আমাদের পাড়ায়, বেলগাছিয়া অঞ্চলে রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বলে একটা দোকান ছিল। এখন সে দোকান আর নেই। বছর দুয়েক হল উঠে গেছে। এখানকার যে লাল দই, সে দই যে কোনও নবদ্বীপের দইকে হার মানিয়ে দিতে পারত। বেলগাছিয়া রাজবাড়িতে শুটিং করেছি যখন তখনও নিয়ে গিয়েছি। অঞ্জন দত্তর ‘সাহেবের কাটলেট’, শিবপ্রসাদ-নন্দিতাদির হাউজের ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি’, অরিন্দম শীলের ‘মায়াকুমারী’– এই সমস্ত ছবির শুটিংয়েই চার-পাঁচ কিলো করে দই আনিয়েছি ওই দোকান থেকে। এবং পুরো ইউনিট চেটেপুটে সাবাড় করেছে! রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এই দইয়ে এলাচ-টেলাচ কিছু ছিল না। কিন্তু মিষ্টির একটা চমৎকার ভারসাম্য ছিল। বেশিও না, কমও না।
আমি উত্তর কলকাতার লোক। উত্তর কলকাতার জল-হাওয়া আমার শরীরে। দইয়ের গল্পেও অবধারিতভাবে তাই এসে পড়বে উত্তর কলকাতার কথাই। ‘ওয়াইটুকে’ তখন আসবে আসবে করছে, এমন একটা সময়। আমার বয়স ১৬-১৭ হবে। বেলগাছিয়াতেই আমি বড় হয়ে উঠেছি। আড্ডা মেরেছি পাড়ায়। পাড়ার দাদারা ছিল নিজের দাদারই মতো। এই দাদাদের একজন– বিভূতিদা। বিভূতিদার বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, এদিকে বিয়ে কিছুতেই হয় না। একদিন শুনলাম, নাহ, অবশেষে পাত্রী মিলেছে! পাত্রী বহু দূরের, নবদ্বীপের কাছের এক গ্রামে। অনেকটা পথ। বরযাত্রীদের লিস্ট করা হচ্ছে। প্রথম প্রথম বরযাত্রী হতে আমি রাজি হইনি। কারণ, একে শীতকাল, তায় বৃষ্টিবাদলা হচ্ছে ক’দিন ধরে। বেজায় ঠান্ডা। নট নড়নচড়ন অবস্থা!
হঠাৎই পাড়ার রকের আড্ডায় দাদাদের গালগপ্প থেকে ভেসে এল, কান খাড়া করে পেলাম সেদিনকার বিশেষ বিশেষ সংবাদ: বিয়ের ভোজের শেষপাতে নাকি নবদ্বীপের লাল দই পরিবেশন করা হবে!
প্রবল লোভ হল। অথেনটিক নবদ্বীপের লাল দই তখনও পর্যন্ত আমি খাইনি। নবদ্বীপেই বিয়ে, ফলে লাল দইয়ের অথেনটিসিটি নিয়ে কোনও প্রশ্নই নেই। কলকাতায় শেষপাতে দইয়ের চল তখন একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে। আমার আরও ছোটবেলায়, ৫-৭-১০ বছর যখন– এই সময়টায় পাড়ায় ম্যারাপ বেঁধে বিয়ে হত। এবং অবশ্যই শেষপাতে থাকত লাল দই, যাকে বলা হয় ‘পয়োধি’। আজকালকার মতো সাদা দইয়ের কোনও চলই ছিল না। ছোট থেকে টক দইকে কোনও দই বলেই মনে করতাম না, আজও করি না। লাল দইয়ের ওপরে চমৎকার একটা সর পড়ত, চলতি ভাষায় ‘মাঠা’, তা খাওয়ার জন্য বেশ একটা হইচই পড়ে যেত। এমনও হত, যাঁরা পরিবেশন করছেন, তাঁরা প্রথম জনের পাতে মাঠার পুরো অংশটাই দিয়ে দিয়েছেন। পরের জন কিন্তু তখন নতুন হাঁড়ি থেকে মাঠাসুদ্ধ দই খেতে চাইতেন। বলতেন, এই হাঁড়ি থেকে আর খাবই না ধুর!
ফলে নবদ্বীপের লাল দইয়ের লোভে আমি শীত-বর্ষা মাথায় নিয়েই রাজি হলাম যেতে। বাসে করে রওনা দিলাম। দুপুর ৩টেয়। রাস্তাঘাট আজকের মতো ভালো ছিল না। সময় লেগেছিল প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা। নবদ্বীপের এক জায়গায় নেমে শুনলাম, এর বেশি বাস যাবে না। একটা সরু পথ দিয়ে ভ্যানরিকশা এসেছে, সেটায় চেপে যেতে হবে ঘাটে। আরও ৩০-৪০ মিনিট অপচয়। যদিও মনে মনে সেই লাল দইয়ের ব্যাপারে অনর্গল ভেবে চলেছি। কী সেই অমৃত! এত যে কষ্ট, তার উপশম ওই শেষপাতে পড়া লাল দইয়ে নির্ঘাত আছে।
নদী পার হলাম। দেখি, গ্রাম। দূরে দেখা যাচ্ছে বিয়েবাড়ির হ্যাজাক জ্বলছে। কিন্তু এদিকে যে রাস্তা– ঘাট থেকে বিয়েবাড়ি পর্যন্ত, তা কাদায় ভরা। বরযাত্রী যাবে বলে কনেপক্ষ থেকে পাটকাঠি বিছিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে কাদায় না পড়ে বরযাত্রীরা। কখনও সখনও হড়কে গেলে আশপাশের বাড়িতে ধাক্কা খাচ্ছি। সেসব পলকা বাড়ি খানিক নড়েও উঠছে। রাত সাড়ে ৯টায় পৌঁছলাম অবশেষে ।
পৌঁছে স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার ধুম লাগল। সকলেরই খিদে পেয়েছে। নানা পদ আসতে লাগল। ক্রমে বুঝতে পারলাম, শুধু আমি নই, আমার মতো আরও অনেকেরই লক্ষ্য শেষপাতের লাল দই। সাদা ভাত-মাছ-ডালের পালা চলে গেল। গ্রামের দিকে তখনও মাংসের রেওয়াজ চালু হয়নি। সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য সকলে যখন চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে, দেখি ওমা, আইসক্রিম! লাল দই নেই!
বরযাত্রীরা সব খেপে উঠল! ‘আপনারা যে বলেছিলেন, লাল দই খাওয়াবেন– সেইজন্যই তো বরযাত্রীরা এসেছেন!’ ওদিকে মেয়ের বাবা বললেন, ‘তাই-ই তো ঠিক ছিল, যে দোকানে অর্ডার দিয়েছিলাম, বর্ষার কারণে তারা সাপ্লাই দিতে পারেনি। এখন তো নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে আইসক্রিমের। ভাবলাম, শহর থেকে এসেছেন, আইসক্রিম খেয়ে খুশি হবেন।’ শুরু হল তুমুল ঝগড়ঝাঁটি। বরযাত্রী-কন্যাযাত্রীর ঝামেলা। বরযাত্রীর সকলেরই বিচ্ছিরি মনখারাপ, প্রত্যেকেই তো লাল দইয়ের বাসনাতেই এসেছিল। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে যখন বেরিয়ে আসছি, দেখি, হ্যাজাক নিয়ে কেউ আর দাঁড়িয়েও নেই আমাদের জন্য। ফলে গঙ্গার ঘাটে যেতে হবে ঘন অন্ধকারের মধ্য দিয়ে। এমনকী, সেই রাস্তার পাটকাঠিগুলো কাদার ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। ফেরার পথে নতুন পাটকাঠিও পাতেনি। স্বাভাবিক– কনেযাত্রীরা তো রেগে কাঁই আমাদের ওপর! ফলে জুতো হাতে, একহাঁটু কাদা পেরিয়ে আমরা ফিরেছিলাম।
………………………………………………..
আরও পড়ুন ‘সন্দেশ’ নিয়ে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, একদলা সন্দেশ মিশিয়ে দিয়ে তাতে
………………………………………………..
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হল না। ৩০-৩৫ জন বরযাত্রী নবদ্বীপে নেমেছিলাম যখন তখন রাত ১২টা। নবদ্বীপের মোড়ে বিখ্যাত লাল দইয়ের দোকান– সে দোকান সদ্য তৈরি হয়েছে ওখানে। বিয়ের ভোজের শেষপাতে না হলেও, দিনের শেষভাগে লাল দই খেয়েছিলাম। সেই প্রথম নবদ্বীপের লাল দই খাওয়া!
আমি দইয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত! যে কোনও মিষ্টির চেয়েই। এমনকী, আমার কাছে রাবড়ি আর দইয়ের লড়াইয়ে দই-ই বরাবর জিতে এসেছে। আমার লাল দই খাওয়ার একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। ভাতের ওপর খানিক লাল দই ফেলে, সাদা নরমপাকের সন্দেশ– ছানা কিংবা ক্ষীরের– মেখে খাই। এই সন্দেশের ব্যাপারে আমি পছন্দ করি উত্তর কলকাতার ছোটখাটো মিষ্টির দোকানের সন্দেশ– হাতিবাগান, টালা, বাগবাজার অঞ্চলের অখ্যাত প্রায় অন্ধকার মিষ্টির দোকান। এই সব দোকানে যে দই পাওয়া যায়, আমার মতে, পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। কোনও বড় হোটেলে বা রেস্তরাঁতেও না। বাংলা খাবারের চেন যেগুলো আছে, সেখানেও দই খেয়ে দেখেছি– এক্কেবারে জঘন্য! ডায়েট দই– সাদা রং, হালকা মিষ্টি– এগুলো দই! ফলে আমার দই খাওয়ার স্টাইল হল, একটু লাল দই এমনি এমনি খাওয়া আর বাকিটা ভাতের সঙ্গে সন্দেশ দিয়ে। এই খাওয়াটা হলে, দইয়ের যে হাঁড়ি, তা চেঁছে খাব। হাঁড়ি চেঁছে খাওয়ার যে কী আনন্দ!
আমাদের পাড়ায়, বেলগাছিয়া অঞ্চলে রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বলে একটা দোকান ছিল। এখন সে দোকান আর নেই। বছর দুয়েক হল উঠে গেছে। এখানকার যে লাল দই, সে দই যে কোনও নবদ্বীপের দইকে হার মানিয়ে দিতে পারত। বেলগাছিয়া রাজবাড়িতে শুটিং করেছি যখন তখনও নিয়ে গিয়েছি। অঞ্জন দত্তর ‘সাহেবের কাটলেট’, শিবপ্রসাদ-নন্দিতাদির হাউজের ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি’, অরিন্দম শীলের ‘মায়াকুমারী’– এই সমস্ত ছবির শুটিংয়েই চার-পাঁচ কিলো করে দই আনিয়েছি ওই দোকান থেকে। এবং পুরো ইউনিট চেটেপুটে সাবাড় করেছে! রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এই দইয়ে এলাচ-টেলাচ কিছু ছিল না। কিন্তু মিষ্টির একটা চমৎকার ভারসাম্য ছিল। বেশিও না, কমও না। বহু জায়গায় দেখেছি, লালটা পোড়া পোড়া হয় এবং মিষ্টিও অত্যধিক! দক্ষিণ কলকাতায়ও কিছু লাল দই পাওয়া যায়, যা একটু স্মোকি, ব্রাউনিশ– মিষ্টির পরিমাণও বড্ড বেশি। আমার মতে, এটা সঠিক দই নয়। দইয়ে মিষ্টির সামঞ্জস্য থাকতে হবে, লাল রংটার শেডটার দিকেও নজর দিতে হবে। তার বাইরে গেলে চলবে না। এর বাইরে অন্য কোনও দই আমি খাই-ই না।
শুধু দই দিয়ে বিচার করলে দক্ষিণ কলকাতাকে উত্তর কলকাতা ১০ গোল দেবে! শ্যামবাজার ছাড়িয়ে সিঁথি, বরানগর, ব্যারাকপুরের দিকে যত যাওয়া যায়, সেই পথেও চমৎকার সব মিষ্টির দোকান আছে। সেখানকার রসগোল্লা মোটেই ‘স্পঞ্জ’ নয়। এবং অরিজিনাল দই তৈরি হয় সেখানে– যাকে বলে ‘পয়োধি’! লাল দই কথাটাও লেখা থাকে না।
ভারতের বিভিন্ন কোনায়, নানা সময় আমি বাংলার দই নিয়ে পৌঁছেছি। ট্রেনে তো বটেই, প্লেনেও। নিশ্চিন্তে আমাকে লাল দইয়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে দেওয়া যেতে পারে।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….
তত্ত্ববিদ, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার কাজ নিয়েছে মস্কো রেডিয়োতে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ‘মির’ বা ’প্রগতি’তে অনুবাদক হয়েছে, কেউ বা সাংবাদিকতায় পি.এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে সংবাদপত্রের দফতর খুলে তার অন্তরালে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।