একতাল মাটি নিয়ে রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ গড়া শুরু হল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করের এই কাণ্ড দেখে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। ভাস্কর্য! যে দিকে সারাজীবন হাত বাড়াননি রবীন্দ্রনাথ। একটিও মূর্তি গড়ে দেখেননি। অথচ অনবরত ছবি এঁকে চলেছেন গত ১৪-১৫ বছর। ভাস্কর হওয়ারও কি সাধ ছিল তাঁর?
রোববার ডিজিটাল ডেস্ক: রবি ঠাকুরের জীবন-উপান্তের কথা। ছবির রবীন্দ্রনাথ তখন সম্পূর্ণ বিকশিত। দেশ ও বিদেশে এগজিবিশন হয়ে গিয়েছে। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এলেও মোটেই দমে যাননি তিনি। কবিতা লিখছেন, তবে ছবি আঁকার দিকেই যেন তাঁর সমস্ত সময় গিয়ে পড়েছে। অবনীন্দ্রনাথ রবি ঠাকুরের ছবি আঁকাকে বলেছিলেন ‘লাভানিঃসরণ’। সারাজীবনের চর্চা দিয়ে যে রবীন্দ্রনাথ সর্বমোট গান লিখবেন, শেষ ১৬-১৭ বছরের নিরন্তর অধ্যবসায়ে তিনি ছবি আঁকবেন তার চেয়েও বেশি।
আরও শুনুন: ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতো শেষশয্যা রবীন্দ্রনাথের কাঙ্ক্ষিত, কিন্তু পাননি
এমনই এক দিন, শিল্পী ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজ অনুরোধ করলেন রবীন্দ্রনাথকে– অনুরোধ, রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য গড়ার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শরীর তেমন ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু রামকিঙ্করের অনুরোধ থেকে তাঁর নিস্তার পাওয়ার জো আছে? তা তো মনে মনে উপরোধেরই শামিল। যে রামকিঙ্কর ভাস্কর্যের কিংবদন্তি রূপে তখনই সুপ্রতিষ্ঠিত।
রবীন্দ্রনাথ রাজি হলেন, কিন্তু জানালেন, ‘দেখ, ওদেশে মূর্তি গড়তে গেলেই খাড়া বসিয়ে নানা রকম যন্ত্রপাতি এনে নাক-মুখ মেপে ভয়ানক অস্বস্তি দেয়। আমার বড় কষ্ট হয়।’ রামকিঙ্কর জবাব দিলেন, সেসব এক্ষেত্রে দরকার নেই। রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের মতো কাজ করে চলবেন, রামকিঙ্কর তাঁর মূর্তিটি বানিয়ে ফেলবেন। রবীন্দ্রনাথ আর নারাজ থাকতে পারলেন না। বরং খুশি। বললেন, ‘পারবি? তা হলে তাই কর।’
আরও শুনুন: রবীন্দ্রলেখার কাটাকুটির ভিতর দিয়েই মুক্তির পথ পেল ভারতীয় চিত্রকলা
একতাল মাটি নিয়ে রামকিঙ্করের রবীন্দ্রনাথ গড়া শুরু হল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রামকিঙ্করের এই কাণ্ড দেখে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। ভাস্কর্য! যে দিকে সারাজীবন হাত বাড়াননি রবীন্দ্রনাথ। একটিও মূর্তি গড়ে দেখেননি। অথচ অনবরত ছবি এঁকে চলেছেন গত ১৪-১৫ বছর। রঙ-রেখা-অবয়বের পরীক্ষা করে চলেছেন। শুধুই মুখ নয়, তৈরি করেছেন প্রায় মুখোশের মতো মুখও। জ্যামিতিক, খরখরে, নির্মম এক রবীন্দ্রনাথ যে ছবির চর্চায় ধরা পড়ে। কিন্তু ভাস্কর্য তো একবারের জন্যও না। তা গড়ার দিকেই মন গিয়েছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমাকে একতাল মাটি দিতে পারিস? আমার খুব ইচ্ছে করে বেশ হাত দিয়ে টিপে টিপে একটা কিছু করি।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই অনুরোধ রক্ষা করতে পারলেন না রামকিঙ্কর। কারণ, প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ। তিনি রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। রীতিমতো শাসন করেন। তাঁর বারণ শুনতে বাধ্য হলেন রবীন্দ্রনাথ। রামকিঙ্করও। রামকিঙ্কর লিখছেন, “তাকিয়ে দেখি প্রতিমা বৌঠান কটমট করে তাকিয়ে আমাকে নিষেধ করছেন। পরে ডেকে বললেন, ‘কখনও মাটিতে হাত দিতে দিও না। শরীর খারাপ, ঠাণ্ডা লেগে বিপত্তি হবে।’ ” এরপর আর কখনও রবীন্দ্রনাথ এ সুযোগ পাননি। ভাস্কর্যের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই উত্তরকালের দেখা হয়নি। খেদ থেকে রামকিঙ্কর লিখেছিলেন, ‘আজ দুটো দুঃখ মনে বিঁধে আছে। একটা হয়তো সংস্কার– সেই মূর্তি গড়ার পরেই ওঁর মহাপ্রয়াণ হল। আর একটা হচ্ছে– যদি সাহস করে ওঁকে খানিকটা মাটি দিতাম, ওঁর হাতের একটা কাজ হয়তো আমাদের ভাস্করদের পাথের হয়ে থাকত।’
সূত্র: রবি ঠাকুরের ছবি। রামকিঙ্কর বেইজ। রবি ঠাকুরের ছবি ছবি-আঁকিয়ের চোখে। সম্পাদনা: সুশোভন অধিকারী।