আড়াল থেকে দেখে যাওয়ার ভূমিকাটা ঈশ্বরের মতোই শিল্পীরও প্রাথমিক ভূমিকা। আর মানুষের তো যে কোনও সৃষ্টির কর্মের জন্যেই কিছুটা অন্তরাল চাই। কিন্তু আড়াল যেখানে বিঘ্ন, সেই আড়াল ছিঁড়ে ফেলাও শিল্পীরও কাজ। শিল্পের অন্যতম লক্ষ্য, আমাদের দেখতে ভুলে যাওয়া চোখের দৃষ্টি উন্মোচিত করে দেওয়া। যে দৃষ্টি এবারে ভিতরে বাইরের সব আড়াল ছাপিয়ে উঠবে, আর সেই অনুবৃত চোখের সামনে ধরা দেবে সত্য, তা সুন্দর বা অসুন্দর যাই হোক এবং দূরপ্রসারী স্বপ্ন। সুচিত্রা সেনের জন্মদিন উপলক্ষে, ৫ এপ্রিল, ২০০৯ ‘রোববার’ পত্রিকার ‘অন্তরাল’ সংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রিত।
অনেক দিন আগে কবি মণীন্দ্র রায়ের একটি বই-এর বিজ্ঞাপন দেখেছিলুম, তার নামেই ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়েছিল, বইটির নাম ‘মোহিনী আড়াল’। বইটি কোনও জরুরি সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছিল, আমার যতদূর মনে পড়ে, কিন্তু কবিতাগুলি আমার কোনও দিন পড়া হয়নি। পড়া হয়নি নয়, বইটা আমি পড়িনি। তখন বয়সও কম, মনে হল যদি কবিতাগুলো ভালো না লাগে? থাক, বই-এর নামটাই থাক ভালো লাগা হয়ে, কবির নামটি জড়িয়ে। খুবই বোকামি, স্বীকার করছি, কিন্তু আমার এই এক ভিতু স্বভাব, কিছু ভালো লাগলে, কাউকে ভালো লাগলে, সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকি। তখনই আড়াল দরকার হয়। সবটা নাই-বা জানা হল? থাক না একটুখানি আড়ালে? একটুখানি না জানা? আড়ালে আবডালে কতকিছুই তো ঘটে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে। ততটুকুই দেখি না কেন যতটুকু আমার সহ্য হবে? আড়াল না হলে আত্মরক্ষা করব কেমন করে?
মনে পড়ল, যুদ্ধের সময়ে (আমরা ‘যুদ্ধের সময় বলতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বোঝাই!) আমাদের পাড়াতে অনেক বাড়ির সামনে বালির বস্তার পাঁচিল সাজিয়ে ‘ব্যাফল ওল’ তৈরি হয়েছিল, জাপানের বোমার টুকরো থেকে বাঁচতে। আমরা তার আশেপাশে লুকোচুরি খেলতুম। জাপানি বোমা পড়েনি, সে বস্তার পাঁচিলও যুদ্ধ শেষে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদের লুকোচুরির দফারফা করে।
আমাদের প্রত্যেকের বুকের ভিতরে ওই রকম এক একটা বালির বস্তার প্রাচীর আছে, বুকের মধ্যে বোমা পড়ুক না পড়ুক, সে প্রাচীর কোনও দিন সরে যায় না। খুব সাহসী কিংবা পাগল না হলে সে আড়াল থেকে আমরা নির্গত হতে পারি না। সদা সত্য কথা বলিলে সমাজ কি তোমাকে টিকিতে দেবে? সদা সত্য কথা শুনিলেও বেঁচেবর্তে থাকা কঠিন হইতে পারে। তাই একটুখানি মিথ্যের আড়াল আমাদের মনুষ্য জীবনে জলবায়ুর মতো জরুরি। তবে হ্যাঁ, আমরা তাকে ঘিরে ঘিরে লুকোচুরিও খেলি।
নিজেকেই কি আমরা সবখানি উন্মোচন করতে পারি? অন্যের কাছে উন্মোচন করা তো দূরের কথা, নিজের কাছেও? ‘আমির আবরণ’ আমাদের সভ্যতার প্রথম শিক্ষা। আড়াল আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। আড়ালের বড় মায়া। সব বেঠিকানা মোহগুলি, সব মায়াবী বিষণ্ণতাগুলি রক্ষা করতে আমাদের অন্তরের মধ্যেও একটা আব্রু লাগে, একটা অন্তরাল। আমাদের গভীর, গভীর ইচ্ছেগুলোকেই কি আমরা বে-আব্রু হতে দিই কখনও? কক্ষনো না। তবে আর সভ্যতা কীসের, ভব্যতা কীসের? আমরা তাই ইচ্ছেগুলোকেও পর্দা দিয়ে ঢেকেঢুকে নিরাপদ করে রাখি, নগ্নতার মুখোমুখি হতে ভয় পাই। রিপুগুলির একক উন্মাদনার কবলে থেকে আমাদের রক্ষা করে এই আড়াল। আমি-র আড়ালের আমি, তার আড়ালের আমি তারও আড়ালের আমি, তার আড়ালের সেটারও– অনেক, অজস্র পরতে পরতে আমাদের আধুনিক মনন আমাদের লুকিয়ে থাকতে শেখাচ্ছে, কখনও বাধ্যকরী, কখনও স্বেচ্ছাবৃত। ঠিক এই কম্পিউটারে যেমন মাঝে মাঝে অনেকগুলো উইন্ডো খুলে যায়, একটার পিছনে আরেকটা, তার পিছনে আরেকটা। এক একবার আমার অবাক লেগেছে, এই জানালাটা আমারই ভিতর ছিল? এই স্পেসটাকে আমি চিনতে পারছি না যে। এটা এতকাল আড়ালে ছিল, আড়ালেই থাকলে পারত। আজ সামনে এল কেন? ‘জ্ঞানের চক্ষু স্বর্গে গিয়ে যায় যদি যাক খুলি, মর্ত্যে যেন না ভেঙে যায় মিথ্যে মায়াগুলি’– এই মিথ্যে মায়াগুলোর মধ্যেই আমাদের যত সাধ-আহ্লাদ, আমাদের স্বপ্নসন্ধান মিশে থাকে।
এই উর্বর অন্তরালটুকু ঘুচিয়ে দিলে একটা ঘরকেও টিকিয়ে রাখা যাবে না। সংসারের সুখশান্তি বজায় রাখতে অন্তরাল খুব দরকারি। লিখতে লিখতে আমার এক বান্ধবী ফোন করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোর অন্তরাল নিয়ে কিছু মনে হয়?’ সে বললে, দূর দূর আমার জীবনে কোনও অন্তরাল নেই, সবটাই বড় রাস্তা। আমি ঝগড়া করি, ‘বাজে বকিস না। আলবাত আছে। ছেলে-বউ-স্বামী নিয়ে ঘর করছ আর অন্তরাল নেই? তুমি কি তৈলঙ্গস্বামী?’
আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির মেয়েদের জীবনে অভ্যন্তরীণ একটা অন্তরাল আছেই। সংসারে সবাইকে নিয়ে চলতে হলে শান্তি ও সামঞ্জস্য বিধানের জন্য আমাদের একটা আড়াল রাখতেই হয়। স্বচ্ছতার নীতি পালনের সঙ্গে এই আড়ালের কিন্তু কোনও শত্রুতা নেই। অনেককাল আগে আমি একবার লিখেছিলুম, গোপন কথাটি রবে না গোপনে, উঠিবে ফুটিয়া কম্পিউটারের স্ক্রিনে। যদি আমাদের বুকে একটা টিভির পর্দার মতো স্ক্রিন লাগানো যেত, মনিটর আর কী, আর তাতে সব মনের কথা ফুটে উঠত, সে বড় বীভৎস হত না? বাঁচার জন্য ওই আড়ালটুকু আমাদের জীবনে খুব দরকার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সংসারের সুখশান্তি বজায় রাখতে অন্তরাল খুব দরকারি। লিখতে লিখতে আমার এক বান্ধবী ফোন করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোর অন্তরাল নিয়ে কিছু মনে হয়?’ সে বললে, দূর দূর আমার জীবনে কোনও অন্তরাল নেই, সবটাই বড় রাস্তা। আমি ঝগড়া করি, ‘বাজে বকিস না। আলবাত আছে। ছেলে-বউ-স্বামী নিয়ে ঘর করছ আর অন্তরাল নেই? তুমি কি তৈলঙ্গস্বামী?’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মেয়েদের জীবনের আড়ালের শিক্ষা শুরু হয়ে যায় শরীর দিয়েই, খুব তাড়াতাড়ি। গরমে ভাই নাঙ্গা হয়ে ঘুরলেও বোনকে একটা ইজের পরানো চাই। এই আড়ালের শিক্ষা আমাদের বাড়তেই থাকে, তার ক্ষেত্র বদলে বদলে যায়। আড়াল নেমে আসে আমাদের নয়নে, আমাদের চলনে, আমাদের বচনে, আমাদের কলমে এমনকী, আমাদের মননেও। সব কিছু দেখতে নেই, সব কথা বলতে নেই, সব কিছু নিয়ে ভাবতে নেই, সব জিনিস চাইতে নেই। সবই আড়াল থেকে, সবই চুপিচুপি, সবই লুকিয়ে। খালি আড়াল আসে না আমাদের স্বপ্নে। ‘বাস স্টপে তিন মিনিট, স্বপ্নে বহুক্ষণ’ তো শুধু নীরার প্রেমিকের একার উক্তি নয়, জগতের নীরাদেরও। এই স্বপ্নজীবনটাকেও কিন্তু খুব সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখতে হয় মেয়েদের, শুধু জীবনের স্বপ্নগুলোকেই নয়। সত্য আর স্বপ্ন দু’টোকেই গোপন রাখা জরুরি হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে, জীবনে যেটা সবচেয়ে জরুরি, সেই বস্তুটির লোভে– শান্তি।
অন্তরাল থেকে অনেক কিছুই করা যায়, জগন্মাতা তো অন্তরাল থেকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডই পরিচালনা করছেন, রানি রাসমণির কথা জানি। দাদামশাই-এর বিধবা মা শুনেছি চিকের আড়াল থেকে পরলোকগত স্বামীর নুনের ব্যবসা চালাতেন। একটা অন্তরালবর্তিনীদের নিয়মিত ধারাবাহিক রচনায় সমৃদ্ধ না হলে পুরনো দিনের বাংলা সাহিত্য পত্রিকাগুলি অন্যরূপ পেত।
সাহিত্যে আরেক আড়াল আছে, ছদ্মনামের আড়াল। সেটা প্রায়ই বর্ম, অথবা দরজার কাজ করে, অথবা শুধুই লীলাচ্ছলে সৃষ্ট। কিন্তু জীবনেও আমার নানা ছদ্ম জীবনযাপন করি। কখনও স্বেচ্ছায়, কখনও বাধ্য হয়ে।
এক জীবন বহু জীবন তো যাপন করেই থাকে মানুষ। কিন্তু ক’জন পারি স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করতে? সেইখানেই সুচিত্রা সেনের অপরাজেয়তা। তবু আমার একটু মন খচখচ করত, মনে হত শিল্পীর তৈরি করা এই অন্তরাল তো শিল্পের কোনও কাজে লাগল না। শিল্পীর খামখেয়ালের জন্য আমরা বঞ্চিত হলুম।
কিন্তু এখন আমার মনের ভাব বদলেছে। এখন মনে করি এই ত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি আগামী সমস্ত প্রজন্মকে দিয়ে যাচ্ছেন এক মহৎ শিল্পীর যোগ্য উপহার। চিরযৌবনের রোমান্টিক নায়িকা। মলিনা, চন্দ্রাবতী, ভারতী দেবী, এঁদের (‘এনাদের’ নয়) যৌবনের পুরনো নায়িকারূপ যখন অবাক বিস্ময়ে দেখি, আর সেই ডাকসাইটে সুন্দরীদের গতযৌবনা মাসিমা-পিসিমার ভূমিকায় সমসময়ের চিত্রে দেখি, তখন যে মন খারাপ হয়, তা থেকে তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন। যতদূর জানি কাননবালাও প্রৌঢ় বয়েসে আর ফিল্মের পর্দায় আসেননি যদিও সমাজজীবনের অন্তরালে চলে যাননি এত নাটকীয় রহস্যময়তার সঙ্গে।
চিরকালের যৌবনের রহস্যময়তার প্রতীক হয়ে থাকতে চেয়ে নায়িকা যদি তাঁর রূপযৌবন-সম্মান-প্রতিপত্তি থাকতে থাকতেই সব মোহ ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় অসামাজিক, অন্তরালবর্তিনী হয়ে যান, সেটা তো অসামান্য সংযমের, সুবিবেচনার এবং ইচ্ছাশক্তির কাজ। রুপোলি পর্দার মোহিনী আড়াল থেকে দর্শকদের পুজো পাওয়ার লোভ এবং মোহ অনায়াসে ছেড়ে দিয়ে প্রচণ্ড ভাবে সুরক্ষিত প্রিভেসির আড়ালে সমাজ-বিচ্ছিন্ন সাধারণীর জীবন কাটানোর মতো মনের জোর তো গ্রেটা গার্বো আর সুচিত্রা সেন ছাড়া কারুর দেখিনি। এই ভাবেই আত্মসংযমের মূল্যে পর্দায় এবং দর্শকচিত্তে নিজেদের যৌবনের মোহিনী মায়াকে চিরন্তন করে রেখেছেন এই দুই নারী।
এখন যাঁকে ভোট দিতে বাড়ির বাইরে বেরুতে হয়, কী হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য, তিনি তো শিল্পী সুচিত্রা সেন নন, তিনি এক ছদ্ম জীবনে আর কেউ, যার সঙ্গে আমাদের লেনদেন নেই, চেনাশুনো হয়নি কোনও দিন। অযথা তাঁর অচেনা ছবি দেখিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করা উচিত নয় ইন্সেন্সিটিভ মিডিয়ার। এতে আমাদেরই ক্ষতি। আমাদের মনের মানুষটিকে কেড়ে নেওয়ার অধিকার মিডিয়ার নেই। আমরা চিনি আমাদের চিরদিনের সুচিত্রাকে, যখন যেখানে দেখি ঠিক চিনে নিই।
প্রসঙ্গত এখানে প্রিভেসি আর ইন্সেন্সিটিভ এই দু’টি বিদেশি শব্দ ব্যবহারের কারণ আমি অনেক ভেবেও মনের মতো বাংলা প্রতিশব্দ পাইনি। আপনাদের কারুর মনে পড়লে আমাকে অনুগ্রহ করে জানাবেন।
সমাজে আমরা লোকভয়ে ভীত হয়ে বাঁচি। আড়াল আমাদের বেঁচে থাকার একটা অস্ত্র। বউমা ছেলেকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়েছে, তার শ্বশুর-শাশুড়ি বলছেন বউমা একটু বাপের বাড়িতে গিয়েছে, ওর মায়ের তো শরীর খারাপ?
সত্য কখনও অসহনীয় হলে আমরা মিথ্যের অন্তরালে আশ্রয় নিই।
এক যুবকের রহস্যময় মৃত্যু হয়েছে, তার বাড়ির লোকেরা বলছেন আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রত্যক্ষদর্শীরা অন্য কথা বলছেন। কিন্তু সত্যের খাতিরে তর্ক তুলে আব্রুটুকু কেড়ে নেওয়ার তো দরকার নেই, সর্বনাশ যা ঘটার তা তো ঘটেই গিয়েছে! তাই সামনাসামনি কেউ প্রতিবাদ করছেন না।
একটু করুণার আড়াল আমাদের চাই।
আরেক আছে চক্ষুলজ্জার আড়াল।
তার ভাল আছে, মন্দও আছে। এতদিন জেনেছি চক্ষুলজ্জাটা সাধারণ নিয়মে থাকাই সমাজের পক্ষে মঙ্গল। তাতে সমাজের ব্যালান্স রাখতে সুবিধে হয়। পাকেচক্রে একটু অন্যের কথা ভাবতে আমরা বাধ্য হই। কেবল রাজনৈতিক নেতা হতে চাইলে ওই বস্তুটি থাকলে চলবে না, যেমন চলবে না সফল ব্যবসায়ী হতে চাইলে। স্বার্থের ক্ষেত্রে চক্ষুলজ্জা বড়ই অসুবিধেজনক, থাকলেই ব্যবসায়ে লোকসান। রাজনীতির মাঠেও জেতার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। আজকাল শুনতে পাই অবিশ্যি এই বিশ্বায়িত নাগরিক সভ্যতার ইঁদুর দৌড়ে, যে কোনও কর্মক্ষেত্রেই জয়ী হতে চাইলে তোমাকে আগেই চক্ষুলজ্জার আবরণটি ঘুচিয়ে আসতে হবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘সাক্ষাৎকার দেব না’ বলেছিল সুচিত্রা, এই ‘না’ বলাও চিরস্থায়ী
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আবার উল্টোটাও আছে, মধ্যবিত্ত চক্ষুলজ্জার আড়ালটুকু ঘোচাতে পারি না বলে আমরা অনেক সময়ে নিজেদের এবং অন্যদেরও অশেষ ক্ষতির কারণ হই। কখনও ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হই, কখনও অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক কিছু করি এবং তার জন্য পরে পস্তাই, কখনও অনুচিত অন্যায়ের সহায় হয়ে পড়ি অসহায় ভাবে।
চক্ষুলজ্জার অভ্যাসের আড়াল কখনও নিদারুণ সংকটেরও কারণ হতে পারে। একটি মেয়ের কথা শুনেছি, তার শাড়িতে আগুন লেগে মেয়েটা পুড়ে যাচ্ছে কিন্তু লজ্জায় সে লোকজনের সামনে জলন্ত শাড়িটা খুলে ফেলতে পারছে না, ঘরভর্তি কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুরুষ ছিল, চক্ষুলজ্জার অভ্যাসে পরস্ত্রীর অঙ্গ থেকে শাড়িটা খুলে নিতে ভদ্রলোকদেরও যথেষ্ট চটপট হাত ওঠেনি। সংকটের চেয়েও প্রবল হয়েছে অনর্থক লজ্জার ও চক্ষুলজ্জার অভ্যস্ত আড়ালগুলি। মেয়েটি বাঁচেনি।
আমাদের জীবনের ঘনঘোর, ঘনিষ্ঠতম আবেগের সম্পর্কের মধ্যেও একটা ন্যূনতম সম্মানের আড়াল থাকা দরকার। সেটা মঙ্গলের। সম্পর্কের স্থায়িত্ব অনেকটাই ভর করে থাকে ওই আড়ালটুকুর ওপরে। প্রত্যেক মানুষের তো একটা নিজস্ব নিঃশ্বাস নেওয়ার অলিন্দ চাই, একটি ইতিবাচক আড়ালের আশ্রয়। সেইটুকু বড় মূল্যবান, দু’টি মানুষের মধ্যে বিভেদ গড়ার চেয়ে সংযোগ সৃষ্টির কাজেই বেশি লাগে এই আড়াল।
আড়াল থেকে দেখে যাওয়ার ভূমিকাটা ঈশ্বরের মতোই শিল্পীরও প্রাথমিক ভূমিকা। আর মানুষের তো যে কোনও সৃষ্টির কর্মের জন্যেই কিছুটা অন্তরাল চাই। কিন্তু আড়াল যেখানে বিঘ্ন, সেই আড়াল ছিঁড়ে ফেলাও শিল্পীরও কাজ। শিল্পের অন্যতম লক্ষ্য, আমাদের দেখতে ভুলে যাওয়া চোখের দৃষ্টি উন্মোচিত করে দেওয়া। যে দৃষ্টি এবারে ভিতরে বাইরের সব আড়াল ছাপিয়ে উঠবে, আর সেই অনুবৃত চোখের সামনে ধরা দেবে সত্য, তা সুন্দর বা অসুন্দর যাই হোক এবং দূরপ্রসারী স্বপ্ন। শিল্পের সৃষ্টি করা সেই কল্যাণ স্বপ্নের মধ্যে আমরা আবার নতুন করে খুঁজে নিতে চাইব বিশ্বাস– এই আকাশভরা, সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণের কর্মকাণ্ডের মাঝখানে যেটি হবে আমাদের একাকী ভ্রমণ করার আসল মোহিনী আড়াল।