কালকূট তাঁর নিরাসক্ত তথা বৈরাগ্যের দৃষ্টিতে দেখেছেন কীভাবে বুড়িগঙ্গার তীরে ভূমিষ্ঠ একটি প্রাণ একটু একটু করে সমরেশ বসু হয়ে উঠলেন। নাবালক সুরথ থেকে সাবালক, ছেলেবেলার ঘটনাপ্রবাহ। লেখকের পরিবার– মা-বাবা, দাদা-বৌদি, ভগ্নিপতি, কাকা-কাকিমা, প্রতিবেশীদের মাঝখানে যেন সরু এক গলিপথ। সেই পথে হাঁটছেন বাল্যের সুরথ, একটু একটু করে হয়ে উঠছেন সমরেশ। এবং সমরেশের পিছু নিয়েছেন কালকূট, কারণ পাঠককে এই বেড়ে ওঠা বা গড়ে ওঠা দেখাবেন তিনি। স্বভাবতই এসে পড়ে বালকের দেশ-গাঁ। পুরান ঢাকা, উজানে চলা বুড়িগঙ্গার স্রোত।
একেই বলে নিয়তি! ২০২৫ সালে যে মহাকুম্ভকে হিন্দুত্বের জিগির তুলে ভারত-সহ গোটা বিশ্বে বিক্রি করছে যোগী-মোদি-পার্টি, সেই বছরেই জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হল কিংবদন্তি বাঙালি সাহিত্যিক সমরেশ বসুর। যিনি সাত দশক আগে আত্মপরিচয়ের খোঁজে প্রয়াগরাজের অমৃত কুম্ভে নিজে যেমন গিয়েছিলেন, তেমনই সঙ্গী করেছিলেন আপামর বাঙালি পাঠককে। সময়টা ছিল বেমক্কা আলাদা। পাঠক-লেখক সম্পর্ক তখন অনেক বেশি জোরলো। শত টিভি চ্যানেল, হাজার নিউজ পোর্টাল এবং সোশাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্য (মতান্তরে অত্যাচার) ছিল না। ফলে ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫৪-র ২৭ জুন থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক রচনা ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ আজ অবধি ওই পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিক। তবে কিনা সমরেশ বসু তো লেখেননি ওই উদাসীন, তন্ময় গদ্য। লিখেছিলেন ‘কারও কেউ নই কো আমি, কেউ আমার নয়’ আদর্শের ‘কালকূট’। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সমরেশ বসু কে? কালকূট তাঁর কে হয়? অনন্তের কুয়াশা সরিয়ে জীবন ও জগতের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ‘আমি কে?’-র উত্তরের খোঁজেই যেন ‘কালকূটের চোখে সমরেশ বসু’ রচনাটি লিখে গিয়েছিলেন পাঠকপ্রিয় বহুমুখী লেখক। কাকতালীয় ভাবে ১৪৪ বছর পরবর্তী মহাকুম্ভ যোগে সমরেশ বসুর জন্মের শতবর্ষে যে গ্রন্থের নতুন জন্ম বা পুনঃপ্রকাশ হল।
এ গ্রন্থের শুরুতেই নিজের পরিচয় স্পষ্ট করেন কালকূট, “মেঘ যায় গলতে, ঝর ঝর ঝরতে। আমি যাই সুধার সন্ধানে। তীব্র বিষ নাম আমার– কালকূট। গরল আমার ধমনিতে। সেই কবিতার মতো বলতে ইচ্ছা করে, ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কী কখন, ব্যথীত বেদন বুঝিতে পারে? কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীরবিষে দংশেনি যারে।’ আমার দৌড়ঝাঁপ ছুটোছুটি যাই বলো, সেই কারণে। মরি যে! জ্বলি যে! তাই আমি ভ্রমি সুধার সন্ধানে। বাঁচতে কে না চায়? মানুষ তো বহুত দূর, ওটা জীবনের ধর্ম! হতে পারি কালকূট। তা বলে অমৃতের সন্ধানে যাব না? এই আকণ্ঠ বিষ নিয়ে বাঁচব কেমন করে?” কিন্তু কবি যে বলেছেন, ‘কে জানে গরলই কিনা প্রকৃত পানীয়, অমৃতই বিষ…’।
অমৃত বা সুধা, গরল বা বিষের এই ধন্দ নিয়েই, সমূহ দ্বন্দ্বের পথেই এগোয় জীবন। কালকূট চেনার, বোঝার চেষ্টা করেন সমরেশ বসুকে, সেই সঙ্গে আমরাও– ‘মনে করার চেষ্টা করি, ওকে কি আমি চিনি? দেখেছি কি কখনও? মানুষটার চোখের দিকে তাকাই। মুখের দিকে দেখি। দেখি পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত। না, এ বড় বেকায়দার ব্যাপার! ডানদিক দিয়ে দেখতে গেলে একরকম, বায়ে গেলে আরেকরকম। একচোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, চিনি চিনি। আর এক চোখের দিকে তাকিয়ে ধন্দ লেগে যায়।” ঘোর কাটে না। তবে প্রশ্ন খানিক স্পষ্ট হয়– কী সেই ‘Orginal Face of Man?’ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বিতর্কিত সন্ত ওশোর কথায়, ‘Zen people say; Find out your face you had before you were born; find the face that you will again have when you are dead.’ (Osho/ The Original Face of Man/ A Sudden Clash of Thunder/Ch-3)
এমনিতে সহজ গদ্যে বলাই যায়, আলোচ্য গ্রন্থে কালকূটের চোখে দেখা সমরেশ বসুর আশ্চর্য রূপ ফুটে উঠেছে। কালকূট তাঁর নিরাসক্ত তথা বৈরাগ্যের দৃষ্টিতে দেখেছেন কীভাবে বুড়িগঙ্গার তীরে ভূমিষ্ঠ একটি প্রাণ একটু একটু করে সমরেশ বসু হয়ে উঠলেন। নাবালক সুরথ থেকে সাবালক, ছেলেবেলার ঘটনাপ্রবাহ। লেখকের পরিবার– মা-বাবা, দাদা-বৌদি, ভগ্নিপতি, কাকা-কাকিমা, প্রতিবেশীদের মাঝখানে যেন সরু এক গলিপথ। সেই পথে হাঁটছেন বাল্যের সুরথ, একটু একটু করে হয়ে উঠছেন সমরেশ। এবং সমরেশের পিছু নিয়েছেন কালকূট, কারণ পাঠককে এই বেড়ে ওঠা বা গড়ে ওঠা দেখাবেন তিনি। স্বভাবতই এসে পড়ে বালকের দেশ-গাঁ। পুরান ঢাকা, উজানে চলা বুড়িগঙ্গার স্রোত। যার তীরে স্কুল পালানো সুরথ, বাঁশির টানে ঘর বিবাগী বালক ভবিষ্যতের সমরেশের দিকে হাঁটতে থাকেন! নারীসঙ্গ এই বালক বয়সেই। কখনও নাবালিকা রাজু, কখনও দিদির বন্ধু ময়নাদি, সুন্দরী নববিবাহিতা ছোট কাকিমা, বিপ্লবী হরপ্রসন্ন গুহর স্ত্রী সুরবালার স্নেহ ভোলার নয়। এই সমস্ত অভিজ্ঞতাই লেখক সমরেশের সাহিত্যিক জীবনকে পরিপুষ্ট করেছিল, বলা বাহুল্য। এই টুকরো ঘটনার কোলাজ ‘কালকূটের চোখে সমরেশ বসু’ গ্রন্থের সম্পদ। এবং কালকূটের মায়াবী গদ্যভঙ্গি, অথচ সহজ গল্প বলার শৈলী পাঠককে মুগ্ধ করে। যদিও মূল প্রশ্নটি থেকেই যায়, কালকূট কে হয় সমরেশ বসুর?
উত্তর খুঁজতে ১৯৫২-তে পৌঁছায় টাইম মেশিন। ‘প্রবাহ’ পত্রিকায় ‘ভোটদর্পণ’ রচনায় প্রথমবার কালকূট ছদ্মনাম নিয়েছিলেন সমরেশ। রচনাটিতে চটকল এলাকায় সাধারণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানোর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, সমরেশ বসুও এককালে চটকলের কর্মী ছিলেন। ফলে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার লিখন হলেও, এই রচনায় ছিল বিবেকের দায়। অন্যদিকে লেখক সমরেশ বসুর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি ‘সমাজ ও রাজনীতি প্রুফ জ্যাকেট’। আক্রমণে এলে যে ঢাল হয়ে উঠবে। অতএব, বিবেকের দায় ও ঢালের বাস্তব প্রয়োজন থেকে জন্ম নিলেন কালকূট! যদিও কালে কালে কালকূট হয়ে ওঠেন বৈরাগ্য-পথের পথিক। যাকে চেনে ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’র পাঠক। এককথায় বলা যায়, সমরেশ বসু যতখানি বাস্তববাদী লেখক, কালকূট ততটাই বাউল শিল্পী। বাস্তবতার পেঁয়াজের খোঁসা ছাড়িয়ে যার হাতে থাকে এক মহাশূন্য বোধ!
‘আদাব’, ‘ধর্ষিতা’র মতো ছোটগল্প থেকে শুরু করে ‘প্রজাপতি’ ‘বিবর’-এর মতো সামাজিক সত্য, অকপট যৌনতায় আধুনিক সাহিত্য রচনা করেন যিনি, সেই মানুষটাই কালকূট হয়ে লেখেন‘দেখি নাই ফিরে’, ‘শাম্ব’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘ঘরের কাছে আরশি নগর’, ‘পিঞ্জরে অচিন পাখি’ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, একই লেখকের এই সাহিত্যকীর্তি বিস্ময়কর এবং কৌতূহল উদ্রেককারী। নিজেই দ্বৈতসত্তার সেই অচিন মানুষটির খোঁজে ১৯৭৪-এর এপ্রিল থেকে প্রসাদ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে লেখা শুরু করেন ‘কালকূটের চোখে সমরেশ বসু’। যদিও সেই রচনা থেকে যায় অসমাপ্ত। কতকটা এই জীবনের মতোই! তবে রয়ে যায় অসংখ্য মুহূর্তের কোলাজ– ‘ও (সমরেশ) বাইরে এসে দাঁড়াল। রান্নাঘরে দিদি আর বৌদির হাসি শোনা গেল। উঠোনের অন্য দিকে পড়বার ছোট ঘরে আলো জ্বলছে। যার অর্থ মেজদা এখনো গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। বৈঠকখানা ঘরের আলো দেখা না গেলেও, বাবা এবং তাঁর বয়স্যদের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। গান্ধী, সুভাষ বসু আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁদের আলোচনার বেশির ভাগ জুড়ে থাকেন, যা থেকে অনেক সময় এমন তুলকালাম তর্ক আর চিৎকার শুরু হয়ে যায়, পাড়ার লোকে ভাবে, একটা প্রলয় কাণ্ড কিছু ঘটতে চলেছে, বা ঘটল বলে।’ পরবর্তী পরিচ্ছেদ শুরু হয়, ‘অন্ধকার উঠোন, মাথার ওপরে ঝিকমিক করছে নক্ষত্র।’
এই যে মাটি-পৃথিবী– গান্ধী-সুভাষ-শ্য়ামাপ্রসাদ, আজকের মোদি-যোগী থেকে মহাশূন্য়ে ঝিকমিক করা নক্ষত্র! দূরত্বের এই ধাঁধাঁই সমরেশ বসুর আর কালকূটের সম্পর্কের রসায়ন। সেই অপর্থিব স্বাদের সঙ্গে পাঠকের আলাপ হয় ‘কালকূটের চোখে সমরেশ বসু’ পড়তে পড়তে। সমরেশ বসুর জন্মশতবর্ষে এই গ্রন্থকে প্রকাশের আলোয় আনায় ধন্যবাদ প্রাপ্য প্রকাশকের। তবে গদ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন নিম্নমানের প্রচ্ছদটিকে ভবিষ্যতে বদলে ফেলার আবদার রইল প্রকাশনা সংস্থা ‘পূর্বাশা’র প্রতি।
কালকূটের চোখে সমরেশ বসু
পূর্বাশা
৩০০্
আমি ভেবেছিলাম, একটা কাল্পনিক রেলপথের কথা। কেওনঝড়ে পাথরের মধ্যে অনেক লোহার পাহাড় রয়েছে। কল্পনা করেছিলাম এই পাহাড়ের মধ্য দিয়েই রেললাইন যাচ্ছে, এবং তা ঢুকে পড়ছে আদিবাসী গ্রামের মধ্যে। তাঁদের যে ‘মিথ’, রেলপথ আসায় তা একটু একটু করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।