নিয়মকানুন মনে রাখার ক্ষেত্রে সুপারস্টারের মেমরি যথেষ্ট সিরিয়াস নয়। মানে সবাই যখন অতুল্য ঘোষ-রবিশঙ্কর-সুনীল গাভাসকার-ওয়াহিদা রেহমান বলছে, মিঠুনদা বললেন, ব্যাঙাচি! সবাই হইহই করে উঠল। মানুষের নাম, মানুষের নাম। মিঠুনদা খুব সিরিয়াস অথচ মজা করার মতো মুখ করে বললেন, তাহলে ক্ষুর ন্যাপলা। রিনাদি রেগে গিয়ে বললেন, ‘মিঠুন, এ কি কোনও বিখ্যাত লোক? মিঠুনদা ততোধিক সিরিয়াস।
২৩.
শুটিংয়ে ‘কলটাইম’ ব্যাপারটা খুব পাংচুয়াল। আগের দিনের টিম মিটিংয়ে পরিচালক সিদ্ধান্ত নেন পরদিনের কলটাইম কী হবে। যেহেতু বিকেল তিনটের পর আর শট নেওয়া যায় না আলোর অভাবে, ফলে রোজদিনই আর্লি কলটাইম। ৫টা-৬টা বা ৪টে-৫টা। প্রথমটা টেকনিশিয়ান ও আর্টিস্টদের, দ্বিতীয় সময়টা বাকি ইউনিট। শীতের জায়গায় ভোর ৫টায় উঠে পড়া বেশ শক্ত। তবে প্রত্যেকদিনই উঠে একবার বাইরের দিকে তাকালে মন-টন পরিষ্কার হয়ে যায় পাহাড়ি আকাশের মতো। কুয়াশা নেই, গোপন অস্তিত্ব ঠেলে জেগে উঠছে ঘুমপাহাড়। কোনও কোনও দিন একটু হাঁটতে বেরতাম। ব্রেকফাস্টের ক্যাঁচর-ম্যাচর পেরিয়ে, নির্জন ভেজা-পথে।
এমনই একটা দিন উল্টোদিক থেকে দেখি, কল্যাণ রায় হেঁটে আসছেন। ভদ্রলোককে নিয়ে এমনিই কৌতূহলের শেষ ছিল না। গ্রিসে গিয়ে গ্রিক পড়ান গ্রীষ্মে– এমন পণ্ডিতকে নিয়ে বন্ধুমহলে মিথ-এর শেষ নেই। কল্যাণদা দেখা হতে ব্যারিটোনে একটা ‘ক্কী’ ছাড়লেন। আমি ওই দাপুটে উপস্থিতির সামনে মিইয়ে গিয়ে ‘এমনিই একটু হাঁটছি’ বলে পালিয়ে যাচ্ছিলাম। উনিই ডেকে কথা বললেন অনেক। জানলাম, শুটিং দেখার অভিজ্ঞতা তাঁরও এই প্রথম। হাতে একটা পেপারব্যাক, নামটা অনেকক্ষণ ধরে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। শেষে উদ্ধার করলাম, সুচিত্রা ভট্টাচার্য। যাক বাবা! এই ফাঁকাফুকো জায়গায় লাকা-ফুকো পড়ছেন না তাহলে!
গপ্পবাজ, সুরসিক এই মানুষটার সঙ্গে সেই সকালে হঠাৎ করেই বেশ ভাব হয়ে গেল। আপনার কী’রম লাগছে শুটিং? কল্যাণদা অনেকক্ষণ ভেবে বললেন, ‘ইন্টারেস্টিং’। এই গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি তখনও আমাদের সাংস্কৃতিক বলয়ে অতটা বহুল ব্যবহৃত ছিল না। আমার মানুষটিকেও, ওই, যাকে বলে ‘ইন্টারেস্টিং’ লেগেছিল খুব।
শুটিং চলছে জোর গতিতে। ডিওপি অভীক মুখোপাধ্যায়ের যা স্পিড, শিডিউলের আগে ছবি শেষ না হয়ে যায় না! এই ব্যস্ততাবাজির ভিড়ে আমার অবস্থাটা অনেকটা কল্যাণদার মতো। ইতিউতি ঘুরি। দুটো ফুট কাটি, আবার কেটে পড়ি নিজের মতো। মিঠুনদা, রিনাদির (তখনও এই নামে ডাকি না) একটা দৃশ্যে বেশ ক্যাচাল হচ্ছিল। শটটা ছিল, বহুদিন পর দেখা হওয়া প্রেমিকার জন্য প্রেমিক একলাফে গাছ থেকে ফুল পেড়ে তাকে চমকে দেবে। ফুল্লকুসুমিত তেমন একটা গাছের নীচেই শুটিং চলছিল। মিঠুনদা এমনিতেই অনেকটা লম্বা, ফলে হালকা লাফ দিলেই ফুল হাতে চলে আসবে। বাস্তবে যা অনায়াসে করা সম্ভব, ক্যামেরা অন হলে সেই সামান্য কাজই ঝামেলার হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন! মানে যেখানে ফুল, তার থেকে একটু আগে লাফালেন। পরেরটায় সেই রোষে ডালপালা সমেত নামিয়ে আনলেন। এখন দেওয়ার কথা একটি ফুল, সেখানে পুরো গন্ধমাদন তো টেনে আনা চলে না, হাজার হোক প্রেমের দৃশ্য। এ’রম চলতে থাকল। শুটিংয়ে এরম গেরো হয় মাঝে মাঝে। খুব সহজ একটা কাজ ততটা সহজ আর থাকে না। মিঠুনদার লাফ এবং ইউনিটের লাফসোস যুগপৎ জারি রইল কিছুক্ষণ। রিনাদি চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মুখে অপার বিস্ময়ের হাসি সাজিয়ে। বেশ কয়েকবার হওয়ার পর তিনিও বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘মিঠুন ঠিক করে কর না, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব।’ মিঠুনদার এবার একটু গায়ে লাগল। বম্বের সুপারস্টার বলে কথা! একটু চুপ করে থেকে রিনাদির দিকে তাকিয়ে বললেন, “রিনাদি দু’-দুটো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড আছে। চিন্তা কোরো না, পেরে যাব।”
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার একরাশ কুয়াশা, মেঘ, বিরক্তিকর বৃষ্টি। রিনাদি উদ্যোগ নিলেন, সকলে মিলে একসঙ্গে কিছু করার। কী না মেমরি গেম খেলা হবে। মনটা খুশি হয়ে গেল। কলেজ লাইফের পর আর খেলা হয়নি। কে কে খেলবেন? ঋতুদা, অভীকদা, কল্যাণদা, রিনাদি, সারণ, আমি। রিনাদি বললেন, ‘অ্যাই মিঠুনকেও ডাক না।’ আমরা কয়েক রাউন্ড খেলার পর মিঠুনদা এসে যোগ দিলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অধিকাংশ দিনেই লাঞ্চ ব্রেক হতে হতে বিকেল হয়ে যেত। ফলে লাঞ্চ এবং প্যাক আপ একসঙ্গেই হত। পাহাড়ে শুটিংয়ের সময় এতই কম, যে লাঞ্চের সময়টা নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না! মুশকিল হচ্ছে, খিদে পেলে এ নির্জন এরিয়ায় কোনও দোকান নেই। যেহেতু লাভা তখনও অতটা টুরিস্টি নয়, ফলে দু’-একঘর ঘুপচি ডেরা থাকত। সেখানে একটা জিনিস খেতে শিখেছিলাম। ইয়াকের দুধ জমিয়ে বানানো সাদা-চৌকো মতো একটা টফি, ও জিনিস খেলে গরম লাগে, পাহাড়ি লোকেরা নিয়ম করে খায়।
শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার একরাশ কুয়াশা, মেঘ, বিরক্তিকর বৃষ্টি। রিনাদি উদ্যোগ নিলেন, সকলে মিলে একসঙ্গে কিছু করার। কী না মেমরি গেম খেলা হবে। মনটা খুশি হয়ে গেল। কলেজ লাইফের পর আর খেলা হয়নি। কে কে খেলবেন? ঋতুদা, অভীকদা, কল্যাণদা, রিনাদি, সারণ, আমি। রিনাদি বললেন, ‘অ্যাই মিঠুনকেও ডাক না।’ আমরা কয়েক রাউন্ড খেলার পর মিঠুনদা এসে যোগ দিলেন। আউটডোরে এসব হয়। রথী-মহারথীরা নির্দ্বিধায় এলি-তেলির সঙ্গে ভাগ করে মুড়িমাখা খায়। মিঠুনদা হাত তুলে বললেন, ‘ডাংগুলি ছাড়া আমি কোনও খেলা জানি না।’ আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। ঋতুদা আর রিনাদি মিলে মিঠুনদাকে মেমরি গেম বোঝাতে লাগল। কিছুক্ষণেই বোঝা গেল, নিয়মকানুন মনে রাখার ক্ষেত্রে সুপারস্টারের মেমরি যথেষ্ট সিরিয়াস নয়। মানে সবাই যখন অতুল্য ঘোষ-রবিশঙ্কর-সুনীল গাভাসকার-ওয়াহিদা রহমান বলছে, মিঠুনদা বললেন, ব্যাঙাচি! সবাই হইহই করে উঠল। মানুষের নাম, মানুষের নাম। মিঠুনদা খুব সিরিয়াস অথচ মজা করার মতো মুখ করে বললেন, তাহলে ক্ষুর ন্যাপলা। রিনাদি রেগে গিয়ে বললেন, ‘মিঠুন, এ কি কোনও বিখ্যাত লোক? মিঠুনদা ততোধিক সিরিয়াস। ‘আহিরিটোলার দিকে খুব নাম ছিল ওর।’ কল্যাণদা হো-হো করে বজ্রকণ্ঠে হেসে উঠলেন।
ঋতুদা-রিনাদি মাথায় হাত দিয়ে ভুরু কুঁচকে বসে। “এ’রম করলে আমি খেলব না।” রিনাদি গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। বাংলা ছবিতে অপর্ণা সেন এইভাবেই বেরিয়ে যেতেন সচরাচর।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?