নবাদা ইবনে বতুতার সঙ্গে এসেছিল চাকরি খুঁজতে। তারপর কেন্দ্র কিছু না দেওয়ায় বাকিদের মতো ওর ভাগ্যেও কিছু জোটেনি। সকলে বেকারের খাতায় নাম লেখালেও, নবাদা ‘নির্বেকারের’ লিস্টির পয়লা নম্বরে স্বমহিমায় লিডার স্থলভুক্ত হল। ভাবখানা, ‘লেঃ, কী করবি কইরা দ্যাহা।’ বিশ্বাসযোগ্যতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল কে জানে, তবে সেই সময়ে লোকে এতখানি ফেরেব্বাজ ছিল না।
২২.
ছেলেবেলার উড়ে এসে জুড়ে বসাদের নিয়ে আলাদা একখানা বই লিখব ভেবেছি অনেকবার জানি না হয়ে উঠবে কি না। পাছে মিস হয়ে যায়, তাই সুযোগ পেলাম যখন, তখন নবাদার গল্প বলেই ফেলি। ভাই ভাইস্তা কার ঠিক কেমন আদৌ হতেন, বা খানিকটাও হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কি না মহাপুরুষটি, সে বিষয়ে কারও নিশ্চিত ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। বেলাদির দূরসম্পর্কের মামা হওয়ার ক্ষীণ চান্স থাকলেও, তারকবাবুরা ‘পিতাজিকা ইন্তেকাল’ বলে, বা এলটিসি নিয়ে বেড়াতে গেলে ওদের বাড়িতে রাতপাহারায় শুতেন এবং নিজের ইচ্ছেমতো আলমারি থেকে টাকাপয়সা বের করে বাজারের বড় মাছ, মুরগি রেঁধে-বেড়ে ভোজ চালাতেন দু’বেলা। যাদবজির বউমা যেবার অন্তঃসত্ত্বা, তিনদিন অন্তর ট্রেন ধরে নানারকমের ওষুধ-তাবিজ থেকে আচার, আমসত্ত্ব, এবং গণ্ডা-গণ্ডা ক্ষুদে-ক্ষুদে উলের সোয়েটার মোজা টুপি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও বর্তায়। টাইফয়েডের ফলে পরপর দু’বার মাধ্যমিক দিতে না পারায় নগাই ছিল নবাদার এই ট্রিপগুলোর পারমানেন্ট সঙ্গী– ওয়েদার চেঞ্জ নাকি এ রোগে মহৌষধ! তবে একবার বউমার এক ভাইঝিকে প্রায় হাফ-অন্তঃসত্ত্বা করে দিচ্ছিল বলে মহৌষধির ডোজ কমাতে হল। সে অবিশ্যি অন্য গল্প।
সন্ধেয় ফুটবল খেলার পর মাঠে গোল হয়ে বসলে নগা ট্রেনযাত্রার গল্প শোনাত। ততদিনে ও সিগারেট খায়। অসমের জঙ্গলে হালকা সবুজ চিতাবাঘ, ভুটান পাহাড়ের আগুন ওগড়ানো ড্র্যাগন টাইপের শকুন, নরখাদক নেপালি সন্যিসি, এবং টাকা ডবল করার সহজ অথচ অজানা তিব্বতি উপায় সম্পর্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা বলে যাওয়া ওর পক্ষে কোনও ব্যাপারই ছিল না। আমরা হাঁ করে শুনতাম। মনে রাখবেন, এসবই ইন্টারনেটের বহুযুগ আগের কাহিনি। তখন কেউ না চাইতেই বিয়েতে সাইকেল এবং রেডিও পেলে নিজেদের সেরাজদোল্লা ভাবত, নেমন্তন্ন বাড়িতে হাতে মুগুর টাইপের পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে যাওয়া ছিল ভয়ানক গর্বের ব্যাপার, এবং যাদবজির বুড়ি পিসিমা টেলিফোনে দিল্লিবাসী ছেলের গলা শুনে আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। অতএব সুন্দরী মহিলা দেখলে মাথায় ‘হাওয়া মেঁ উড়তা যায়ে, মোরা লাল দুপট্টা মলমল কা’ ইত্যাদি গান না খেললে সত্য-মিথ্যা সম্পর্কিত ফালতু তর্কে ঢুকবেন না।
যাই হোক। নগা প্রতিবার ট্রেনযাত্রার আগে দু’তিনটে নতুন লাল-নীল বুদিটার, চকরাবকরা শার্ট উপহার পেত, ফেরার সময়ও কখনও নতুন ব্যাট, হকিস্টিক, এবং আরও নানারকম-সহ নামত। আমরা নিয়মমাফিক ওকে স্টেশনে রিসিভ করতে যেতাম, তাই আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছি এবং ও গাছের গায়ে হেলান দিয়ে কিং-সাইজ ক্যাপস্টানের ধোঁয়া উড়িয়ে ক্যারিবিয়ানদের হাতে অস্ট্রেলিয়ার কচুকাটা হওয়ার গল্প শোনাত। টেরিফিক সময় ছিল বটে সেটা!
নবাদা পাল্টায়নি। সকালে যে-বাড়িতে ঘুম ভাঙে, সে-বাড়িতে পয়লা কাপ চা এবং খবরের কাগজটি আদ্যপান্ত পড়া হলে পরপর বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু সব রকমের সংবাদ রেডিও-তে একটানা শোনা চাই। এর অনেকটাই খোট্টার দোকানে খুঁটিতে হেলান দিয়ে সকালের জমায়েতে এলাকার খবর খুঁটিয়ে জোগাড় পর্বের অংশ। তারপর কানে রেডিও সেঁটে বড় রাস্তা ধরে হাঁটা লাগিয়ে সকলের দরকার-অদরকারের খোঁজ নেওয়া রুটিন। দুপুরে কোথাও একটা উচ্ছেভাজা, ডাল, তরকারি, মাছ অথবা মাংস দিয়ে খাওয়া সেরে চাটনির বাটিতে চুমুক মেরে বলত ‘ও আফনেরা কিস্সু ভাইবেন না, আমি অদ্যই রাতের ট্রেইনে রওয়ানা দিতাসি, আফনে টিকিট কাটাইয়া স্ট্যাশনে লুক খাড়া কইরা রাইখেন, দ্যান, এক ফিস সন্দ্যাশ দ্যান।’ তারপর বিকেল অবধি ঘুমিয়ে, সন্ধেয় জিনিসপত্র গুছিয়ে, পাঁচবাটির টিফিন ক্যারিয়ার, সাইডব্যাগ, এবং নগাকে বগলদাবা করে বাচ্চু সিং-এর জিপগাড়ি চেপে এনজেপি। ওখানে তো চা-ওলা থেকে বুড়ো সেপাই অবধি সবাই বুজুমফ্রেন্ড। সবাই চা খাওয়ায়, সবাই বলে ‘আসাম মেঁ বহুত ঠান্ডা, মেরা কম্বোল লে যাও।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………
যাদবজির বউমা যেবার অন্তঃসত্ত্বা, তিনদিন অন্তর ট্রেন ধরে নানারকমের ওষুধ-তাবিজ থেকে আচার, আমসত্ত্ব, এবং গণ্ডা-গণ্ডা ক্ষুদে-ক্ষুদে উলের সোয়েটার মোজা টুপি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও বর্তায়। টাইফয়েডের ফলে পরপর দু’বার মাধ্যমিক দিতে না পারায় নগাই ছিল নবাদার এই ট্রিপগুলোর পারমানেন্ট সঙ্গী– ওয়েদার চেঞ্জ নাকি এ রোগে মহৌষধ! তবে একবার বউমার এক ভাইঝিকে প্রায় হাফ-অন্তঃসত্ত্বা করে দিচ্ছিল বলে মহৌষধির ডোজ কমাতে হল। সে অবিশ্যি অন্য গল্প।
……………………………………………………………………………………………………………………………………
নবাদা ইবনে বতুতার সঙ্গে এসেছিল চাকরি খুঁজতে। তারপর কেন্দ্র কিছু না দেওয়ায় বাকিদের মতো ওর ভাগ্যেও কিছু জোটেনি। সকলে বেকারের খাতায় নাম লেখালেও, নবাদা ‘নির্বেকারের’ লিস্টির পয়লা নম্বরে স্বমহিমায় লিডার স্থলভুক্ত হল। ভাবখানা, ‘লেঃ, কী করবি কইরা দ্যাহা।’ বিশ্বাসযোগ্যতা কীভাবে তৈরি হয়েছিল কে জানে, তবে সেই সময়ে লোকে এতখানি ফেরেব্বাজ ছিল না। নগা যেমন এই ট্রিপগুলোয় নিজেও আলাদা কনট্রাক্ট নিত, মহিলা ছাড়া বাকি সব বিষয়েই লোকের ভরসা ছিল ওর ওপর– ‘নবার লগে যাইতাসে, অসুবিধা নাই।’ নবাদা মহিলাদের সস্নেহে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেও, স্টেশনের বাইরে পা রাখত না। একবার এক নববিবাহিতাকে তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় গ্রামের লোকের সম্মিলিত আক্রমণের ফলে মাস তিনেক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর মাঝে দোদুল্যমান হয়ে কাটাতে হয়েছিল। আসলে সেই মেয়েটিকে তার বর পেটায় খবর পেয়ে গ্রামের লোক সিদ্ধান্ত নেয়, ‘একবার হাতের নাগালে পাইলে হালারে জোতাইয়া উচিত শিক্ষা দিমু।’ দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর নবাদা ফেরার পথ ধরেছে… তা, গ্রামে চটি, জুতো ইত্যাদি পাদুকার নিদারুণ অভাবজনিত কারণে খেঁটো-বাঁশ, চ্যালা-কাঠ দিয়ে সে যাত্রা শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর কাজে গ্রামীণ সমাজ ঝাঁপায়– প্রথম ভাগ শেষ হওয়ার আগেই মেয়ের বাড়ির লোক উদ্ধার না করলে এই কিস্তির লেখা অর্ধসমাপ্ত কেন, ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর চেয়ে সম্পাদক মশাই নির্ঘাত আমায় নাহক দু’কথা শোনাতেন… সে যাক!
কিছুকালের মধ্যেই নবাদার সঙ্গে দুরদুরান্তের পল্লি সমাজগুলির আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বলে নেওয়া দরকার, মহিলাদের স্টেশন অবধি পৌঁছনোর ধনুকভাঙা পণ ছাড়াও কখনও শিকারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে নবাদা একরকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞই ছিল। একসময় নিজেই চায়ের আড্ডায় চাকরির প্রসঙ্গে যেমন বলেছিল, ‘করুম না হালায় তগো ইসে’, তেমনিই একবার পাল ডাক্তারের সঙ্গে শিকার থেকে ফিরে দুয়ার এঁটেছিল বহুদিন। ঘটনাটা আদতে খুবই সামান্য। তখনকার দিনে এর-তার বন্দুক ধার করে প্রায়ই শিকারে যেত লোকজন। একবার যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হতে যাদবজির ছেলে নিজের একখানা জংলাপ্যাটার্ন কামিজ দিলে ‘পড়ে ফ্যালেন কাকা, ক্যামোফ্লেইজ়।’ তারপর তিস্তা তীরবর্তী অরণ্যের দ্বিপ্রাহরিক আলোছায়ায় পাল ডাক্তার ওকে ময়ূর বা উটপাখি জাতীয় কিছু একটা (রোস্ট হয় গোছের) ভেবে, দে দনাদ্দন গুলি ছুড়তে শুরু করেন। নবাদার বক্তব্য ‘হালায় বুইরা ব্যাডা, একনাগাড়ে দশ বারো বছর দাবায় হাইরা ক্ষেইপ্পা গিয়ে জ়ঙ্গলে একা ফাইয়া অ্যাকশনে মাইরা ফালানের ছান্স নিসিলো। উডফাখি ঠাখি সবোই ডাইর্যাক্ট মিথ্যা– তরা দেহিস, হ্যার রিভেইন্জ় আমি নিমুই।’
নগা এর মধ্যে সাবকন্ট্রাক্ট বিলোনো শুরু করেছে। দু’তিনজন দায়িত্বে ছিল, কাজ ধরে দিলে কমিশন পাবে। নবাদা মাইন্ড করত না। তবে একবার পশুপতিনাথে এক বুড়িকে নিয়ে গিয়ে অন্য একটাকে ফিরিয়ে আনায় নগার ওপর হিউম্যান অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজব্যান্ড্রির দায়িত্ব এলাকার লোক কখনওই নিশ্চিন্তে ছাড়তে পারেনি। নগা উদাস হয়ে বলেছিল, ‘ঘুমের ঘোরে অন্য ঘর থেকে বডি তুলে এনেছি বুঝলাম পানিট্যাঙ্কি পেরিয়ে। এরা যে মাল ফেরত নেওয়ার সময় এত খুঁটিয়ে চেক করবে তাও বুঝিনি। বুড়ি দু’টোর মধ্যে কিন্তু সেরকম কোনও ডিফারেন্স নেই…।’
…ভয়বাংলা-র অন্যান্য পর্ব…
ভয়বাংলা পর্ব ২১: তোমরা কথায় কথায় এমন পুলিশ ডাকো কেন?
ভয়বাংলা পর্ব ২০: ‘মালদা এলে ডেকে দেবেন দাদা, আমার আবার ভোরবেলাতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা ওব্বেস’
ভয়বাংলা পর্ব ১৯: দর্শকরা দ্রুত ঐতিহাসিক থেকে পৌরাণিকে সুইচ করতে পারত
ভয়বাংলা পর্ব ১৮: বাঙালি কি আদৌ জানে তালেগোলে সে কী হারাইয়াছে?
ভয়বাংলা পর্ব ১৭: বাঙালি জীবনের ভেজিটেরিয়ান হওয়ার ভয়
ভয়বাংলা পর্ব ১৬: বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও যারা রাবীন্দ্রিক বাংলায় কথা কইত, তারা মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৫: গুষ্টিসুখের প্লেজারই অর্জি-নাল সিন
ভয়বাংলা পর্ব ১৪: কৈশোরে জাতের খোঁজ কেউ কখনও নিয়েছে বলে মনে পড়ে না
ভয়বাংলা পর্ব ১৩: নবনাৎসিগুলোর কাছে আর একটু সফিস্টিকেশন এক্সপেক্ট করেছিলাম মশাই
ভয়বাংলা পর্ব ১২: রাজসভায়, থুড়ি, লোকসভায় কেবল পাশা-খেলাটুকু হবে
ভয়বাংলা পর্ব ১১: আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে
ভয়বাংলা পর্ব ১০: ভূতেরাও ঢিল ছোড়ে, মানুষও রেডি রাখে পাথরের স্টক
ভয়বাংলা পর্ব ৯: চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’-এর খুদে স্টোনম্যান জানলার শার্শি ভেঙেছিল খাবার জুটবে বলেই
ভয়বাংলা পর্ব ৮: ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা লোকেদের সংখ্যা আশ্চর্যরকম বৃদ্ধি পেল
ভয়বাংলা পর্ব ৭: প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট
ভয়বাংলা পর্ব ৬: হাতের নাগালে একখানা জলজ্যান্ত বন্দুক চালানো লোকই ছিল সহায়
ভয়বাংলা পর্ব ৫: স্টোনম্যানের একটুকরো খুনে স্টোন বাড়িতে থাকলেই সর্বরোগ থেকে মুক্তি!
ভয়বাংলা পর্ব ৪: ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর
ভয়বাংলা পর্ব ৩: বাঙালি ভূত-পেতনিরাও ভারি শুচিবায়ুগ্রস্ত!
ভয়বাংলা পর্ব ২: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
ভয়বাংলা পর্ব ১: বাঙালির ভূতের ভয় যেন উত্তম-সুচিত্রার মতোই সাংস্কৃতিক