ভারতবর্ষে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে, হাঁচি ছিল হাড় অপয়া। যদি বাড়ি থেকে বেরনোর আগে বা পুজোর সময় হেঁচে ফেলতেন, তাহলে মনে করা হত পরমেশ্বর বলছেন, ‘থামো, সময় খারাপ!’ ঠিক যেন মহাজাগতিক ঘড়িতে একটা ত্রুটি, দুর্ভাগ্যের কালো পর্দা নেমে আসছে সরসর করে। তাই জল খেয়ে মুহূর্তটা ‘রিসেট’ করতে হত, তখন পরমেশ্বর নিশ্চয়ই আবার হাসতেন। ধরা যাক, বিয়ের জন্য কেউ তৈরি, সবে আগুনে খই ফেলবে বর কনে আর ঠিক সেই সময় হঠাৎ হাঁচি! সেটা যে কারওরই হোক না কেন, দম্পতির খই ফেলা কিন্তু থেমে যাবে নইলে ভাগ্যের চাকা যদি ভবিষ্যতে আটকে যায় পুরুতমশাই তার দায় নেবেন না কানাকড়ি।
১১.
হাঁচি একটা সাধারণ ব্যাপার, নাকের সুড়সুড়ি থেকেই হঠাৎ হ্যাঁচ্চো! কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানা দেশে বেচারা এই হাঁচিকেই অপয়া বলে মনে করা হয়েছে। কখনও ভাবা হয়েছে এতে আত্মা পালিয়ে যায়, কখনও রোগের ভয়, কখনও গুজবের আঁচ।
আজকের ইরাকের মাটিতে ছিল প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, যেখানে হাঁচি ছিল ভয়ের কারণ। পুরোহিতরা মাটির ফলকে হাঁচির কথা লিখত ডিটেলে, যেমন করে ভবিষ্যৎবাণী লিখে যান ত্রিকালোজ্ঞরা। তাঁরা ভাবত, হাঁচি মানে দেবতারা রেগে গেছেন, বা আত্মা নাক দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে! কল্পনা করুন, আপনি একটা মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন, আর হঠাৎ হাঁচি! যেন আপনার আত্মা, একটা সাদা ধোঁয়ার মতো, নাকের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। ‘এনলিল’ নামের প্রাচীন দেবতা ভুরু কুঁচকে তাকালেন, দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ গজিয়ে উঠল তাঁর ইচ্ছায়। এই ভাবনা নিছক হাসির খোরাক হলেও হাঁচি ঠিক এইভাবেই অপয়া হয়ে উঠেছিল সেই তখন থেকেই, কারণ মেসোপটেমিয়ার মানুষের কাছে প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনা ছিল দেবতার ইশারা।
চিনে হাঁচির গল্প শুরু হয় প্রায় ৩,০০০ বছরেরও কিছু আগে। ‘বুক অফ সংস’ নামের একটা কবিতার বইয়ে লেখা আছে, হঠাৎ হাঁচি মানে কেউ আপনার পিছনে খারাপ কথা বলছে। এক্ষেত্রে হাঁচি ছিল স্যাটেলাইটের মতো। মানে ধরুন গ্রামের মোড়ে কেউ গুজব ছড়াচ্ছে, আর আপনার নাক সেই খবরটা ধরে ফেলল, সিগন্যাল– হ্যাঁচ্চো। এটা অপয়া, কারণ চিনে সম্মান ব্যাপারটা ছিল বড় কথা, আর গুজব সেই সম্মানে দাগ ফেলতে পারে।
……………………………….
মধ্যযুগে উত্তর ভারত আর বাংলায় এই প্রথার ঘনঘটা কিছু কম ছিল না। এমনকী, আজও বাড়ি ছাড়ার আগে কেউ হাঁচলে সিনিয়ররা বলেন, “দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে যা, জল খেয়ে নেয়ে একটু!” এই অশুভ ধারণা এসেছে ধর্মীয় প্রথার শুভ সময়ের গুরুত্ব থেকে, যেখানে বেচারা হাঁচি একটা অপয়া বাধা।
………………………………..
টাং রাজবংশে (৬১৮–৯০৭ খ্রি.) কিন্তু হাঁচি আরও বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে। সম্রাটের মা যদি হাঁচতেন, সব মন্ত্রী চিৎকার করে বলত, ‘দীর্ঘজীবী হোন!’ যেন হাঁচি একটা বিপদের ঘণ্টা, তাড়াতাড়ি আশীর্বাদ না বললে অসুখ বা দুর্ভাগ্য দরজায় কড়া নাড়বে। চিং রাজবংশে (১৬৪৪-১৯১২ খ্রি.) হাঁচির নিয়ম আরও জটিল। এক হাঁচি মানে গুজব, অপয়া; দুই হাঁচি মানে কেউ আপনাকে মিস করছে; তিন হাঁচি মানে কেউ প্রেমে পড়েছে। কিন্তু নববর্ষের আগের রাতে হাঁচি? তাহলে তিনটে পরিবারের কচ্ছপ-আকৃতির কেক খেতে হত। এই কেকগুলো ছিল জাদুর ঢাল, অশুভকে তারা দূরে ঠেলে দেয়। মোদ্দা কথা, চিনে হাঁচি ছিল সমাজের আয়না, যেখানে সম্মান, আচার, আর সংখ্যার খেলা সব মিলেমিশে ঘর করত।
ভারতবর্ষে, খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে, হাঁচি ছিল হাড় অপয়া। যদি বাড়ি থেকে বেরনোর আগে বা পুজোর সময় হেঁচে ফেলতেন, তাহলে মনে করা হত পরমেশ্বর বলছেন, ‘থামো, সময় খারাপ!’ ঠিক যেন মহাজাগতিক ঘড়িতে একটা ত্রুটি, দুর্ভাগ্যের কালো পর্দা নেমে আসছে সরসর করে। তাই জল খেয়ে মুহূর্তটা ‘রিসেট’ করতে হত, তখন পরমেশ্বর নিশ্চয় আবার হাসতেন। ধরা যাক, বিয়ের জন্য কেউ তৈরি, সবে আগুনে খই ফেলবে বর কনে আর ঠিক সেই সময় হঠাৎ হাঁচি! সেটা যে কারওই হোক না কেন, দম্পতির খই ফেলা কিন্তু থেমে যাবে নইলে ভাগ্যের চাকা যদি ভবিষ্যতে আটকে যায় পুরুতমশাই তার দায় নেবেন না কানাকড়ি।
মধ্যযুগে উত্তর ভারত আর বাংলায় এই প্রথার ঘনঘটা কিছু কম ছিল না। এমনকী, আজও বাড়ি ছাড়ার আগে কেউ হাঁচলে সিনিয়ররা বলেন, “দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে যা, জল খেয়ে নেয়ে একটু!” এই অশুভ ধারণা এসেছে ধর্মীয় প্রথার শুভ সময়ের গুরুত্ব থেকে, যেখানে বেচারা হাঁচি একটা অপয়া বাধা।
প্রাচীন গ্রিসে আবার হাঁচি কিন্তু বেশিরভাগ সময় শুভই ছিল। হোমারের ওডিসিতে টেলিমাকাসের হাঁচি মানে দেবতারা ওডিসিয়াসের প্রতিশোধের পক্ষে। জেনোফনের অ্যানাবাসিসে এক সৈনিকের হাঁচি ছিল যুদ্ধে জিউসের আশীর্বাদ। কিন্তু ভুল সময়ে হাঁচি অবশ্য অশুভ হতে পারত। গ্রিকরা ভাবত, সর্দি-কাশি ছাড়া আলটপকা হাঁচিতে আত্মার একটা অংশ একটু একটু করে বেরিয়ে যায়, তাই বলত, ‘জিউস রক্ষা করুন!’ যেন আত্মাটা ফিরে আসে।
রোমানরা গ্রিসের ধারণাটাই আপন করে নিয়ে হাঁচিকে দেবতার চিহ্ন মানত। কাটুলাসের কবিতায় এক প্রেমিকের হাঁচি মানে প্রেমের দেবতার সমর্থন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে হাঁচি যদিও শুভ ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর ছিল বড় একটা ঝুঁকি। রোমানরা তখন অগত্যা ব্যাপারটাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে ঝুঁকিটা কোনওমতে ভোলার চেষ্টা করত। হাঁচি ছিল আসলে একটা দুই ধারের তলোয়ার– শুভ বা অশুভ, সময়ের ওপর নির্ভর করে।
হিব্রু প্রথায়, তালমুদিক নথি বলে, জাকোবের সময়েরও আগে হাঁচি ছিল মৃত্যুর পথ। অনেকটা রোমানদের মতোই তারা বিশ্বাস করত– আত্মা যেহেতু শ্বাসের সঙ্গে যুক্ত, তাই হ্যাঁচ্চো মানে তার নাক দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। একটা হাঁচি, আর জীবনের কিছুটা আয়ু শেষ। এই ভয় ইহুদিদের মধ্যে হাঁচিকে গভীরভাবে অপয়া বলে দেগে দিয়েছিল, কারণ এটা ছিল জীবন-মৃত্যুর মাঝে একটা ভয়ংকর সেতু।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে– ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড সব জায়গাতেই হাঁচি অশুভ হয়ে ওঠে প্লেগের জন্য। জাস্টিনিয়ানের প্লেগ (৫৪১-৫৪৯ খ্রি.) আর ব্ল্যাক ডেথ (১৩৪৭-১৩৫১ খ্রি.)-এ হাঁচি ছিল মৃত্যুর ঘণ্টা। এক হাঁচি মানেই গ্রামের সবাই ভাবত, ‘এবার শেষ!’ পোপ গ্রেগরি দ্য গ্রেট (ষষ্ঠ শতক খ্রি.)-এর হাত ধরে ‘গড ব্লেস ইউ’ শুরু হয় তখন থেকেই। এই বাণীর মানে ছিল শয়তান যেন গডের ব্লেসিং-এর বলয় ভেঙে আত্মা চুরি করতে না পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি প্রথায় অশুভ হাঁচিকে শুভ করার ফিকির বলা আছে। ব্যাপারটা সহজ, হাঁচিদাতার ‘আল্হামদুলিল্লাহ’ আর অন্যদের ‘ইয়ারহামুক আল্লাহ’ পিঠোপিঠি বলে নিলেই সব দোষ কেটে যাবে। তবে ভুল হলে ওপরওলার অসন্তোষ বা আধ্যাত্মিক সমস্যা হতে পারে ঘোরতর। আসলে হাঁচি সেখানে একটা মূল্যবান মুহূর্ত, অবহেলা করলেই বিপদ। এটা অন্য সংস্কৃতির অশুভ ধারণার সঙ্গে যদিও পরোক্ষভাবে মিলে যায়।
পোল্যান্ডে, ক্রেসি ওস্তোচনি অঞ্চলে, হাঁচি ব্যাপারটা সংসারীদের জন্য খুব অপয়া। কেউ হাঁচল মানেই ধরে নেওয়া হয় শ্বশুর বা শাশুড়ি খারাপ কথা বলছে, বা অবিবাহিতদের জন্য ভবিষ্যৎ শ্বশুর-শাশুড়ি। বিষয়টা এই অঞ্চলের পারিবারিক সম্পর্কের ভূমিকাকেই তুলে ধরে, যা আজও টিকে আছে। ব্যাংকস আইল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের মাওরিদের মধ্যে, হাঁচি তখনই অপয়া যখন কেউ ক্ষতির উদ্দেশ্যে কারও নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে হেঁচে ফেলল। সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে ক্ষতি কেউ ঠেকাতে পারবে না আর।
উনিশ শতকের স্কটল্যান্ডে, ‘মাউন্টেন বার্ড’ বলে, ঘুম থেকে উঠে হাঁচি মানে অচেনা লোক আসবে, এবং তা হবে অপয়া। শেটল্যান্ড ও ওয়েলসে আবার বেড়ালের হাঁচি, তুষার বা ঠান্ডা বাতাস ডাকত। পূর্ব এশিয়ায়– জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনামে হাঁচি অপয়া এবং তা গুজবের সঙ্গে জড়িত। একটা হাঁচি মানে খারাপ কথা, দুটো হাঁচি মানে আরও খারাপ। চিনা কুসংস্কার থেকে এসে এ ব্যাপারটা মাঙ্গায় ঢুকে যায়।
আসলে হাঁচির অপয়া গল্প হাজার বছর ধরে চলছে। মেসোপটেমিয়ার দেবতার ভয়, ইউরোপের প্লেগের আতঙ্ক, ভারতের আচার ভঙ্গ, পোল্যান্ডের শাশুড়ির গুজব। প্রতিটি দেশের গল্প তার ইতিহাস আর সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে দেখায় শুভ ধারণা থাকলেও, অশুভ বিশ্বাস কীভাবে টিকে আছে। মানুষের সাধারণ একটা নাকের সুড়সুড়িতে পয়া-অপয়ার চান্স থমকে আছে। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা
১৯০২ থেকে ১৯৪০ মহারাজ কৃষ্ণরাজা মাইসোরে রাজত্ব করেছেন। বলা হয় মাইসোরের স্বর্ণযুগ। কৃষ্ণরাজা ছিলেন খাদ্যরসিক। তাঁর রসনাতৃপ্তির কাজে সদা তৎপর মাডাপ্পা নিত্যনতুন খাবার তৈরি করতে গিয়ে, একদিন জন্ম হল মাইসোর পাকের– যা অচিরেই হয়ে উঠল ভারতবর্ষ নামটার সঙ্গে জুড়ে থাকা সমস্ত খাবারের মধ্যে একটি।