তন্ত্রাচারের কালীপুজোর উপাচার হিসেবেই রঘু ডাকাত নরবলি দিতেন বলে জানা যায়। এমনভাবেই একদিন রাস্তা দিয়ে কালীভক্ত রামপ্রসাদ সেন যাচ্ছিলেন। তাঁকেও বলি দেবে বলে ধরে আনে রঘু ডাকাতের দল। বলি দেওয়ার আগে দেবীর সামনে একটি গান গাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি। শোনা যায়, রঘু গান গাওয়ার অনুমতি দিলে, ‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন বদন ভরে মাকে ডাকি’ গানটি গেয়ে শোনান রামপ্রসাদ। কথিত যে, এই সময় বলিকাষ্ঠে রামপ্রসাদের জায়গায় দেবীকে দেখতে পান রঘু ডাকাত। আশ্চর্য হয়ে যান তিনি! তারপর থেকেই নরবলি বন্ধ করে দেন।
অলংকরণ: অঞ্জন বসু
বাংলায় রঘু ডাকাতের মতো এমন ‘বিখ্যাত’ ডাকাত বোধকরি আর তেমন আসেনি। ছোটবেলার ভয়ের জগৎ জুড়ে আজও ঘুরে বেড়ায় রঘুর নানা ছবি। গল্পের ছবি। পেল্লায় বড় দেহ, মস্ত বড় গোঁফ আর মাথায় একটা প্রকাণ্ড পাগড়ি। তবে ‘মানুষ’ রঘু ডাকাতের জীবনের গল্পগুলো এখনও এত বেশি জায়গা দখল করে আছে আমাদের মনে যে, চরিত্রটি বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে প্রায়।
রঘু ডাকাত সম্পর্কিত তাঁর জীবনের গল্প এত বেশি জনপ্রিয় যে, সেখান থেকে আসল গল্পের খোঁজ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্যই। তবু সেই রহস্যের সন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেছি, পড়াশোনা করেছি– তাঁর জীবনের সত্যের সন্ধানে। খোঁজ করেছি তাঁর পরিবার, পরিজন এবং বংশধরদের। তাঁকে নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। অনেক গবেষকই চেষ্টা করেছেন কল্পকথার ফাঁদ ছেড়ে রঘু ডাকাতের আসল কাহিনি খুঁজে বের করতে। রক্তমাংসের রঘু ঠিক কেমন ছিল, তা জানতে। সেসব নিরিখেই রঘু ডাকাতের জীবনকথা জানার চেষ্টা। অধিকাংশ গবেষকের মতে, রঘু জন্মেছিলেন প্রায় ২০০-২৫০ বছর আগে! অষ্টাদশ শতাব্দীর কোনও এক সময়ে। তাঁর ভালো নাম ছিল– রঘু ঘোষ। তবে এই নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে।
সেই সময় বাংলার পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে চলছিল কোম্পানির শাসন। অত্যাচার তখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। বাংলার মাঠেঘাটে, খেতখামারে ধান ফলনের দো-ফসলি জমিতে তখন ইংরেজরা জোরপূর্বক নীল চাষের জুলুম চালাচ্ছে। অত্যাচার চালাচ্ছে গরিবগুর্বো কৃষকদের ওপর। প্রথমে পাঁচ কাঠা, তারপর দশ কাঠা– ক্রমে ক্রমে এভাবেই ফাঁদে ফেলে বাংলার কৃষকদের উপরে নীল চাষের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার ফন্দি করেছিল নীলকর দস্যুরা। সে এক বিরাট চক্রান্ত!
যে সমস্ত কৃষক, কোম্পানির ঠিক করে দেওয়া জমিতে নীল চাষ করতে আপত্তি তুলে গলা ওঠাত– তাদের পেয়াদা দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করত। হত্যাও করা হত। বেদম প্রহার শুধু নয় দুর্বল জায়গায় আঘাত, গৃহ থেকে শিশুদের তুলে নিয়ে গিয়ে মারধোর, নির্মমভাবে অত্যাচার করে পুনরায় বাধ্য করত নীল চাষ করতে। এই নীলকর আর তাদের পেয়াদাদের অত্যাচারে একসময় নাভিশ্বাস ওঠে বাংলার সাধারণ বাঙালি কৃষকদের। এভাবেই বাংলার চারদিকে জ্বলতে শুরু করে অসন্তোষের আগুন।
রঘু ঘোষের বাবা ছিলেন এমনই একজন সাধারণ কৃষক। তিনিও নীল চাষ করতে অবাধ্য হলে নীলকরের পেয়াদারা এক রাতে তাঁকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আর পেয়াদার নির্মম প্রহারে অসহায়ভাবে সেই রাতেই মারা যান তার বাবা! অনেকে অবশ্য বলেন– নীলকর সাহেবরা তাঁকে হত্যা করে। নিষ্ঠুর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি ডাকাতিতে নাম লেখান।
পিতার মৃত্যুর বদলা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন রঘু ঘোষ। ক্রমে গ্রামের লাঠিয়ালদের থেকে লাঠিখেলা শিখে অর্জন করেন বাহুবলের ক্ষমতা। একসময় লাঠিখেলায় তাঁর অসামান্য দক্ষতা দেখে চমকে উঠতেন সবাই। সেই খেলার লাঠিই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার অস্ত্র। শুধু অস্ত্র তুলে নেওয়াই নয়, সেইসঙ্গে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতেও শুরু করেন তিনি। সভা, আলোচনায় উঠে আসে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা।
সেইমতো অস্ত্র তুলে নিয়ে নিজেই এগিয়ে আসেন! তাঁর ডাকে সেদিন অনেক অত্যাচারিত মানুষও সঙ্গী হয়। আরও বহু মানুষকে তিনি সংগঠিত করতে শুরু করেন। দিন দিন ভিড় বাড়তে শুরু করে রঘুর দলে। এভাবেই একদিন তিনি গড়ে তোলেন এক মস্ত লাঠিয়াল বাহিনি। রঘুর সেই লাঠিয়াল বাহিনি নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করে। সেই শুরু আক্রোশের। রঘু ঘোষের এই বাহিনির ক্ষমতা আর লোকবল দিন দিন বাড়তে শুরু করে। সেই সুযোগে দলবল নিয়ে নীলকুঠিগুলোতে লুঠপাট চালান রঘু ঘোষ। জ্বালিয়ে দেন নীলকরদের আস্তানাগুলো। তারপর একদিন হঠাৎ করেই রঘু এলাকার অত্যাচারী জমিদার আর সামন্তদের বাড়িঘর লুঠ করতে শুরু করে দেন। তাঁদের মারধোরও করেন। হইহই পরে যায় চারদিকে! সেই সময় যাঁরাই সাধারণ মানুষের সম্পদকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল তাঁদের বাড়িতেই হানা দেয় রঘু ঘোষের দল। লুঠপাটের পর সেই সমস্ত লুঠের জিনিসপত্র নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাগ করে দিতেন বাংলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে।
এভাবেই ধীরে ধীরে রঘু সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সে কালের সমাজে রঘু ঘোষ হয়ে উঠেছিলেন একইসঙ্গে প্রতিবাদ আর ন্যায়বিচারের মূর্ত প্রতীক। অন্যদিকে জমিদার আর নীলকরদের কাছে তিনি ছিলেন লুটতরাজকারী এক ভয়ংকর ডাকাত। ঘন ঘন ছদ্মবেশ ধরতে পারতেন। তাঁর নানারকমের বাহিনি ছিল। মহিলা ও পুরুষের আলাদা আলাদা বাহিনি নিয়ে তিনি ডাকাতি সাম্রাজ্য চালাতেন। নীলকর সাহেবদের আক্রমণে তার পিতাকে খুন হতে হয়েছিল। নির্মম মৃত্যুর সেই ঘটনা একজন সাধারণ মানুষ থেকে রঘু ঘোষকে করে তুলেছিল ইতিহাসের বিখ্যাত ‘রঘু ডাকাত’।
বাল্যকালে কোলের ছেলেদের ভয় দেখানো থেকে শুরু করে, মারদাঙ্গা, হত্যার মতো ঘটনায় কোনও মানুষের উদাহরণের পরিচয়ে ‘রঘু ডাকাত’ নামটা বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সেই কবে থেকে। আজও রঘু ডাকাতকে নিয়ে নানা গল্পের খোঁজ পাওয়া যায়। কখনও তিনি গরিবের বন্ধু, আবার কখনও নরবলির বিভীষিকাময় গল্পের এক খলনায়ক।
এক সময় ব্রিটিশদের তোষণকারী ধনী লোকদের ধরে ধরে তাদের সম্পদ লুঠ করেছেন রঘু। আর এই সব লুঠের মাল তিনি বিলিয়ে দিতেন গরিব-দুঃখী কৃষকদের মাঝে। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাংলার রবীন হুড, গরীবের ত্রাতা।
সে সময় গোটা বাংলার বিভিন্ন জেলায় ডাকাতদের ভয়াবহ উপদ্রব ছিল। ডাকাতদলের ধারাবাহিক অত্যাচারে বহু গ্রাম উঠে গিয়েছিল। ভয়ংকর হত্যাকারী সেইসব ডাকাতের দলকে দূর করতেই সেই সময় ইংরেজ শাসক প্রত্যেক থানা এলাকায় ডাকাত ধরার আলাদা আলাদা দপ্তর তৈরি করেছিল। শাসক ইংরেজদের এই কৌশলও কাজে আসেনি।
এলাকায় এলাকায় পুলিশের প্রভাব বাড়তে শুরু করলে ডাকাত রঘু আর তার ভাই বিধুভূষণ ঘোষ দেবীপুরের পাশে এক গভীর জঙ্গলের গোপন ডেরায় আশ্রয় নেয়। পুলিশের অত্যাচারে শেষপর্যন্ত জঙ্গলের ভেতরেই গ্রাম তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় রঘু। রঘুর নির্দেশে রাতের অন্ধকারেই গ্রামে নিয়ে আসা হয় পাঁচ ব্রাহ্মণ পরিবারকে। রঘুর তৈরি সেই গ্রামের নাম ছিল নিশিনগর। পরে অবশ্য সেই গ্রামের নাম পালটে যায়। গ্রামের নতুন নাম হয় নিশিরাগড়।
তবে বাংলার এই পরাক্রমশালী ডাকাত রঘুর সঙ্গে দেবী কালীর নাম জুড়ে আছে প্রায় সব গল্পেই। শোনা যায়, ডাকাত রঘু স্বপ্নে দেখেন দেবী কালীকে। রঘু ডাকাতের প্রায় সব গল্পেই মা কালীর এক বিশেষ অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। রঘু ডাকাত নিজেই ছিলেন কালীর একনিষ্ঠ ভক্ত। একদিন তিনি পুকুরঘাটের পথ ধরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ তিনি দু’টি পাথরের মূর্তি দেখতে পান। একটি ছিল মহাদেবের, অপর পাথরটিকে তিনি চিনতে পারেননি তেমনভাবে। তবে নিশ্চিতভাবে সেটা ছিল কোনও দেবীমূর্তি, তা অনুমান করেন। সেই রাতেই রঘু ডাকাত স্বপ্নে দেখেন– কালীর দেবীমূর্তি তাঁকে আদেশ করছে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার জন্য। কালবিলম্ব না করে সেই মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন রঘু ঘোষ। কালীপুজোর ভোগ হিসেবে দেবীকে উৎসর্গ করা হত রঘুর প্রিয় ল্যাটামাছ পোড়া। শুধু তাই নয়, আরও জানা যায়, তার নিত্যসঙ্গী অমিয় কালীর পুজো করতেন নিয়মিত। সেই মহাভোগ খেয়েই ডাকাতির জন্য বেরতেন রঘু ডাকাত।
রঘুর আদর্শে পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্থানেই এখনও কালীপুজোর ভোগ হিসেবে ল্যাটামাছ পোড়া খাওয়ানো হয়। কালীর বরেই ক্রমশ পরিচিতি লাভ করেন রঘু। বাংলার বাইরেও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। রঘু ডাকাত একসময় ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে জমিদারদের কাছে চিঠি পাঠাতেন। চিঠি দিয়ে ডাকাতি! এমনই ছিল রঘু ডাকাতের সাহস। তবে তার আগে ছদ্মবেশে কেউ সেখানে গিয়ে রেকি করে আসত। ডাকাতিতে এসব প্রথা রঘুরই তৈরি। রঘুর বিশ্বাস ছিল দেবী কালীর পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে গেলে কখনও ধরা পড়বেন না তিনি। সেই বিশ্বাসেই কখনও ধরা পড়েননি তিনি!
অসীম সাহসী এই ডাকাতকে নিয়ে নানা গল্পগাথা ছড়িয়ে রয়েছে। পুলিশ নিয়েও এক মজার কাহিনি শোনা যায়। তাঁকে ঘিরে উপদ্রব তখন তুঙ্গে। নৈহাটি থানার বড়বাবু সেসময় দুর্গাচরণ চক্রবর্তী। দুর্গাচরণের সঙ্গে সুখসাগরের জমিদারের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। ফলে জমিদারের কথায় রঘু ডাকাতকে ধরার একটা মস্ত বড় চাপ ছিল তার মাথার ওপর। এদিকে রঘুর তখন কোনও পাত্তা নেই। কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না তাকে। হঠাৎ একদিন বড়বাবু একটি চিঠি পেলেন। মুক্তাক্ষরে লেখা সে চিঠি। তাতে লেখা, ‘দারোগাবাবু, আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছি। ইতি রঘু ঘোষ’।
দারোগার তো চক্ষু চড়কগাছ। রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সদরে খবর দিয়ে থানার সেপাই বাড়ালেন তিনি। আঁটসাঁট করে ফেললেন সবকিছু। ভয় পেয়ে গেছেন দারোগাবাবু, এবার যে করেই হোক রঘুকে ধরতেই হবে! এসবের মাঝেই একদিন এক জেলে এল দুটো বড় রুইমাছ হাতে ঝুলিয়ে। সিপাই গিয়ে দারোগাবাবুকে জানালেন, জমিদারবাবু পাঠিয়েছেন তাকে। সেই সঙ্গে একটা চিঠি। চিঠির ভাষ্য ছিল এই যে, ‘দারোগাবাবু, পৌত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে আমার পুষ্করিনীতে মাছ ধরেছিলাম। আপনি আসতে পারবেন না জানিয়েছিলেন। তাই দুটি মাছ আপনার জন্য লোক মারফৎ পাঠালাম। লোকটি আমার বিশ্বস্ত প্রজা।’ এমন চিঠি পেয়ে দারোগাবাবু খুশি হয়ে জেলেকে দু’টাকা বকশিস দিয়ে বিদায় করলেন। কিছুদিন পর দারোগার কাছে আরেকটি চিঠি এল। লাল কালিতে লেখা সে চিঠি।
তাতে লেখা, ‘দারোগা বাবু, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে আসব। সেদিন দেখা করে এসেছি। মাছ কেমন খেলেন? ইতি সেবক রঘু ডাকাত’!
এভাবেই বার বার পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে, ভাগ্যের অসীম সহযোগিতায় চলতে থাকে রঘুর ডাকাতির সাম্রাজ্য। নিজের নীতিতে অবিচল ছিল রঘু। নারী, শিশুদের পাশাপাশি অসহায় মানুষদের কোনওভাবেই আক্রমণ করত না রঘুর দল। রঘু ডাকাতি করত শুধুমাত্র অত্যাচারী মানুষদের ঘরে। তবে তার নীতি ছিল, ডাকাতি করতে গিয়ে ঘরের মেয়েদের সে রাখত একেবারে নিরাপদে। ডাকাতির শেষে লুঠের মালপত্র ভাগ করে দিত অসহায় মানুষের মাঝে। তাই সেকালের বাংলার অসহায় মানুষের এক তীব্র আবেগ ছিল রঘু ডাকাতের প্রতি। সেই আবেগই ঢাল হয়ে রক্ষা করত রঘু ডাকাতকে।
এতসব ভালোর মাঝেও একটা খারাপ ব্যাপার ছিল রঘু ডাকাতের। কালীর পুজোর অংশ হিসেবে নরবলি দিতেন তিনি। গভীর রাতে ঢাক, ঢোল বাজিয়ে মানুষ ধরে এনে বলি দিতেন কালীর কাছে। কার্তিকের অমাবস্যার তিথিতে পুজো দেবার জন্য রাস্তা দিয়ে যে-ই যেত তাকেই ধরে এনে বেঁধে রাখা হত মন্দিরের চাতালে। তন্ত্রাচারের কালীপুজোর উপাচার হিসেবেই রঘু ডাকাত নরবলি দিতেন বলে জানা যায়। এমনভাবেই একদিন রাস্তা দিয়ে কালীভক্ত রামপ্রসাদ সেন যাচ্ছিলেন। তাঁকেও বলি দেবে বলে ধরে আনে রঘু ডাকাতের দল। বলি দেওয়ার আগে দেবীর সামনে একটি গান গাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি। শোনা যায়, রঘু গান গাওয়ার অনুমতি দিলে, ‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন বদন ভরে মাকে ডাকি’ গানটি গেয়ে শোনান রামপ্রসাদ। কথিত যে, এই সময় বলিকাষ্ঠে রামপ্রসাদের জায়গায় দেবীকে দেখতে পান রঘু ডাকাত। আশ্চর্য হয়ে যান তিনি! তারপর থেকেই নরবলি বন্ধ করে দেন। শুরু করেন পাঁঠাবলি।
লোক-ইতিহাসের পাতায় রঘু ডাকাতের নামডাকে এখনও ভাটা পড়েনি। তাঁকে নিয়ে লেখা হয় গল্প, তাঁর নামে এখনও রাতে ছেলে ঘুমায়, দাপুটে লোকেরা নিজেদের পরিচয় দেয় রঘু ডাকাতের বংশধর হিসেবে। বাংলার এই ভয়ংকর জনপ্রিয় রঘু ডাকাতের বাড়ি ঠিক কোথায় ছিল? এই প্রশ্নের জবাবে ঐতিহাসিকদের একটু বিব্রত হতে হয়। প্রকৃতপক্ষে, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময় হুগলি, বর্ধমান, নদিয়া, বারাসাত, চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, এমনকি খোদ কলকাতাতেও অসংখ্য ডাকাতের উপদ্রব ছিল। সেসময় বাংলার অন্ধকারময় শাসক ডাকাতদের হাতেই ছিল অর্ধেক বাংলার শাসন। সাধারণ মানুষ তো বটেই, জমিদাররাও এই সব ভয়ঙ্কর ডাকাতদের ভয়ে তটস্থ থাকত।
তবে শাসকদের ভয়ে ডাকাত দলেরও স্থায়ী নিবাস নির্ধারণ করা ছিল দুষ্কর। সেই কারণেই রঘু ডাকাতের নিবাস নির্ধারণ করা কঠিন। বহুরূপ ধরা রঘু পালিয়ে বেড়াত। এক স্থান থেকে আরেক স্থান। আর এভাবেই গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পরতে থাকে রঘু ডাকাতের শক্তি আর জনপ্রিয়তা। প্রকৃতপক্ষে, রঘু ডাকাতকে ঘিরে বাংলায় কল্পকথা এত বেশি ডানা গজিয়েছে যে, তার কিংবদন্তি তাকেই ছাড়িয়ে গেছে। সেই কারণে যেটা তার নয় সেটাও ঘাড়ে এসে পড়েছে কিছুক্ষেত্রে। কলকাতার পূর্ণদাস রোডের কালীমন্দিরের কথাই ধরা যাক। এই মন্দিরে এক ফুট উচ্চতার ছোট্ট একটি কালীমূর্তির পুজো করতেন মনোহর ডাকাত। তবে মনোহর ডাকাতের নামে নয়, এখনও লোক সেটাকে চেনে রঘু ডাকাতের কালীবাড়ি বলে। এরকম অসংখ্য কালীমন্দির রয়েছে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম আর হুগলি জেলায়। প্রতিষ্ঠাতা অন্য কেউ হলেও লোক এই মন্দিরগুলোকে চেনে রঘু ডাকাতের কালীমন্দির নামেই। এর মধ্যে কিছু কিছু মন্দির আবার ৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো। তাই সময়ের হিসেবে সেসব রঘুর হবার যুক্তি মেলে না। কিন্তু এমন হতেই পারে যে, পুলিশের তাড়া খেয়ে সেই সব মন্দিরে হয়তো-বা কখনও রঘু এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
নিজের মা তীর্থমণির নাম অনুসারে বাড়িটির নাম রাখেন 'তীর্থ নিবাস'। এই তীর্থ নিবাসে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আনাগোনা ছিল। হঠাৎ হঠাৎ বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস তাঁর ‘শান্তিসেনা’ নিয়ে চলে আসতেন দুপুররাত্রে ঝিলটুলিতে, সকলের খাওয়ার রান্না একহাতে করতেন মৃণাল সেনের মা সরযূবালা সেন।