শুভ মহরতে অভিনয় ছাড়াও যে কারণটা আমার দুশ্চিন্তা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল, তা হল, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হবে। নিজের গান সে যা হোক করে গাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার একটা অন্য শিক্ষা থাকা প্রয়োজন। শুধু সুর আর তাল দিয়ে রবিন্দ্রসংগীত গাওয়া চলে না। ফলে জানতাম, গাইলেই সমালোচনার মুখে পড়ব। ঋতুদাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি, গানটা আমার গলায় রেখো না, গাইতে পারব না। ঋতুদা মেনেও নিয়েছিল আমার যুক্তি। গোল পাকাল দেবুদা। মানে দেবজ্যোতি মিশ্র।
৩৯.
‘শুভ মহরৎ’-এর শুটিংয়ে আমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল কতগুলো ‘এনজি’ করি। শুনেছি বাঘা বাঘা আর্টিস্টরাও নাকি এই ভুল করার জন্য গোটা ইউনিটের সামনে বকুনি খান। এনজি মানে ‘No Good’ শট, যা ভালো হয়নি।
এই ভালো না হওয়ার হরেক কারণ। কখনও সংলাপের জন্য, কখনও পজিশন নেওয়ার জন্য, কখনও ভুল লুক দেওয়ার জন্য। এই পুরো ঝকমারিটা অঙ্কের মতো মাথায় রেখে যাঁরা তুখোড় অভিনয় করে চলেন তাঁরা নমস্য ব্যক্তি। আনাড়িদের জন্য কাজটা একেবারেই সহজ নয়। ঋতুদা এত কিছু বলে আমায় ভয় দেখায়নি বরং বারবার বলেছে, তুই যেভাবে কথা বলিস, সেভাবেই বলবি। তিনমাস ধরে সংলাপ মুখস্ত করার বিপদ আছে খুবই। রাখীদির সঙ্গে প্রথম সিনে আমি জেট-স্পিডে সংলাপ বলতে শুরু করলাম। ঋতুদা ক্যামেরার পিছন থেকে শট চলাকালীনই চেঁচাতে লাগল, ‘আস্তে আস্তে ঘাড়টা ঘোরা, সময় নে, অনেক সময় তোর হাতে। বমি করার মতো হড়হড় করে সব ডায়লগ বলিস না।’
অভিনয়ের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় শিক্ষা, সময়টাকে কবজা করতে শেখা। ভীষণ ভক্ত ছিলাম শেখর কাপুরের অভিনয়ের। ঘাড় গোঁজ করে তাঁরই মতো বিড়বিড় করে সংলাপ আওড়াচ্ছিলাম। ঋতুদা মনিটরে ডেকে এনে দেখাল। আর একটু বাড়বে ব্যাপারটা, তাহলেই মাপ মতো হবে। অভিনয়ের এই সুর বেঁধে দেওয়ায় কাজটা প্রথম দিনেই হয়েছিল। আমারও শুভঙ্করকে বুঝতে আর ভুল হয়নি। যত শুটিং এগিয়েছে, কনফিডেন্স পেয়েছি আরও। আমার কনফিউজড দশাটা রাখীদি শুরু থেকে বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে গোটা শুটিং-এ একবারের জন্যও বিরক্ত হননি আমার ওপর। আমার ক্লোজ আপ শটগুলোর সব কিউ তাঁরই দেওয়া। খুব দুর্বল প্রাণীর ওপর চট করে কেউ রাগ-গাল করে না বরং সাহায্য করার চেষ্টা করে। রাখীদি সেটাই করেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়। রাখীদি থাকতেন তাজ বেঙ্গলে। রোজ সকালে তাজ বেঙ্গলের ব্রেকফাস্ট আমাদের জন্য প্যাক করিয়ে নিয়ে আসতেন। গোটা ইউনিট যেখানে থরহরি কম্প, সেখানে ওঁর এই অন্তঃকরণ ভোলার নয়। ‘শুভ মহরৎ’ রিলিজ করার পর, চেনাজানা লোকের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘তোকে রাখী কচুরি ভেজে খাওয়াল!’ ওতেই পেডিগ্রি আমার আকাশছোঁয়া। বলতে পারিনি, কচুরিগুলো কাঁচা ছিল, অ্যাক্টিং-এর জন্য দাঁতে কেটেছি মাত্র।
নন্দিতার সঙ্গে আমার প্রথম দিনের শটে একটা মজার কাণ্ড হল। ক্যাল টাইমস-এর ফোটোগ্রাফার এসে ওত পেতে বসেছিল, ছবি তোলার জন্য। নন্দিতা জানে ওর ছবি তোলা হবে আলাদা করে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না দু’জনের একসঙ্গে তোলা হচ্ছে কেন? পরে কেউ একটা নন্দিতাকে বলেছে, আমি ব্যান্ডে গান গাই, সেই কারণেই এই স্টোরি। নন্দিতা কী প্রচণ্ড অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। ‘বলোনি তো?’ আমি ততোধিক অস্বস্তিতে। বলার চান্স পেলে তো বলব! ‘এক্ষুনি গান শোনাও।’ শুটিংটা হয়ে গেলে শোনাই? ‘না, এখনই। ঋতুদা, ও গান না শোনালে শট দেব না আমি।’
কীর’ম ডেঞ্জারাস মেয়ে। ক্যামেরার পিছনে যাঁরা, সবাই ফুট কাটতে শুরু করল। অভীকদা বলল, ‘অনিন্দ্য টাইম খেয়ে নিচ্ছ, তাড়াতাড়ি গাও।’ এ-ও এক ধরনের র্যাগিং। কী আর করা, শোনালাম একটা গান। পছন্দের নায়িকাকে শোনানোর জন্য গানের বাছাইটা ঠিক হয়নি, এখন মনে হয়। শুনিয়েছিলাম, ‘আমাকে রোগা বলো না’। নন্দিতা হেসে ফেলেছিল। ‘খুব অদ্ভুত গান তো’, বলেছিল। পরদিন টাইমস-এ অ্যাঙ্কার স্টোরি বেরয়, আমাদের দু’জনের ফোটোসমেত, হেডিংটা ব্যান্ডসিঙ্গার অভিনয়ের জুতোয় পা গলিয়েছে টাইপ।
খবর বেরনোর দিন আমার শো ছিল আসানসোলে। তার পরের দিনে শুটিংয়ে নন্দিতা দস্তুর মতো চার্জ করল, ‘তুমি এতটা ফেমাস সিঙ্গার, কেন বলোনি?’ যেন প্রথম আলাপেই আমার বায়োডেটা ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল ওর হাতে। যত বলি, বলার মতো অত কিছু নয়, তত রেগে রেগে যায়। রাগ ভাঙানোর জন্য শেষমেশ নন্দিতার গান শুনতে হয় আমায়। সলিল চৌধুরীর অনেকগুলো গান জানত নন্দিতা। তার মধ্যে খুব আনন্দ করে গাইত, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’। খুবই সংক্রামক এই গান। প্রথমে নন্দিতা শুরু করত, তারপর ঋতুদাও যোগ দিত। আমাকে নন্দিতা কপট ধমক দিত, ‘গাইছ না কেন, গাও!’ আমি আর সাহস করে বলতে পারিনি, নন্দিতা আর ঋতুদা দু’জনেই যখন গাইত আবেগ বাঁধনছাড়া, সুরও তেমনই আগলছাড়া। ফলে দেব দেব করেও ওই ক্যাকাফোনিতে আর যোগ দেওয়া হয়নি।
শুভ মহরতে অভিনয় ছাড়াও যে কারণটা আমার দুশ্চিন্তা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল, তা হল, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে হবে। নিজের গান সে যা হোক করে গাওয়া যায়। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার একটা অন্য শিক্ষা থাকা প্রয়োজন। শুধু সুর আর তাল দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া চলে না। ফলে জানতাম, গাইলেই সমালোচনার মুখে পড়ব। ঋতুদাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি, গানটা আমার গলায় রেখো না, গাইতে পারব না। ঋতুদা মেনেও নিয়েছিল আমার যুক্তি। গোল পাকাল দেবুদা। মানে দেবজ্যোতি মিশ্র। তার যুক্তি, অনিন্দ্যর গলাটা এখন সবাই চেনে, ফলে অন্য কেউ গাইলে বেমানান লাগবে। ঋতুদা শুনে বলল, ‘সে-ও ঠিক কথা। তুই গানটা তোল।’ টেনশন খেয়ে গান তুলতে শুরু করলাম।
‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ একটি কণ্ঠেই মানায়। আদা-জল খেয়ে দেবব্রত বিশ্বাস শুনতে শুরু করলাম। ক্যাসেটের টেপ ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়, গান ভালো করে তুলতে পারছি না। তার মধ্যে এসে গেল শুটিংয়ের দিন। খালি গলায় গাওয়ার সবচেয়ে বড় বিপদ, নানা শটে আলাদা আলাদা লয়ে গাইলাম। নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম। শেষমেশ উতরলো শুটিং। পরে আমার গলায় গানটি ডাব করেছিল মনোময়। দুরূহ কাজ ছিল সেটা, কীভাবে যে পারল, কে জানে! পরবর্তী সময়ে কতশত মানুষ যে এসে আমায় বলে গিয়েছেন, ব্যান্ডের গানগুলো একরকম কিন্তু শুভ মহরতে আপনি রবীন্দ্রসংগীতটা যা গেয়েছেন না! হাঃ, হাঃ করে থামিয়ে আমি বলেছি মনোময়ের নাম। কিন্তু চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি। বহু সংখ্যক মানুষ এখনও জানে, গানটা আমারই গাওয়া, মনোময় একবার দুঃখ করে এই মর্মে ইন্টারভিউও দিয়েছিল। বেচারা মনোময়। বন্ধু হিসেবে ওকে পরামর্শ দিয়েছি একটা ছবিতে অভিনয় করার জন্য। যে ছবিতে মনোময়ের লিপে গানটা আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে গাইবই গাইব।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?