কিন্তু মধ্যবিত্তর সংসারে, ডায়েট ফলিয়ে বেশি খাব– এই ভাবনাটা কোথায় যেন আটকাচ্ছিল। ফলে মাছ, ডিম বা চিকেনের পরিমাণ বাড়াতে পারিনি। এখন বুঝি, ভুল করেছিলাম। যে কোনও প্রস্তুতিপর্বেরই নির্দিষ্ট একটা ডিসিপ্লিন থাকে। সে অলিম্পিকই হোক বা টলিম্পিক। পারফরম্যান্সটা কিছু মিনিটের, কিন্তু প্রস্তুতিটা নিরলস। সংলাপের চর্চাটা সিরিয়াস হলেও, শরীরচর্চায় ফাঁকি পড়ে গিয়েছিল।
৩৮.
ছবি শুরুর বাকি তিনমাস। একটা নতুন পর্ব শুরু হল যেন। সকালে উঠে হনহন করে হেঁটে মানিকতলা, সেখান থেকে অটো ধরে কাঁকুড়গাছি। ওখানেই টোটার জিম। আমার ট্রেনার হিসেবে টোটা একটি বাচ্চা ছেলেকে রেখে দিয়েছে। ছেলেটির আমার প্রতি কড়া নজর। জানে আমি ফাঁকিবাজ, ফলে যেদিন যেদিন আসি, প্রচণ্ড খাটায়, ওঠ-বোস, স্কিপিং, ভুজঙ্গা, সর্বাঙ্গা, মারদাঙ্গা– এসবের পর ওয়েট ট্রেনিং। লোকে ব্যায়াম করে-টরে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে ভোগে, আমি দিন দিন আরও দুর্বল বোধ করতে শুরু করলাম। টোটা আমার একটা ডায়েট চার্ট করে দিয়েছিল। যেখানে প্রোটিনের ভাগটা বেশি। নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল হঠাৎ, কিন্তু মধ্যবিত্তর সংসারে, ডায়েট ফলিয়ে বেশি খাব– এই ভাবনাটা কোথায় যেন আটকাচ্ছিল। ফলে মাছ, ডিম বা চিকেনের পরিমাণ বাড়াতে পারিনি। এখন বুঝি, ভুল করেছিলাম। যে কোনও প্রস্তুতিপর্বেরই নির্দিষ্ট একটা ডিসিপ্লিন থাকে। সে অলিম্পিকই হোক বা টলিম্পিক। পারফরম্যান্সটা কিছু মিনিটের, কিন্তু প্রস্তুতিটা নিরলস। সংলাপের চর্চাটা সিরিয়াস হলেও, শরীরচর্চায় ফাঁকি পড়ে গিয়েছিল।
সপ্তাহে তিনদিন ঋতুদার বাড়িতে মিটিং থাকত। আদতে সেটা একটা আনন্দের আড্ডা হত। আমি অটো করে আবার কাঁকুড়গাছি পৌঁছে, টোটার গাড়ি চেপে যেতাম। এই যাতায়াতে খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব তৈরি হল আমাদের, যা এখনও অটুট। টোটা এখন বলিউডের অন্যতম ব্র্যান্ডমুখ– এ কথা ভাবলেও প্রচণ্ড গর্ব হয়। বেড়ে ওঠার পথটা খুব সহজ ছিল না মোটেই। চন্দ্রিলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তখন বিশ্বকাপের ওপর একটা প্রোগ্রাম নিয়ে সকলে প্রবল ব্যস্ত। সিনেমার কারণে আমি তো জয়েনই করতে পারিনি অফিস, সারাদিন বাড়ি বসে ঢুলি আর ঘুমোই। ঋতুদা একদিন জিজ্ঞেস করল, “তোর জামাকাপড় কীর’ম আছে, একটু নিয়ে আসিস তো।’’ নিয়ে এলাম ব্যাগে করে। ঋতুদা শৌভিকদার দিকে তাকাল। দু’-একটা ব্যবহার করা যেতে পারে, বাকি কিনতে হবে। ফ্যাবইন্ডিয়া-র একটা মেরুন রঙের কুর্তা পরেছিলাম ‘শুভ মহরৎ’-এ, ওটা আমার নিজের। এছাড়া আর একটা চেকজামা পরেছিলাম, যেটার ঝুলটা খামোখা কেটে দিয়েছিল ড্রেসার। ঋতুদা আমাকে আর টোটাকে নিয়ে কস্টিউম কিনতে বেরল। তখন ‘লি কুপার’ কোম্পানির জিন্স এসেছে কলকাতায়, একটা দারুণ জিন্স কেনা হল। অত দামি জিন্স তার আগে পরিনি কখনও। ঋতুদা যখন বলল, সিনেমার পর ওটা নিয়ে নিস– মনে প্রবল আনন্দ হয়েছিল। আরও কয়েকটা জামা কেনা হল। এরপর গন্তব্য ‘উডল্যান্ড’। সেখান থেকে হালফ্যাশনের একটা ফোটোগ্রাফার জ্যাকেট কেনা হবে। বহুবিধ পকেটওলা অলিভ রঙের জ্যাকেটটা স্বপ্নের মতো দেখতে ছিল। কী যে পছন্দ হয়েছিল! মনে মনে ভাবছিলাম, ঋতুদা কখন বলবে, শুটিংয়ের পর এটাও নিয়ে নিস। কিন্তু ঋতুদা বলেনি সের’ম। লজ্জায় তখন আর বলতে পারিনি কিছু, ভেবেছিলাম পরে চেয়ে নেব।
এর বেশ কিছুদিন পর কস্টিউম ট্রায়াল হচ্ছে। ঋতুদা আমায় দেখে প্রবল বকাবকি শুরু করল। ‘কী জিম করলি বল তো, ওয়েট বাড়ার বদলে, এ তো আরও রিডিউস করে গিয়েছিস। হাড় জিরজিরে লাগবে স্ক্রিনে। একটা কাজ করিস, দাড়িটা আর কামাস না।’ শুধু প্রোটিন না খাওয়া নয়, রোগা হওয়ার আরও একটা বড় কারণ ছিল টেনশন। দুশ্চিন্তা মানুষকে খিটখিটে ও জীর্ণ করে দেয়। ওই ক’মাস আমারও তাই হয়েছিল। জিমের ছেলেটা যখন প্রবল খাটানোর পর জিজ্ঞেস করত, ‘এরপর থেকে সিনেমাই করবেন, গানকে ছেড়ে দেবেন’, মনে হত এক ধমক দিই।
সেই দিনগত পাপক্ষয় একদিন শেষ হল। সিনেমার শুটিং সত্যিই শুরু হল। ‘নিউ থিয়েটার্স ওয়ান’-এ সেট পড়েছিল ‘শুভ মহরৎ’-এর। প্রথম দিনের উত্তেজনা, থিকথিকে ভিড়, হইচই। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি শুরু বলে কথা। মেকআপের পর কস্টিউম– সেই জলপাই জ্যাকেট। আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হল– সাক্ষাৎ খুনির চেহারা। প্রতিটি দর্শক আমায় সাসপেক্ট না করে যায় না। কেউ একজন নিয়ে গেল ঋতুদার সামনে। ঋতুদা শুভঙ্করকে অপাঙ্গে মেপে বলল, ভালো। প্রথম দিনের শুটিং বলে মিডিয়ার লোকজন হাজির। আনন্দবাজারের নামকরা ফোটোগ্রাফার অশোক মজুমদার, ‘এই একটু দাঁড়াও তো’ বলে আমার ছবি তুলে নিল। ঋতুদা ফিসফিস করে বলল, ‘রাখিদির সঙ্গে বুঝেসুজে কথা বলবি।’
যাব্বাবা, শুটিংয়ের বাইরে কথা বলব কেন? আমার অত বলিউড প্রীতি নেই। আর রাখির আমি মেরেকেটে দুটো সিনেমা দেখেছি– ভালো লাগেনি। বরং আমি যেটা নিয়ে এখন চিন্তিত– এই জ্যাকেটটা শুটিং হয়ে যাওয়ার পরে কী করে বাগানো যায়। এখনই বলে ফেলব ঋতুদাকে? আমি লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে ঋতুদাকে বলতে যাব, ঋতুদা চিৎকার করে বলল, ‘শিগগির পজিশন নে, মনিটর হবে।’ এসব কথার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। বুঝতে একটু সময় লাগত। সত্যি শটের আগে ক্যামেরার সামনে মকশো করার নাম– মনিটর। আসলে রাখিদির মেকআপ শেষ হয়নি, ফলে এইসব খেলাধুলো চলবে এখন। অভীকদা ক্যামেরার পিছন থেকে, ‘আর একটু ডানদিক চেপে আসবে…’ এইসব বলতে লাগল। প্রথম শট আমারই। অল্প একটু হেঁটে এসে একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়ানো। খুবই প্রতীকী একটা শট। সত্যিই তো, দরজার ওপারে কী– কিছুই জানি না। শটটা শুরু হওয়ার আগে নারকোল ফাটানো হল, আর মাথায় এসে ইউনিটের একজন আগুনের ভাপ ছোঁয়াল। প্রথম শট, প্রথম অ্যাকশন, প্রথম কাট। একশো কুড়ি-পঁচিশ মানুষের চোখ আমায় দেখছে। ঋতুদা মনিটারে। দেখে যাচ্ছে শটটা। অভীকদা গলা তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘ঋতু ফাইনাল তো?’ ঋতুদার ভুরুটা কুঁচকে। ‘অনিন্দ্য, এদিকে আয়।’ খেয়েচে! কী করলাম রে বাবা! ‘জ্যাকেটটা খোল তো।’ ‘কেন? এটা তো ঠিকই আছে গায়ে।’ ‘না, ঠিক নেই। ঝকমকে লাগছে বেশি, কস্টিউম মনে হচ্ছে। অ্যাই অশোক, এদিকে আয় তো একবার। তোর জ্যাকেটটা খুলে অনিন্দ্যকে দে এক্ষুনি।’ এসব পাগলামির সঙ্গে সবাই পরিচিত ঋতুদার। অশোকদা হাসতে হাসতে তার ফোটোগ্রাফারের জ্যাকেট আমায় দিয়ে দিল। ঋতুদার ওপর রাগে মাথাটা গনগন করছে। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, পজিশনে হেঁটে যেতে যেতে শুনছি ঋতুদার গলা, অশোকদাকে বলছে– ‘তুই এই নতুন জ্যাকেটটা ইউজ কর, কী ভালো না রে রংটা?’
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৭। ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬। আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?