গোটা ইউনিট দেখলাম ওকে ‘কাঁকন’ বলে ডাকছে। ঋতুদা সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল কাঁকনকে। বলল, কলকাতায় এই মুহূর্তে চলছে ওঁর প্রথম ছবি সুব্রত সেনের ‘এক যে আছে কন্যা।’ বক্স অফিসের হিসেব অনুযায়ী, সে ছবি হিট করেছে, ফলে সকলে অভিনন্দন জানাও। গোটা ইউনিট হাততালি দিল। ভয় ভয় মুখে একচিলতে হাসির আভা দেখা গেল। সেই মুহূর্ত থেকে তিতলির সঙ্গে কাঁকনের ভাবও হয়ে গেল।
২১.
মিঠুন আসার পর শিলিগুড়ি শহরে এক অভিনব কাণ্ড হল। গোটা শহর অচল হয়ে গেল মিঠুনকে দেখার জন্য। মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে অমন উন্মাদনা আমি কলেজে থাকতে দেখেছি, এসেছিল স্কটিশের সোশ্যালে, এমন ধামাকা হয়েছিল নেতাজি ইন্ডোর জুড়ে, ত্রাহি ত্রাহি রব। এত বছর বাদেও সেই একই জনপ্রিয়তা দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। ঋতুদা মিঠুনকে নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে গেল, আমাদের ভুলেই গেল। সারণ দাঁতে দাঁত চিপে বলল, পাহাড়ে না ওঠা অবধি এই হুজ্জোতিটা চলবে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, কারণ পাহাড়ে এক্ষুনি উঠছি না। শুটিং চালু হবে সমতল থেকে, তারপর পাহাড়। হান্সকোয়া টি-গার্ডেনে প্রথম পর্বের শুটিং। চা বাগানের বাংলোটা দীপঙ্কর দে, অপর্ণা সেনের বাড়ি। আমি এর আগে কখনও চা বাগানের ভিতরে যাইনি। পুরনো সাহেবি কায়দায় অমন যে বাংলোবাড়ি হতে পারে, ধারণাই ছিল না। প্রথম যেদিন চা বাগানের ভেতর গেলাম, অসম্ভব একটা ভালোলাগা তৈরি হচ্ছিল, চাপ চাপ সবুজের মধ্যে থেকে ফুলের মতো জেগে আছে মেয়েদের মুখ, পিঠে তাদের বেতের ঝুড়ি। শিলিগুড়ির ওই অগাধ ভিড়ভাড়াক্কার বাইরে কেমন যেন একটা মুক্তির গন্ধ।
শুটিংয়ের কাজ বিভাজন করে দিল ঋতুদা। সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্টের পাশাপাশি আমাদেরও। রাজীব ক্ল্যাপস্টিক দেবে, শটের হিসেবনিকেশ, সারণের ভাগে পড়ল কন্টিনিউটি, আর আমার ভাগে লবডঙ্কা। ঋতুদা বলল, অনিন্দ্য একেবারে নতুন, ও নিজের মতো অবজার্ভ করুক, কোনও বেখাপ্পা কিছু দেখলে সরাসরি পরিচালককে বলবে। শুনে মনে হতে পারে বিরাট দায়িত্ব আমার। কিন্তু আসলে কোনও কাজ নেই। রেইকির পর কন্টিনিউটি শব্দটা শিখলাম। এগুলো শুটিংয়ের ডিকশনারিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপার। চিত্রনাট্যের ক্রম মেনে তো আর শুটিং হয় না। শুটিং হয় লোকেশনের ক্রম মেনে। মানে, ওই যে বাংলোতে আমরা কাজ করছিলাম, ওখানকার যত সিন আছে, এই শিডিউলটায় তা তুলে ফেলা হবে। ফলে ১ নম্বরের পর হয়তো ১৩ কিংবা ৫৬। এই দৃশ্যগুলোর পোশাক, পজিশন, হাতের মুদ্রা, প্রপস– এই সব নোট করে রাখার কাজটাই হল কন্টিনিউটি দেখা। হালে, ডিজিটাল ক্যামেরা এসে যাওয়ার পর সব শটের ফোটো তুলে রাখা যায়। ‘তিতলি’ তেমনভাবে হয়নি। ওল্ড স্কুল মেথড, নোটবুক ও পেন্সিল। বাংলোর চেহারা, আদবকায়দা ও আসবাব দেখলে মনে হত, সময় যেন থেমে আছে এ বাগানে। আধুনিক প্রযুক্তিবিলাস বলতে একটিই– মহার্ঘ্য কম্পিউটার। ম্যানেজারের কন্যার ব্যবহারের জন্য। যেহেতু শুটিংয়ের লোকেশন থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম– অন্যান্য কিছুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল বাংলোয় থাকা ওই মেয়েটির সঙ্গে। স্বচ্ছন্দে সে আমায় তার কম্পিউটার ব্যবহার করতে দিয়েছিল। কিছু জরুরি মেল আমি করে ফেলতে পেরেছিলাম তারই সহায়তায়। আমার একটা-আধটা গান সে শুনে থাকবে। সেই জন্য এতসব। বাংলোর ঠিক বাইরে ছিল ফলের ভারে নুয়ে থাকা এক লিচুগাছ। গাছ থেকে পেড়ে লিচু– সেই প্রথম। ইউনিটের লোক লুকিয়ে লিচু পেড়ে নিচ্ছে দেখে মেয়েটি এসে বলে গিয়েছিল, যার যা ইচ্ছে নিতে পারে, লুকোনোর কোনও দরকার নেই। একটা শুটিং তো আর শুধু শুটিংয়ের জন্য মনে রাখে না কেউ। আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবই এক-একটা আলাদা সিনেমা।
অপর্ণা সেনও সপরিবারে পৌঁছে গেলেন শিলিগুড়ি। এই ছবির শুটিংয়ের দু’-এক বছর আগেই তাঁর বিয়ে হয়েছে কল্যাণ রায়ের সঙ্গে। সেই প্রেমের দিনলিপি আমাদের ঠোঁটস্থ। ফলে শুধু অপর্ণা নন, কল্যাণ রায় আছেন এই প্রথম কোনও শুটিংয়ে। হইচই ফেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার।
এছাড়া আসছে কঙ্কনা, অপর্ণার কন্যা, শুনেছি সে না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে। প্রথম দেখে তাই মনেও হল। চোখেমুখে একটা চাপা টেনশন রয়েছে মেয়েটার। গোটা ইউনিট দেখলাম ওকে ‘কাঁকন’ বলে ডাকছে। ঋতুদা সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল কাঁকনকে। বলল, কলকাতায় এই মুহূর্তে চলছে ওঁর প্রথম ছবি সুব্রত সেনের ‘এক যে আছে কন্যা।’ বক্স অফিসের হিসেব অনুযায়ী, সে ছবি হিট করেছে, ফলে সকলে অভিনন্দন জানাও। গোটা ইউনিট হাততালি দিল। ভয় ভয় মুখে একচিলতে হাসির আভা দেখা গেল। সেই মুহূর্ত থেকে তিতলির সঙ্গে কাঁকনের ভাবও হয়ে গেল। প্রথম শটের কথা মনে আছে। কীর’ম করবে এতবড় অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের মেয়ে, কৌতূহল ছিল সবার। শটের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কাঁকনের আসার নাম নেই। পরে জানা গেল, শরীরটা খারাপ, তাই টয়লেটে ছিল। ঋতুদার মুখে হাসি। প্রথম প্রথম তো এই টেনশনটা হবেই। কয়েক দিনের পর থেকেই বোঝা গেল, এ মেয়ে কতটা অন্যরকম অভিনেত্রী।
ক’টা দিন যেতে না যেতেই কাঁকনের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গেল আমার। কোথা থেকে ও জেনেছে, ‘চন্দ্রবিন্দু’ বলে একটা দলে আমি আছি। প্লিজ আমাকে একটু ‘রিস্কাওলা’ শোনাও। পাহাড়ি রাস্তায় লম্বা সফরে এমন অনুরোধে গাইব না, এমন পাষণ্ড নই। অপর্ণা সেন গান শুনে অবাক হয়ে বললেন, এসব গান ওদেরই লেখা? কাঁকন বলল, অফকোর্স। ওরা তো একটা ব্যান্ড।
সারণ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কাঁকন কী করে জানল রে তোদের গান? উত্তরটা আমারও জানা ছিল না বলে, একদিন সত্যিটা জিজ্ঞেস করলাম। কাঁকন ঠোঁট উল্টে বলল, ওমা আমি আর দাদু তো তোমাদের ‘বাথরুমটা কি তোর বাবার’ খুব শুনি। দাদু মানে? চিদানন্দ দাশগুপ্ত।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?