স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যের স্বর্ণযুগ চলছিল যখন বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর থেকে শরদিন্দু, বিমল মিত্র থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র একের পর এক স্মরণীয় বই লিখছিলেন– তখনও শোনা গিয়েছে বাংলা সাহিত্যের কিছুই হচ্ছে না। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও যখন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু লিখছেন তখনও একই ধুয়ো উঠেছে। যখন যাযাবর, মুজতবা আলী, শংকর রম্যরচনায় ভারত জয় করছেন তখনও কিছু মুখে একই কথা উঠেছে। কিছু লোকের এটাই স্বভাব। তাঁরা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে বড় লেখক বলেননি, বিমল মিত্র সমস্ত ভারত জয় করার পরেও এঁদের অভিনন্দন পাননি। সৌভাগ্যের বিষয় এই নিন্দুকদের সংখ্যা তত বেশি নয়। সেইজন্যই লেখকরা এবং আমার মতো প্রকাশকরা আজও বেঁচে আছি।
২১.
বইমেলা আসছে– এমন একটা চাপা স্বর মোটামুটি দুর্গাপুজোর পর থেকেই বইপাড়ায় কান পাতলে শুনতে পাবেন। কলকাতা বইমেলাকে নিয়ে কলেজ স্ট্রিট বেশ কয়েকটা মাস সরগরম হয়ে থাকে। সব প্রকাশকই চান বাঙালির এই নতুন পার্বণে নিজের সেরাটুকু দিতে। প্রকাশকের ঘরে, প্রেসে, বাঁধাইখানায়– সাজো সাজো রব ওঠে। সত্যি বলতে কি, আমার মতো প্রকাশকের কাছে বইমেলা কোনও ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে কম নয়।
প্রাচীন একটি বাংলা প্রবাদে বলা হয়েছে– ‘কালি-কলম-মন লেখে তিনজন’। কালি-কলম নয় হল, কিন্তু মন– সেও আবার লেখে না কি? এমন প্রশ্ন যদি কেউ সত্যি-সত্যি করে বসেন, তাহলে তাকে তো নেহাতই অর্বাচীন বলতে হবে। লেখে তো মনই। সৃষ্টির সংকেত মস্তিষ্ক থেকে বার্তা আনে লেখকের হাতে। এভাবেই চলতে থাকে লিখনপ্রক্রিয়া, সৃষ্টির সাধনা।
লেখক-পাঠক আর প্রকাশক– এই তিনে মিলে যে তিনসঙ্গী, তাঁরাই শিল্প-সাহিত্যের উঠোনে ফুল ফোটান। আর সেইসব ফুলকে সাজিয়ে দেখানোর জায়গা বইমেলা। কলকাতা বইমেলা বা কলিকাতা পুস্তকমেলা, যে-নামেই তাকে ডাকি না কেন, আড়ে-বহরে বাড়তে-বাড়তে তা এখন রীতিমতো বৃহৎ মেলার চেহারা নিয়েছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, সারা বছরের প্রতীক্ষার পর এটি একটি সারস্বত মিলন মেলা হয়ে ওঠে। গ্রামের ছেলে আমি, আমার কাছে মেলা মানে মিলমিশ। বিচ্ছেদ ভুলে আপন করার উৎসব। বলতে কোনও দ্বিধা নেই কলকাতা বইমেলা ক্রমশ সেই চরিত্র অর্জন করেছে। এই অর্জন এক-দু’দিনের চেষ্টায় হয়নি। কয়েকটি দশক লেগেছে এই স্থাপত্য গড়ে উঠতে। তিল-তিল করে সে সাবালক হয়েছে। গত প্রায় পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতায় কলকাতা বইমেলা ধীরে-ধীরে প্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তমনস্ক হয়েছে। বইমেলার টুপিতে এখন ঝকঝকে আন্তর্জাতিক পালক। সেই পালকের রঙে, রূপে আমরা সবাই বিভোর।
একথা স্বীকার না-করে কোনও উপায়ই নেই যে, কলকাতা বইমেলার দেখাদেখি দূরের জেলা-মফস্সলেও আয়োজিত হচ্ছে বইমেলা। ক্রমশ তা একটি উৎসব, হয়তো-বা আন্দোলনের চেহারাও নিয়েছে। আমাদের এখানে এক সময় হত পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা। কিন্তু একসঙ্গে থাকলেই আমাদের জয়, সংসার ভাঙলে আমাদের শক্তিক্ষয় হবে, আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব– এমন একটা সত্য থেকেই দু’টি পুস্তকমেলা– পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা ও কলিকাতা পুস্তকমেলা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। কয়েকবার ঠিকানা পালটে এখন সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে কলকাতা বইমেলা স্থায়ী আশ্রয় পেয়েছে।
যাক, সেসব প্রসঙ্গ। লেখক আর পাঠক, তার সঙ্গে প্রকাশক– এই যে সাহিত্যসৃষ্টির তিনসঙ্গী– তারা মিলতে পারেন বইমেলায়। মিলেমিশে, আলোচনা ও গঠনমূলক সমালোচনায় অন্যতর ভুবন গড়ে তুলতে পারেন। আর সেই ভুবনের যে-সম্পদ, তা আহরণ করার বিষয়টিও থেকে যায় এই তিন সাহিত্য-শক্তির ওপর।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা– এসবই লেখক রচনা করেন তাঁর অভিজ্ঞতা ও কল্পনার ঘন বুনোটে। মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি হতে থাকে অন্য এক ভুবন। সেই অন্য ভুবনের সিঁড়ি বা গোপন দরজাটি পাঠকের সামনে পরিষ্কার করে দিতে থাকেন একজন প্রকাশক, একটু-একটু করে। আর বইমেলা হয়ে ওঠে সাধারণভাবে সেই প্রকাশের সব চেয়ে বড়ো জায়গা। একটা সময় ছিল, আজ থেকে ৩০ কি ৪০ বছর আগেও, যখন সারা বছর ধরে বই বেরত। নতুন-নতুন বই। পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, পঁচিশে বৈশাখ, রথ, বাইশে শ্রাবণ, মহালয়া, দুর্গা পুজো– সবই ছিল হিন্দু বাঙালি প্রকাশকদের বই বার করার সময়। মুসলমান বাঙালি প্রকাশকেরা বই বার করতেন ইদ, মহরম, শবেবরাত-এ। সে ছিল অন্যরকম এক সময়। ফলে বইমেলা সব অর্থেই এক নতুন পদক্ষেপ। পাঠক-লেখক-প্রকাশকের মিলন ক্ষেত্র হিসেবে ধারণাটাও নতুন। বইমেলার এই যে নানা রঙের বর্ণালি, তার আলোয় মুগ্ধ হয়ে ওঠেন পাঠক। এই মুগ্ধতাটুকু পাঠকের যেমন পাওনা, তেমনই লেখক-প্রকাশকেরও। কিন্তু পাওনাগণ্ডা, হিসেবনিকেশের বাইরেও একটা জিনিস থেকে যায়, তা হল সম্পর্ক। গোড়া থেকেই যে-কথাটা বলে এ-লেখা শুরু করেছিলাম, সেই কালি-কলম-মন-এর অঙ্ক, তা যেন কেমন করে মিলেমিশে যেতে থাকে বইমেলার মাঠে। সারা বছরের প্রতীক্ষা, সমস্ত বছরের উদ্যম আর কর্মদ্যোগ– সব মিলিয়ে এ এক তুমুল হইহল্লা। এক আশ্চর্য ধরনের উৎসব যাপন। সম্পর্কের আশ্চর্য সমীকরণও বটে। লেখক লেখেন, প্রকাশক প্রকাশ করেন, পাঠক পড়েন– সব মিলিয়ে এক বহতা ব্যাপার। এই চলমান স্রোতের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে চলতে পেরে একজন প্রকাশক হিসেবে নিজে যথেষ্ট গর্ব অনুভব করি। মানুষ কত কী প্রার্থনা করে জীবনে। বৈভব, সম্মান, আর্থিক সঙ্গতি– কত কী! একজন বই প্রকাশক তার সঙ্গেও হয়তো-বা প্রার্থনা করেন, প্রতীক্ষা করে থাকেন একটি ভালো বইয়ের। যে-ভালো বইটির মধ্যে রয়ে গেছে আগামীর চিহ্ন, পদসঞ্চার।
আমরা যার বই ছাপতে চাই, প্রকাশ করতে চাই ভালো বই– তাঁদের কাছেও বইমেলা প্রকাশের একটা বড় জায়গাও বটে। সেই জায়গাটিকে প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর একটা ব্যাপার, সেটাকে ব্যবহার করার একটা দায়িত্ব প্রকাশকদের থাকে। আমার মনে হয় এই দায়িত্বটা আমাদের যত্নের সঙ্গে পালন করা উচিত।
সে অনেক কাল আগের কথা, যখন প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রস্তাব দিয়েছিলেন– বাঙালিরা গ্রন্থপার্বণ উৎসব চালু করুক। এই পার্বণ উপলক্ষে প্রিয় এবং পরিচিতরা পরস্পরকে বই উপহার দেবেন, নতুন একটা পথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার হবে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই স্বপ্নের সবটা হয়তো সার্থক হয়নি, তবে বইমেলা এসেছে। কলকাতার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবাংলার জেলা-মফস্সলে ছোট-বড় অনেক বইমেলা আজ রীতিমতো জনপ্রিয়। সব মিলে সংখ্যাটা মন্দ নয়, ২০০-র ওপরই হবে। কিন্তু সংখ্যা দেখে বিগলিত হওয়া বিপজ্জনক। কারণ, বেশিরভাগ মেলার উদ্যোক্তাদের শুভেচ্ছা থাকলেও বিক্রির পরিমাণ নিতান্তই কম। বলতে পারেন বইমেলা তো টাকা উপার্জনের জায়গা নয়, গ্রন্থ প্রচার ও প্রসারের সুযোগ। ব্যাপারটা বাইরে থেকে মিষ্টি শোনালেও ভিতরটা ক্রমশই বিস্বাদ হয়ে ওঠবার আশঙ্কা আছে। কারণ, আর পাঁচটা জিনিসের মতোই বইয়ের ব্যবসাতেও সর্বত্রই খরচ ক্রমশ বাড়ছে!
জেলা মেলাগুলোয় নতুন-নতুন পাঠকের সামনে নিজের বই হাজির করতে পারলেও খরচ অনেক। প্রথমত স্টল ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের ভাড়া। সেইসঙ্গে আছে কর্মীদের আসা-যাওয়া ও থাকার খরচ, তাদের পারিশ্রমিক। তারপর বই নিয়ে যাওয়ার ক্রমবর্ধমান খরচ। মেলায় সব বই বিক্রি হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং মোটামুটি একটা আয়োজন করতে হলেও প্রায়ই ৫০-৬০% বই ফিরিয়ে আনতে হয় নতুন করে আবার প্যাকিং করে। প্রায়ই ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রির অবস্থা। জিজ্ঞেস করতে পারেন কেন? এই কারণে যে, মেলায় লোক এলেও প্রকৃত ক্রেতার সংখ্যা বহু জায়গায় আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে। অনেকদিন ভরসা ছিল লাইব্রেরিগুলি, আগে লাইব্রেরিগুলো কলেজ স্ট্রিট থেকে অথবা স্থানীয় বইয়ের দোকান থেকে বই কিনতেন। আজকাল লাইব্রেরি পারচেজ অনেকটা কমে গেছে। আসলে অনেক সময়েই প্রকৃত ক্রেতাকে, অর্থাৎ গ্রন্থপ্রেমীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কলকাতা বইমেলায় একটা ব্যতিক্রমী ভাব এখনও আছে। এখানে লাইব্রেরি চিরকালই অপেক্ষাকৃত কম আসে। কিন্তু মানুষ এখনও পছন্দমতো বই সংগ্রহ করতে আসেন। আমার মনে হয়, বই তখনই বিক্রি হবে যখন বইয়ের কদর থাকবে, বুদ্ধিমান ক্রেতা জানবেন কোনটা পুকুরের জ্যান্ত মাছ আর কোনটা বরফ দেওয়া মাছ। ভালো বই বিক্রি করে পয়সা ফিরে এলে, লেখক-সম্মানিত বোধ করবেন, প্রকাশক আনন্দিত হবে। প্রকাশক লেখককে আবার বলবে আরও লিখুন। এমন একটা পরিস্থিতি হবে যেখানে দু’-পক্ষেরই লাভ। বইয়ের ক্ষেত্রে পক্ষ অনেক, লেখক-প্রকাশক-পুস্তকবিক্রেতা এবং পাঠক। এতগুলো লোক সবাই উপকৃত হবে ভালো বইয়ের ভালো বিক্রি হলে। তা তখনই সম্ভব হবে যখন ক্রেতারা যোগ্য বই কিনে যোগ্য মানুষের গলায় জয়মাল্য পরিয়ে দেবেন, বই বেশি বিক্রি হলে ইউনিট পিছু দাম কমবে। ভালো বিক্রিতে সবারই লাভ। কিন্তু আজকাল সর্বত্র চাপাচাপির ভাব– মেলায় ১০ লাখ সম্ভাব্য ক্রেতা এলেন, কিন্তু তাঁরা ১০ হাজার কেনবার মতো একখানা বাংলা বই খুঁজে পেলেন না– এর থেকে লজ্জার কি থাকতে পারে। ১০ হাজার তো দূরের কথা, তিনহাজার বিক্রির মতো জীবিত বা মৃত লেখক কত জন রয়েছেন, তা আজ বুকে হাত দিয়ে বলা কঠিন।
কলকাতা বইমেলা এখন, শুধু এখন বললে ভুল হবে, বেশ কয়েক বছর ধরেই বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বই-পড়ুয়া বাঙালি, প্রেমিক বাঙালি, তর্ক-করা বাঙালি, নতুন বইয়ের গন্ধে ডুবে থাকতে চাওয়া বাঙালি– সকলেই অপেক্ষা করে থাকেন, বছরের এই ১২টা দিনের জন্য। এ যেন এক নতুন-নবান্ন উৎসব। প্রাণে প্রাণ, জীবনে জীবন মেলানোর পরব। শুধু বাঙালি বা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরাই নন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাবুক ও চিন্তকেরাও উপস্থিত থেকে, বক্তৃতা করে বইমেলাকে একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেন। সত্যি বলতে কি, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে গোটা ব্যাপারটা। বইমেলার মাঠ লাখো-লাখো মানুষের পদচিহ্নে বড় সুন্দর, বড়ই রমণীয় হয়ে ওঠে বছরের এই ১২টা দিন। বই দেখা, বই কেনা আর প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়ার অতুলনীয় জায়গা কলকাতা বইমেলা। যতদিন আমরা এভাবে প্রিয়জনকে বই উপহার দেব, ততদিন বাংলা বইয়ের অস্তিত্ব নিয়ে খুব বড় সংকট দেখা দেবে না।
মনে পড়ছে ১৯৯৭ সালে সেই ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডের কথা। সেদিনের আগুন বইকেও ছাড় দেয়নি। সেই যে বইমেলার ভয়াবহ আগুন, তা থেকে কলিকাতা পুস্তকমেলা (তখন তো তার এই নামই ছিল) আবার পুনরুত্থিত হয়েছে। যেমন করে ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠে ফিনিক্স পাখি, ঠিক সেভাবেই ভস্ম থেকে জেগে উঠেছিল কলকাতা বইমেলা।
যে-যাই বলুক, আমার মনে হয় বাংলায় বইমেলা নতুন এক যুগের সূচনা করেছে। অনেকে আমার সঙ্গে একমত না-ও হতে পারেন, তাঁদের কাছে বিনীতভাবে জানতে চাইব, আর কোন রাজ্যে অথবা পৃথিবীর কোন দেশে শতাধিক বইমেলার আয়োজন হয়? বই বিক্রির ইতিহাসে এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে কিছুতেই ছোট করে দেখা যায় না। অনেকেই বলেন, বইমেলায় মানুষ আসেন, ঘুরে-ঘুরে দেখেন, সবসময় হয়তো বই কেনেন না, কিন্তু বইকে ভালোবাসার একটা নতুন যুগ শুরু হয়েছে। এই ভালোবাসার পূর্ণ সুযোগ কী করে নেওয়া যায়, তা লেখক-প্রকাশক-পুস্তক ব্যবসায়ীদের ভেবে দেখা দরকার।
বাংলা বইয়ের বিক্রি কমছে, বই-দোকানের সংখ্যা কমছে, পাঠকরা বই ছেড়ে মোবাইল আর ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে উঠছে– এসব আংশিকভাবে সত্য হলেও পুরো সত্য নয়। একসময় একই অভিযোগ উঠেছিল রেডিয়োর বিরুদ্ধে, চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে এবং টিভির বিরুদ্ধে।
মোবাইল না ঘেঁটে বই পড়ুন– একথা বললে কে শুনতে যাচ্ছে। কেনই-বা শুনবে। কিন্তু মুঠো ফোন যে-আনন্দ দেয়, অনেক বইমানুষকে তার থেকে বেশি নাড়া দিতে পারে। তেমন বই হাতের গোড়ায় থাকলে বহু মানুষই পাঠক হতে চাইবেন।
একটা অংশের মানুষ বলেন, বাংলায় কিছুই লেখা হচ্ছে না। তাঁরা বোধহয় বই সম্পর্কে খুব একটা খোঁজ-খবর রাখেন না। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যের স্বর্ণযুগ চলছিল যখন বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর থেকে শরদিন্দু, বিমল মিত্র থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র একের পর এক স্মরণীয় বই লিখছিলেন– তখনও শোনা গিয়েছে বাংলা সাহিত্যের কিছুই হচ্ছে না। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও যখন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু লিখছেন তখনও একই ধুয়ো উঠেছে। যখন যাযাবর, মুজতবা আলী, শংকর রম্যরচনায় ভারত জয় করছেন তখনও কিছু মুখে একই কথা উঠেছে। কিছু লোকের এটাই স্বভাব। তাঁরা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে বড় লেখক বলেননি, বিমল মিত্র সমস্ত ভারত জয় করার পরেও এঁদের অভিনন্দন পাননি। সৌভাগ্যের বিষয় এই নিন্দুকদের সংখ্যা তত বেশি নয়। সেইজন্যই লেখকরা এবং আমার মতো প্রকাশকরা আজও বেঁচে আছি। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, বাংলা সাহিত্যের আরও বৈচিত্র্য এবং আরও উৎকর্ষবৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। একখানা ভালো বই লিখতে গেলে বহু সন্ধান ও সাধনার প্রয়োজন হয়। প্রকাশক হিসেবে আমরা এখনও লেখকদের তেমন মদত দিতে পারিনি। পত্রিকার সম্পাদকরাও হয়তো কিছুটা সহায়তা করতে পারেন। কারণ স্রেফ অর্থনৈতিক কারণেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর লোকের সংখ্যা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। আরও কমবে। যে-ভাষায় দুনিয়ায় প্রায় ২৫ কোটির বেশি লোক কথা বলে, সে-ভাষায় আমরা কেন অন্তত ৪০জন সারাক্ষণের লেখককে সব রকমের নিরাপত্তা দিতে পারব না!
আবার, ভালো লিখলেই ভালো বই হয় না, ভালো বই হলে ভালো বিক্রি হয় না। বইয়ের পেছনে অনেক নিঃশব্দ সাধনা থাকে। ভালো সম্পাদনা, ভালো প্রুফ সংশোধন এবং ভালো ছাপানো এবং ভালো প্রচার এ-সবই বিশেষ প্রয়োজন। কেউ-কেউ অভিযোগ করেন বাংলা বইয়ের দাম বেশি। যাঁরা নিয়মিত বই কেনেন তাঁরা জানেন ইংরেজি বইয়ের তুলনায় বাংলা বইয়ের দাম এক চতুর্থাংশ। ভারতীয় ভাষায় বাংলা বইয়ের দাম সবচেয়ে কম। সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে– বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয়নি।
তবে স্বীকার করতেই হবে যে, বিপণনের যুদ্ধে আমরা, বাংলা প্রকাশকরা, এখনও তেমনভাবে নামতে পারিনি। এর জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তার সংকুলান কোথা থেকে হবে তা আমার বুদ্ধির নাগালের বাইরে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়, বাংলা বই বিক্রির দোকান বাড়ানোর বিশেষ প্রয়োজন। পুস্তকমেলা তো ১২ দিনের। বাকি ৩৫৩ দিন কী হবে। স্রেফ মেলার ওপর নির্ভর করে বাংলা প্রকাশনা বেঁচে থাকতে পারে না। অর্থাৎ, আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। বাংলার পাঠকরা যদি বছরে কয়েকখানা বই না কেনেন, বাংলার লেখকরা যদি ভালো-ভালো বই না-লেখেন তাহলে প্রকাশকরা কাকে নিয়ে বেঁচে থাকবেন? অতীতেও বাংলা বইয়ের ওপর অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, আমরা সবাই মিলে তা কাটিয়ে উঠেছি। বাংলা সাহিত্যকে পুরোপুরি খরচের খাতায় তুলে দেওয়াটা অত সহজে হবে না। বাঙালির মনে বই সম্বন্ধে যে গর্ব আছে, যে ভালোবাসা আছে, যে কৌতূহল আছে তা-ই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।
বিনোদন শব্দটি আমাদের জীবনে বহু সময়েই নানারকম মাত্রা নিয়ে হাজির হয়। সেই বিনোদনকে বিপণন করা, সেটাও আধুনিক সময়ের একটি শিল্প বিশেষ। বইমেলা কখনওই নিছক বিনোদনের জায়গা নয়। মানে যে কথাটা বলতে চাইছি তা হল, ‘সাড়ে সাতশো মজা’ নামের যে-ভয়ঙ্কর একটা সর্বগ্রাসী ব্যাপার আমাদের চারপাশে, তার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই বইমেলার। তাহলে কি বইমেলা মানে নিছকই রসকষহীন গুরুগম্ভীর একটা কোনও ব্যাপার স্যাপার? না, সেটাও তো নিশ্চয়ই নয়। বইমেলা আসলে আবিষ্কার, অনুসন্ধান, পরিচয়ের একটা সূত্র হয়ে বারে-বারে আমাদের সামনে আসে। কি সেই আবিষ্কার আর চেনা-পরিচয়ের সূত্র? নতুন লেখক, নতুন প্রকাশক, নতুন পাঠক আসেন বইমেলায়। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে। আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে হয়।
বাংলা বইয়ের বিপণন সমস্যা নিঃসন্দেহেই একটি বড়ো সমস্যা বিশেষ। সেই সমস্যার সমাধান সূত্রও আমাদের ভাবতে হবে। প্রকাশক নিশ্চয়ই চাইবেন তাঁর ছাপা বইটি কেমন করে আরও বেশি-বেশি পৌঁছে যাবে পাঠকের কাছে। এই চাহিদার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। কিন্তু তার জন্যে বইকে নিছক বিনোদনের উপকরণ করলে বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ ঘটে যায়।
সুস্থ আনন্দ, অসুস্থ আনন্দ– এই দুটি কথা বহু বছর ধরেই চালু। তাল বা খেজুরের রস যতক্ষণ না গেঁজে ওঠে, ততক্ষণ তা পানের উপযুক্ত। আর গেঁজে উঠলেই তা তাড়ি। বইয়ের ক্ষেত্রেও প্রকাশকের রুচিটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চারপাশ অনেক সময়েই ঝাপসা, দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে। বইয়ের বিষয়ও তেমনই অপরিচ্ছন্ন হয় অনেক সময়। তার সঙ্গে কুলোর বাতাস হিসেবে জোটে খারাপ ছাপা আর মলাট। এই মলাট বা প্রচ্ছদচিত্রের প্রভাব যে-কোনও একটি বইয়ের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনও বাংলা প্রকাশনা জগতে, কলেজস্ট্রিট পাড়ায় ‘মলাটই ললাট’– এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। অনেকে অবশ্য এর পালটা যুক্তি হিসেবে বিশ্বভারতীর ছাপা রবীন্দ্রনাথের বইয়ের উল্লেখ করে তুলনা দেন। শুধু মাত্র এক রঙা মলাটের ওপর রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখায় (কখনও ওই ছাঁদের হাতের লেখায়) বইটির নাম। সবিনয়ে বলি, রবীন্দ্রনাথ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। অন্য কারও ক্ষেত্রে হলে ব্যাপারটা কতখানি বাস্তবায়িত হত, অর্থাৎ মলাটের ভূমিকাটি পালিত হত ঠিকঠাক, তা নিয়ে সংশয় আছে। থাক সেসব প্রসঙ্গ। আমার মনে হয় বই কখনওই নিছক বিনোদন নয়। এটি শুধু যাঁরা গ্রন্থ রচনা করেন, তাঁদের বিষয় মাত্র নয়। এটি যাঁরা গ্রন্থটিকে ‘জন্ম দেন’, অর্থাৎ প্রকাশকেরা, তাঁদেরও বিষয়। কুরুচিপূর্ণ মলাট অনেক সময়েই বইটির চরিত্র নষ্ট করে। মলাট থেকে ভেতরের লেখালিখি, তার ব্লার্ব, লেখক পরিচিতি, পুস্তক পরিচিতি– সবই হতে হবে সুরুচিপূর্ণ, তবেই না বই হয়ে উঠবে উপহারের, প্রীতি বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম। বছরের পর বছর, পুরুষের পর পুরুষ ধরে সেই বই থেকে যাবে বাড়িতে।
আমরা যারা প্রকাশক তারা তো বইটি ছেপেই খালাস। কিন্তু খালাস হয়ে গেলাম, এই মনোভাব থেকে নিজেদের দূরে রাখাই উচিত। কারণ, একটি ভালো বই তো শুধু মাত্র একটি ভালো বই-ই নয়। তা-ও আসলে ইতিহাস। শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের ইতিহাসে, জ্ঞান আর মেধার ইতিহাসেও বই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নেহাত বিনোদনের জন্য তো রয়েছে অনেক-অনেক মাধ্যম। বইকে সেই নিছক আনন্দ, বীভৎস মজা থেকে বাদ দেওয়াই ভালো বলে মনে হয় আমার। বই হবে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধন। সেই মেলবন্ধনের হাত ধরেই পরম পাওয়া হবে পাঠকের। আর পাঠক পরিতৃপ্ত হলেই কৃতার্থ হবেন লেখক, প্রকাশক। বইয়ের সূত্রেই আমরা খুলে ফেলতে পারব দিনদুনিয়ার হাজারও দরজা। সেইসব দরজার তালা খোলার চাবি হল ভালো বই। গ্রন্থপ্রেম, শুধুমাত্র গ্রন্থপ্রেমই একটি জাতিকে করে তোলে সংস্কৃতিমুখী, শিরদাঁড়া টান করে চলার প্রেরণা দেয়। বইকে যাঁরা নিছক বিনোদনের উপকরণ বা উপাদান মনে করেন, তাঁদের ভুল ভাঙানোর দায়িত্ব সৎ প্রকাশক এবং পাঠকের। আর লেখক তো নিশ্চতভাবেই একটি বড় ভূমিকা পালন করবেন এই ব্যাপারে। সত্য মঙ্গল প্রেম– এই যেসব কথা রয়ে গেছে সাহিত্যের সঙ্গে, তা কেন বারে-বারে ফুটে উঠবে না একটি বই প্রকাশের প্রাণের আবেগে! বইমেলা তাই আমার কাছে মানুষের সঙ্গে থাকা। মানুষকে নিয়ে চলা। কারণ মানবসভ্যতায় বই ও মানুষ চিরকাল পাশাপাশিই চলেছে।
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
……………………ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব……………………
পর্ব ২০: কম বয়সে আমাদের রোববারের আড্ডা ছিল ২৮ নম্বর প্রতাপাদিত্য রোড, আশুদার বাড়িতে
পর্ব ১৯: ‘লেখা বড় হচ্ছে’ অভিযোগ আসায় খুদে হাতের লেখায় পাণ্ডুলিপি দিতেন প্রবোধবন্ধু অধিকারী
পর্ব ১৮: দু’বছরের মধ্যে সংস্করণ না ফুরলে অন্য জায়গায় বই ছাপার চুক্তি ছিল শরদিন্দুর চিঠিতে
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।