হেয়ার পিন বাঁকগুলোর কাছে হঠাৎ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু, হেডলাইট জ্বেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই। আমরা চলেছি লাভার পথে, কানাঘুঁষোয় শুনছি, ওই দিকেই শুটিং হবে। রাস্তার যা অবস্থা লাভা পৌঁছতে পৌঁছতেই তিনটে বেজে গেল। ভাত আর মুরগি ঝোল অর্ডার দিয়ে ঋতুদা বেরিয়ে পড়ল জায়গা খুঁজতে।
১৯.
পাহাড়ের ঠিকানায় ফোটে রডোডেনড্রন। একরাশ লাল-টুকটুকে স্বপ্ন সাজিয়ে ধর্মতলার বাস-গুমটি থেকে আমাদের বাস ছাড়ল। ‘আমাদের’, মানে সেকেন্ড ক্লাস এডি-দের বাস। যাঁরা সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, তাঁরা আগেই পৌঁছে গিয়েছেন। সে দলে আছে মন্টুদা– মানে সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ মানে রাণা গুহ, সুদেষ্ণা রায় এবং আরও কেউ কেউ। জুনিয়র এডি-র যে টিমটা যাচ্ছে আমি ছাড়া সেখানে রয়েছে সারণ দত্ত, রাজীব। সারণ যেহেতু স্বরূপ দত্ত-র ছেলে, ছোটবেলা থেকে ইন্ডাস্ট্রি চেনে। অন্যদিকে ডাকাবুকো রাজীব, সুদেষ্ণা-রাণাদার অ্যাসিস্ট্যান্ট, কাজেকর্মে চৌকস।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনিল আচার্যর ‘বইমেলাধুলো’: অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র-কে লিটল ম্যাগাজিনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাসের আলোচনায় যা বুঝছিলাম, বাকিদের তুলনায় ফিল্মিল্যান্ডে আমি একটি গবেট বিশেষ। সারণের সঙ্গে চট করে বেশ জমে গেল, বোঝা গেল এ যাত্রায় এ-ই হবে আমার রুমমেট! সিনেমার অজস্র খবর রাখে, তখনই একটা চিত্রনাট্যের অর্ধেক লিখে ফেলেছে। রাজীব আর সারণের একটা জায়গায় মিল– দু’জনেই থ্রিলার বানাতে চায়, তবে রাজীবের পছন্দ অ্যাকশন প্যাকড ফিল্ম। ওর যা চেহারা, অনায়াসে নিজেও যে অ্যাকশনে নামতে পারে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
লাঞ্চের সময় আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, গাড়ির ভেতর স্বকুঘো– আরে স্বপনকুমার ঘোষ এখানে এলেন কীভাবে! ওঁর হাঁকডাক প্রতাপ দেখে বুঝলাম, এ ইউনিটে উনি একজন কেউকেটা বিশেষ, ঋতুদা ছাড়া কাউকেই পোঁছে না। সারণ বলল, ‘উনি প্রোডাকশন ম্যানেজার, সব ওঁর হাতে।’ সব মানে? মানে সব ব্যবস্থাপনা। তুই চিকেন খাবি না পায়রা– ওঁর ডিসিশন। তুই এসি না ডর্মেটরি– সেটাও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমাদের সেই রাত্রির জার্নিটা একেবারে নিরুদ্দেশ যাত্রার মতো! তিনজন এডি চলেছে, যাঁদের চোখে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন। এর অনেক বছর পর একজন রাজীব থেকে হয়ে উঠবে রাজীব কুমার– বাংলা কমার্শিয়াল ছবির অন্যতম সফল পরিচালক হবে। সারণ দত্ত তাঁর নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে মর্জিমাফিক ছবি বানাবে, তৃতীয় এডি-র অবস্থা সবচেয়ে কনফিউজিং। সিনেমা বানানোর শখ আছে ষোলোআনা, কিন্তু কিসুই জানে না। সারণ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বলিয়ে-কইয়ে, ভুরু-টুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘কীর’ম ছবি বানাতে চাস তুই?’’ উত্তর যাতে না দিতে হয়, সেজন্য জানলার বাইরে অন্ধকারটার দিকে আরও মনোযোগ দিয়ে চেয়ে থাকি। অন্ধকার অচেনা গাছপালাগুলো দেখি রকেটের গতিতে ফ্রেম পাল্টাচ্ছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
হিরণ মিত্রর ‘বইমেলাধুলো’: এই বইমেলায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গলায় মিনিবুক ঝুলিয়ে ফেরি করতেন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভেবেছিলাম, পৌঁছেই ঋতুদার সঙ্গে দেখা হবে। শিলিগুড়ি নেমে বুঝলাম, ডিরেক্টর ঋতুদা সহজলভ্য নয়। এত বড় একটা ইউনিট একটা হোটেলে রাখা সম্ভব নয়। ফলে মোট তিনটি হোটেলে আমরা ছিলাম। প্রিমিয়াম হোটেল যেটি, নতুন হওয়া, নাম ‘ম্যানিলা’, সেখানে পরিচালক-সহ মূল টিম, অপর্ণা সেন ও পরিবার এবং সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী! আমরা তার পাশের গলিতে, একটু অপরিচ্ছন্ন একটা হোটেলে। আমাদের হোটেলে ‘স্টার’ বলতে, ঋতুদার ভাই চিঙ্কুদা। শিলিগুড়ি পৌঁছেই দেখা হল চিঙ্কুদার সঙ্গে, মাথায় একটা শেরিফ হ্যাট, চোখে সানগ্লাস। ‘এসে গ্যাচো, বেশ করেচো’, বলে অভ্যর্থনা জানাল। বাসে কাল সারারাত বিরক্তিকর ঘুম হয়েছে, ফলে ভাবছিলাম স্নানটান সেরে একটু লম্বা হওয়া যায় কি না! কিন্তু চিঙ্কুদার হুকুম ছিল, ‘এক্ষুনি রেডি হও সবাই, রেকি যেতে হবে।’ শব্দটা আমার কাছে নতুন। সারণ সব জানে। বলল, যেসব লোকেশনে শুটিং হবে, সেই জায়গাগুলো পছন্দ করতে যাওয়াকে বলে রেকি। আমার তো আসা ইস্তক মাথার ভেতর একটাই প্রশ্ন, কেন এসেছি? ঋতুদাকে চেনা ছাড়া আদৌ কি আর কোনও যোগ্যতা আছে আমার? রেকি যেতে হবে শুনে মনে হল, যাক বাবা, ইউনিটে তাহলে আমি গুরুত্বপূর্ণ কেউ!
একইদিনে পাহাড়ে উঠে আবার নেমে আসতে হবে, তাই এত তাড়াহুড়ো। কোনওমতে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে উঠলাম। তিনটে গাড়ি যাচ্ছে, সামনেরটায় ঋতুদা, দূর থেকে দেখতে পেয়ে একবার হাত নেড়েছে শুধু। ঋতুদার গাড়িতে রয়েছে অভীকদা, মানে অভীক মুখোপাধ্যায়, একটু একটু করে যাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।
যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা। হেয়ার পিন বাঁকগুলোর কাছে হঠাৎ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে সবকিছু, হেডলাইট জ্বেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই। আমরা চলেছি লাভার পথে, কানাঘুঁষোয় শুনছি, ওই দিকেই শুটিং হবে। রাস্তার যা অবস্থা, লাভা পৌঁছতে পৌঁছতেই তিনটে বেজে গেল। ভাত আর মুরগি ঝোল অর্ডার দিয়ে ঋতুদা বেরিয়ে পড়ল জায়গা খুঁজতে।
আমরা তিনজন এলাম বটে, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম রেকিতে না এলেও চলত। যেহেতু ডিরেক্টোরিয়াল টিম, সেইজন্য পরিচালকের লগে লগে সব জায়গায় যাওয়ার পারমিশন আছে। লাঞ্চের সময় আর একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, গাড়ির ভেতর স্বকুঘো– আরে স্বপনকুমার ঘোষ এখানে এলেন কীভাবে! ওঁর হাঁকডাক প্রতাপ দেখে বুঝলাম, এ ইউনিটে উনি একজন কেউকেটা বিশেষ, ঋতুদা ছাড়া কাউকেই পোঁছে না। সারণ বলল, ‘উনি প্রোডাকশন ম্যানেজার, সব ওঁর হাতে।’ সব মানে? মানে সব ব্যবস্থাপনা। তুই চিকেন খাবি না পায়রা– ওঁর ডিসিশন। তুই এসি না ডর্মেটরি– সেটাও।
স্বকুঘো এমনিই সিনিয়র সাংবাদিক, এর পর থেকে ওঁকে আরও সমীহের চোখে দেখতে শুরু করি। রেকি শেষ হওয়ার পর ঋতুদা আবার অন্য মানুষ। ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলতে লাগল জোরকদমে। চলন্ত গাড়ি যেন ঋতুদার বাড়ির ড্রইংরুম। ফেরার পথে ঋতুদার ইচ্ছেতেই আমরা তিনমূর্তি খোদ পরিচালকের সুমোয়। আমাদের জায়গা মিলেছে পিছনে। সারণ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খাবি? আমি ‘যা আছে তাই’ বলায় প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে খিস্তি দিল। ‘কী মাল খাবি বল?’ আমি বললাম, ‘তোরা যা খাবি।’ এসবের মাঝে আবার একটা কাণ্ড ঘটল! গাড়িটা পাহাড়ের জ্যামে আটকে। কিছু কলেজের ছেলেছোকরা হঠাৎ আমায় চিনতে পেরে ‘আরে, চন্দ্রবিন্দুর ছেলেটা, চন্দ্রবিন্দুর ছেলেটা’– বলে চিৎকার করতে লাগল। সবাই প্রাণপণ হাসল। এরপর থেকে বাকি শুটিং জুড়ে ইউনিটে আমার নাম হয়ে গেল, ‘চন্দ্রবিন্দুর ছেলেটা’।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?