কলকাতার অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় যে কীভাবে শহরের রাস্তায় যান চলাচলের প্রধান উপায়ই ছিল ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা গাড়ি। বাবুদের নিজস্ব জুড়ি গাড়ি তো ছিলই, কিন্তু রুটের গাড়ি? সেও ছিল! ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কলিকাতায় চলাফেরায়’ লিখছেন: “ধর্ম্মতলার মোড় হইতে, উহাকে কেন্দ্র করিয়া প্রধানত চারিটী দিকে ঠিকা গাড়ী যাতায়াত করিত–ভবানীপুর, খিদিরপুর, বাগবাজার এবং শ্যামবাজার।” পুলিশের উৎপাতও ছিল। তাদের ভাড়ার খানিক অংশ না দিলে সমস্যা হয়ে যেত। এই গাড়িগুলির মধ্যে যে প্রতিযোগিতা অফিস-ফেরতা যাত্রীদের নিয়ে, তাতে প্রাণ যেত বেচারা ঘোড়াগুলির।
২৪.
উনিশ শতকে দুনিয়া জুড়ে আধুনিক শহর গড়ে ওঠার হিড়িক পড়ে যায়। শিল্প ব্যবস্থায় বিভিন্ন উদ্ভাবনের ফলে মানুষের অর্থনীতিতে যে বিশাল পরিবর্তন আসে, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে শহরগুলির রূপরেখা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে। কখনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী, আবার কখনও কোনও ছক না মেনেই শহরগুলি বেড়ে উঠেছিল। আমরা জানি যে শিল্পায়নের ফলে গ্রাম থেকে কৃষিজীবী পরিবারের মানুষ শহরে চলে আসতে শুরু করেন, আর ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে কলকাকারখানার শ্রমিক মহল্লা। এই পরিচিত গল্পের আর এক নায়ককে আমরা খুব একটা আজ আর মনে রাখিনি। ঘোড়ার ওপর মানুষের কর্তৃত্ব এই শতকে এক অভূতপূর্ব আকার ধারণ করে। বলা চলে, যে ঘোড়া ছাড়া মানুষের আধুনিকতার ইতিহাস অসম্ভব। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে এই সম্পর্ক বিশেষ রূপ নিয়েছিল গোটা উনিশ আর বিশ শতকের প্রথমার্ধ জুড়ে।
ইউরোপীয় শহরগুলির নানা পরিসংখ্যান চমকে দেওয়ার মতো। প্রতি ১২ জন ফরাসি নাগরিক পিছু একটা ঘোড়ার হিসেব পাওয়া যায়। অন্যদিকে, ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ড-এ প্রতি ১০ জনে একটা ঘোড়া। মার্কিন মুলুকে হিসেব ছিল ১টা ঘোড়া, ৪ জন নাগরিক; অস্ট্রেলিয়ায়, প্রতি ঘোড়া পিছু ২ জন মানুষ! উনিশ শতকের শেষার্ধে শুধু লন্ডন শহরেই ৩ লক্ষ ঘোড়া ছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে গোটা দেশের যা অনুপাত সেই তুলনায় শহরগুলিতে ঘোড়ার ভিড় ছিল অনেকগুণ বেশি। ইতিহাসচর্চায় এখন ‘অ্যানিম্যাল হিস্ট্রি’ বা ‘ননহিউম্যান হিস্ট্রি’ বেশ জনপ্রিয় এক শাখা। জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, অর্থনীতিতে তাদের শ্রমের মূল্য, বা তাদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে কিছু মানুষের সহানুভূতি– এই সবই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে ইতিহাসবিদদের লেখায়।
আধুনিক শহরের ইতিহাসে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কলকাতার অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় যে কীভাবে শহরের রাস্তায় যান চলাচলের প্রধান উপায়ই ছিল ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা গাড়ি। বাবুদের নিজস্ব জুড়ি গাড়ি তো ছিলই, কিন্তু রুটের গাড়ি? সেও ছিল! ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কলিকাতায় চলাফেরায়’ লিখছেন: “ধর্ম্মতলার মোড় হইতে, উহাকে কেন্দ্র করিয়া প্রধানত চারিটী দিকে ঠিকা গাড়ী যাতায়াত করিত–ভবানীপুর, খিদিরপুর, বাগবাজার এবং শ্যামবাজার।” পুলিশের উৎপাতও ছিল। তাদের ভাড়ার খানিক অংশ না দিলে সমস্যা হয়ে যেত। এই গাড়িগুলির মধ্যে যে প্রতিযোগিতা অফিস-ফেরতা যাত্রীদের নিয়ে, তাতে প্রাণ যেত বেচারা ঘোড়াগুলির। ক্ষিতীন্দ্রনাথের কথায়,
“গাড়োয়ানেরা পুলিশকে যথারীতি নজর সেলামী দিবার ফলে নির্ভয়ে কোচবাক্সে ও গাড়ীর ছাদে নির্দ্দিষ্ট সংখ্যা অপেক্ষা অনেক বেশী আরোহী উঠাইত। অনেক সময়ে পক্ষীরাজ ঘোড়া দুইটী গাড়ী টানিতে না পারিয়া পথিমধ্যে দাঁড়াইয়া যাইত। তখন তাহাদের উপর গাড়োয়ানদের মহা ক্রোধ উপজাত হইত এবং তাহার ফলে তাহারা ঘোড়াদের উপর সুমিষ্ট আত্মীয়তাব্যঞ্জক মধুময় সম্ভাষণের সঙ্গে চাবুকের দাণ্ডার দ্বারা যে প্রহার বর্ষণ করিত, তাহা দেখিলে পাষাণেরও হৃদয় বিগলিত হইত। কিন্তু আরোহীরা একপদও উঠিত না– কারণ তাহারা পয়সা দিয়াছে। আর নামিলেই বা তাহারা দুরদূরান্তরে যাইবে কিরূপে– আর তো গাড়ী পাইবে না?”
এই গাড়ি ছাড়া প্রথম ট্রাম চালানোর সময়েও বিদেশি কোম্পানি ঘোড়ার শক্তির উপর আস্থা রেখেছিল। নির্দিষ্ট লাইন ধরে শহরের বিভিন্ন দিকে ঘোড়ায়-টানা ট্রাম যাবে, এই ছিল পরিকল্পনা। পরবর্তীকালে, কলকাতার যান বাহনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে ট্রাম, এবং ট্রামযাত্রা শহরের সাংস্কৃতিক জীবনে বিশেষ ছাপ ফেলবে। তবে সেসব পরের কথা। প্রথমে খানিক ধাক্কা খেয়েছিল কলকাতায় ট্রাম চলাচল। আবার ফিরে যাই ক্ষিতীন্দ্রনাথের কথায়:
“ট্রামগাড়ী টানিবার জন্য কোম্পানি অষ্ট্রেলিয়া হইতে ওয়েলার (Waler) ঘোড়া রাশি রাশি আমদানী করিলেন। ঘোড়াগুলি বেশ গাঁটাগোটা। শীতকালে তাহারা বিশেষ কোনই গোলযোগ করিত না। কিন্তু গ্রীষ্মকালে তাহাদের কষ্ট দেখিলে অশ্রু সম্বরণ করা যাইত না…বৈশাখ-জৈষ্ঠের রৌদ্রে এবং ভাদ্রের প্রখর তাপে কত ঘোড়া যে সর্দ্দিগর্ম্মিতে মারা পড়িত তাহার ঠিকানা নাই।”
এর প্রতিকার হেতু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল কোম্পানি, কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি:
“এই সকল সমস্যার জন্য ট্রাম কোম্পানি তাহাদের লাইনের রাস্তার মধ্যে মধ্যে এক এক টুকরো ভূমিখণ্ড ক্রয় করিয়া কতকগুলি গাড়ি-ঘোড়া রাখিবার এবং ঘোড়াদের জল খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিয়াছিল। সেই আড্ডায় আসিলেই যোতা ঘোড়া খুলিয়া নূতন ঘোড়া যোতা হইত। যে রাস্তার মোড়ে ট্রাম লাইনের বাঁক আছে, সেই সমস্ত বাঁকে গাড়ী ঘুরাইবার জন্য এক-একটি অতিরিক্ত ঘোড়া দাঁড় করান থাকিত, কিন্তু এরকম ঘোরালো ও ব্যয়বহুল ব্যবস্থা বেশীদিন চলিতে পারে না। জল খাওয়াইবার ব্যবস্থা হৌক আর যাহাই হৌক না কেন, গ্রীষ্মকালে ঘোড়াগুলো মরিতে ছাড়িল না– কাজেই কোম্পানির লোকসান না হইলেও লাভ খুব বেশী হইত না।”
এর পরে ধীরে ধীরে ঘোড়ায় টানা ট্রাম পথ থেকে উঠে গিয়ে জায়গা করে দেবে প্রথমে বাষ্পচালিত, আর তারও পরে, ইলেকট্রিক ট্রামের। অন্যদিকে, বিশ শতকের গোড়ায় মোটর গাড়ি আর কিছু কিছু বাস কলকাতায় রাস্তায় চলাফেরা শুরু করে, ফলে ঘোড়ায় টানা ছ্যাকরা গাড়িও রাস্তা থেকে পাততাড়ি গুটোতে বাধ্য হয়।
কিন্তু যে জায়গায় ঘোড়া বহাল তবিয়তে রয়ে যায় তা হল শহরের রেস কোর্সে। এক অন্য কলকাতার ছবি উঠে আসে রেসের মাঠের গল্পে। দিশি-বিদিশি সাহেবসুবো, অ্যাংলো জকি-মেম, ছাপোষা মধ্যবিত্ত বাঙালি, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী– কে নেই সেই কল্পরাজ্যে! জুয়া খেলার স্বর্গরাজ্য বলে সাধারণ মানুষ খানিক আড়চোখে দেখেই এড়িয়ে যায় ময়দানের এই অংশটা, কিন্তু কলকাতার জনজীবনের বিচিত্র কথা বলে এই মাঠ। একশো বছর আগে সঙের গানে এর উল্লেখ পাই। এক জকির বয়ানে গাওয়া হল,
দিস অষ্ট্রেলিয়ান হর্স মাইরি বলছি,
আনতে ইণ্ডিয়ায় ভেরি কেয়ারফুলি,
আনিবারে নাইন থাউজেণ্ড রূপিস ব্যয়,
‘দি কিং অফ বার্ড’ নামটি ঘোড়ার,
এয়ারেতে চলে।
‘চাইনিস-ওয়াল-জাম্পিং’ অতি অবহেলে।।
…
এই খেলার ‘টিপস’ দিচ্ছি এবার বলে,
এই ঘোড়াতে ধরলে বাজি হারবে নাকো মূলে।
একটি টাকা দিয়ে গেটপাস নিয়ে,
গ্যালারীতে বসে,
‘ইসপোটিং লাইফের’ দেখবে টাইপ
চোখে চশমা কষে।
…
বলি যে খেলার প্রেমে গেছে জমে
খেলেছে একবার
…
বলি ঘর-দরজা বাঁধা দিয়ে রেসের খেলা খেলে।
দেনার জ্বালায় কোথায় পালায়, মাগ-ছেলেকে ফেলে,
কেহ বা হেরে এসে ঘরে ওয়াইফকে ধরে মারে।
টাকার শোকে মনের দুঃখে, হার্টফেল করে মরে।
…
আসছে সেই খেলার দিন,
সবাইকে খেলতে হবে ভাই,
আসতে যেতে হবে দেখা—
গুডবাই, গুডবাই।।
কোন ঘোড়ায় বাজি ধরতে হবে জকিরা নাকি বিশেষ ভাল জানতেন। এই গানের জকিও বলে দিচ্ছে ‘দি কিং অফ বার্ড’-এর মার নেই পরের রেসে। কিন্তু তারপরেই গানের সুর বদলায়, রেসের মাঠের অভিশাপ ফুটে ওঠে। মাঠে কে জিতবে, কোন ঘোড়ার কত ওজন, জকির ওজনই বা কত, আগের রেসে ঘোড়া কেমন ছুটেছে, এই রেসে দর কত উঠল– অনেক হিসেব নিকেশ, প্রচুর ক্যালকুলেশন, খানিক ইনট্যুইশন, বা একেবারেই বিধাতার উপর ছেড়ে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ দুশো বছর ধরে কলকাতায় ঘোড়দৌড় দেখে যাচ্ছে। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে অবিশ্যি অন্য একটা পন্থাও বলা হয়েছিল। শেষ করি তাই দিয়ে:
‘ম্যাকফার্সনকে চেন? আঃ, তুমি চিনবে কি করে। বিরাট জকি ছিল এককালে। পাঁচুর দোকানে বসে আমরা মাল খেতাম। আমাকে অনেক ঘোড়া দিয়েছে তখন। টার্মসটা ছিল ফিফটি ফিফটি। যা জিততাম ওকে অর্ধেক দিতাম। বুলেটের মত রাইড করত। শেষের দিকে ভাই লোভ বেড়ে গেল আমার। একটা ঘোড়া আমি পাঁচশো খেলে ওকে বলেছিলাম পঞ্চাশ খেলেছি। বিশ্বাস করেনি। তবে মুখে কিছু বলেনি। তখন কি জানতাম ও তার কদিন বাদে টেঁসে যাবে। সিরোসিস অফ লিভার। কিন্তু ও ছেড়ে গেলে কি হবে আমি ওকে ছাড়িনা। ওদের তো আর গয়ায় পিণ্ডি দেবার ব্যাপার নেই, ডাকলেই আসে। মানে আমি প্লানচেটে বসি বই নিয়ে। ভাল রেস বুঝত ম্যাকফার্সন। প্লানচেটে এসে প্রথমে রাগারাগি করে তারপর হাতে-পায়ে ধরলে ঘোড়া বলে দেয়। কালকে দশ নম্বর ঘোড়া বলেছিল। কি কপাল দ্যাখো, ফটোয় মার খেয়ে গেল। রাত্তিরে চেপে ধরতে বলল আজকালকার জকিরা রাইডিং-এর কিচ্ছু বোঝে না– ও নিজে হলে ঘোড়া হারতো না। তা অবিশ্যি ঠিক।’
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট