। লিখছেন ফিওনা: “we are told from day one that our pleasure is abnormal, that sex is great but you are probably not going to get the best out of, just prepare yourself for that and you will be ok. It’s no wonder so many of us haven’t had the best time in the bedroom.”
……………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………
শেষ বাক্যটি লিখে ফিওনা তাকান তাঁর লেখার টেবিলটার দিকে। চুপ করে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। টেবিলের ওপর শুধু টেবিলল্যাম্পের আলো। ওই আলোর উদ্ভাস ফিওনার ল্যাপটপে। না, ল্যাপটপ জানে না। জানে না টেবিল ল্যাম্পের আলো। ফিওনার মনের কথা জানে শুধু তার লেখার টেবিল: “আমাদের মধ্যে সত্যি তো ক’জন পেয়েছি শোবার ঘরের চূড়ান্ত উন্মাদনা, শীর্ষ আনন্দ। উপলব্ধি করেছি রাগমোচনের শীর্ষ আরোহণ!”
এই কথাটি কী সহজে টেবিলটা ফুটিয়ে তুলল ফিওনার ল্যাপটপের স্ক্রিনে!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল