বাড়ি তল্লাশি হল। আর কাউকে পাওয়া গেল না। বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। যার নামে ভাড়া, সে বেনারস গিয়েছে কাজে। ছায়াকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। গোটাটা তদন্ত দরকার। এ-ও যেন কৃষ্ণনগরের নিবারণ কুড়ি লেনের মতো ছদ্মবেশী ঠেক। হয়তো চারপাশে ওদের অনেকে আছে। রাহুল সতর্ক। সুনেত্রা আর বিষ্ণু কি এখানে আছে? বাইরে জমতে থাকা ভিড়ের মধ্যে বিস্ময়! এই মলিন চেহারার মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
২৪.
বাড়িটা ঘিরে ফেলেছিল সাদা পোশাকের পুলিশ।
রাহুল যখন ফোর্স নিয়ে পৌঁছেছে, তখন কারও আর পালানোর উপায় ছিল না। একটাই ভয় ছিল, যদি তারা অস্ত্র বা বিস্ফোরক ব্যবহার করে। তৈরি ছিল পুলিশ। তবে দরকার পড়েনি।
রাহুল যেদিন জবার সঙ্গে কথা বলে, সেদিনই বিষয়টার গন্ধ পেয়েছিল। কিন্তু জবাও সবটা জানত না। এটুকু শুনেছিল ছায়ার স্বামী জেলে আছে, ছায়া আরও দু’-একজনের সঙ্গে নাম পাল্টে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সাগরটিলা থেকে চলে যাওয়ার আগে জবার কানে গিয়েছিল ছিটকে আসা কথা, কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছে ছায়ারা। সঙ্গে আরেক মহিলা ছিল। জবা এটুকু অন্তত বুঝেছিল এরা সাধারণ শালপাতা কুড়নো মহিলা নয়। এরা জঙ্গলবাহিনীর কেউ। আরও বুঝেছিল যে তার স্বামী পল্টু রানারও সেটা বোঝে। জলঘোলা করে না। বরং এদের টুকটাক কাজ করে দিয়ে দুটো পয়সা পায়। রাহুলের জেরার সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি জবা। যেটুকু যা জানে বা অনুমান করে, বলে দিয়েছে। রাহুল জানিয়েছে ত্রিপাঠীসাহেবকে। আরও যা যা খোঁজখবর নেওয়ার ছিল তিনি নিয়েছেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছায়া তাকিয়েছেন। চোখে জল। নরম জমি পেয়ে মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়াল রাহুল। বলল, ‘দেখুন, আপনাকে গ্রেপ্তার করতেই হবে। তবে যে মামলাটায় আপনার নাম, সেটা জটিল কিছু না। আপনি সরকারকে সাহায্য করলে আপনার জামিন করে দেওয়া হবে। সরকারের পুনর্বাসন স্কিমে আপনার দায়িত্ব আমাদের। কত দিন পালিয়ে বেড়াবেন?’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রাহুল নিজে গিয়ে দরজায় কড়া নেড়েছে। বাধা আসেনি। ছায়াকে প্রথম দেখে রাহুল বিস্মিত, খানিকটা করুণাই হল। জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত এক নারী। মলিন বেশ, অনাহার অযত্ন অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। ভেতরে কখনও হয়তো আগুনটা ছিল, যে আগুনের নেশায় এই পথে পা; সে আগুন কবেই নিভে গিয়েছে। অসহায় ছায়া পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আশ্রয় খুঁজছেন।
বাড়ি তল্লাশি হল। আর কাউকে পাওয়া গেল না। বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। যার নামে ভাড়া, সে বেনারস গিয়েছে কাজে। ছায়াকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, কোনও তথ্য দেওয়া হয়নি। গোটাটাj তদন্ত দরকার। এ-ও যেন কৃষ্ণনগরের নিবারণ কুড়ি লেনের মতো ছদ্মবেশী ঠেক। হয়তো চারপাশে ওদের অনেকে আছে। রাহুল সতর্ক। সুনেত্রা আর বিষ্ণু কি এখানে আছে? বাইরে জমতে থাকা ভিড়ের মধ্যে বিস্ময়! এই মলিন চেহারার মহিলাকে ধরতে এত পুলিশ?
থানায় বসিয়ে ছায়াকে রাহুল বলল, ‘এখন তো সব ঠিকঠাক। কেন এত কষ্ট করছেন? আপনার স্বামী শঙ্করবাবু কত চিন্তা করছিলেন আপনাকে নিয়ে। চলুন, কাল বা পরশু দেখা করিয়ে আনব।’
ছায়া তাকিয়েছেন। চোখে জল। নরম জমি পেয়ে মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়াল রাহুল। বলল, ‘দেখুন, আপনাকে গ্রেপ্তার করতেই হবে। তবে যে মামলাটায় আপনার নাম, সেটা জটিল কিছু না। আপনি সরকারকে সাহায্য করলে আপনার জামিন করে দেওয়া হবে। সরকারের পুনর্বাসন স্কিমে আপনার দায়িত্ব আমাদের। কত দিন পালিয়ে বেড়াবেন?’
মুখ খুলতে দ্বিধায় পড়েছেন ছায়া। এত আন্দোলন, অঙ্গীকার, সংগ্রাম, শপথ, তাঁর মুখ চেপে ধরেছে। আবার উল্টোদিকে আর চাপ সহ্য করার অবস্থায় ছায়া নেই।
রাহুল বলল, ‘আপনাকে এখন গ্রেপ্তার দেখাবই না। পুলিশের কোনও কোয়ার্টারে থাকবেন। শঙ্করবাবুর সঙ্গে দেখা করাব। দরকারে একদিনে জামিন করে দেব আপনার। শুধু আমাদের সাহায্য করুন। এখন তো সরকার, পুলিশ, প্রশাসন গরিব জঙ্গলবাসীর পাশে থাকছে। তাহলে এসব রাজনীতি করে লাভ কী? আপনি কিছু খেয়ে নিন, তারপর আবার কথা বলব।’
রাহুল ডাকল, ‘নীলিমা, আসুন তো। আপনি ছায়াদেবীর সঙ্গে সবসময় থাকুন। ওঁর যেন কোনও অসুবিধে না হয়।’
নীলিমা হল ঝানু কনেস্টবল। সর্বক্ষণ দরদি সেজে কথা বলতে বলতে আসল খবর বের করে নিতে দক্ষ। সে জানে তাকে কী করতে হবে।
একটু পরেই এক সাব ইন্সপেক্টর রাহুলকে জানাল যে, বাড়ি থেকে ছায়াকে আনা হয়েছে, তার পাশের বাড়ির এক মহিলা মুখ খুলেছেন। ছায়াদের বিরুদ্ধে বলছেন। কার বাড়ি, কে কে আসত, এসব গুজগুজ ফুসফুস তিনি সন্দেহ করেছিলেন, বারণ করেছিলেন অচেনা লোকদের যাতায়াত, এসব বলছেন। রাহুল বলল মহিলাকে থানায় আনতে।
একাই থানায় এলেন মহিলা। নাম রীতা। একটু ঝগড়ুটে মুড। রাহুল ইচ্ছে করে ছায়ার সঙ্গে দেখা করাল রীতাকে। রীতা উদম ঝাড় দিলেন, ‘গরিব মেয়ে, আশ্রয় পেয়ে আছ, সেটাই কত বড় কথা! কতবার বলেছি একে-ওকে এনে রেখো না। এলাকার একটা সিকিউরিটি বলে তো ব্যাপার আছে। এখন বলে দাও পুলিশকে যা জানো। আমি তো দেখেছি এক মহিলা আর একটা লোককে ওখানে যাতায়াত করতে।’
এসব কথা আরও বলতে থাকলেন। ছায়া গম্ভীর মুখে বসে। তাঁর জন্য ভাত, ডাল, সবজি এসেছে। রাহুলকে একবার বাথরুম যেতেই হবে। সে বলল, ‘উনি খেয়ে নিন। তারপর সবটা শুনব। আমি দশ মিনিট ঘুরে আসি। রীতাদেবী, আপনিও বসুন।’
রাহুল বেরিয়ে গেল।
রীতা বলল, ‘একটু জল হবে?’
নীলিমা বলল, ‘নিয়ে আসছি। আপনি বসে থাকুন।’
নীলিমা ঘর থেকে বেরতেই রীতা ছায়াকে কিছু বললেন। পাথরের মতো তাকিয়ে রইলেন ছায়া। রীতা নিজে হাতে ভাত মেখে দিলেন। বাঁ-হাত দিয়ে ছায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘খেয়ে নাও কমরেড।’
নীলিমা ঢুকতেই রীতার চিৎকার, ‘খাবে না! ন্যাকামি! খা মাগি আগে। তারপর সব বলতে হবে।’
নীলিমা বলল, ‘আপনি আবার হাত লাগালেন কেন?’
রীতা বললেন, ‘ন্যাকামি সহ্য হচ্ছিল না। এরপর কি খাইয়েও দিতে হবে? যাই হাতটা ধুয়ে আসি।’
রাহুল বাথরুম সেরে চা নিয়ে বসেছিল। ছায়ার কাছ থেকে অনেকটাই পাওয়া যাবে। সুনেত্রা থেকে ব্রহ্মা, সবার হদিশ ওই মহিলার কাছে থাকবে। একপ্রস্থ জেরার পর জানাবে ত্রিপাঠীসাহেবকে। আর পাড়ার ওই মহিলাকেও একটু জিজ্ঞাসাবাদ দরকার। কী দেখেছেন, কাদের দেখেছেন, ওঁরই বা এত রাগ কেন? হঠাৎ বাইরে চিৎকার। হইচই। নীলিমা উদভ্রান্তের মতো ঢুকল, ‘স্যর শিগগিরই আসুন।’
রাহুল গেল। ভাত খেতে খেতেই থালার উপর পড়ে গিয়েছেন ছায়া। চোখ স্থির। মুখ দিয়ে একটু রক্ত। অনুমান, নিষ্প্রাণ।
‘ঐ রীতা মহিলা কোথায়?’ চিৎকার করেছে রাহুল।
‘হাত ধুতে গিয়ে আর ফেরেনি।’ নীলিমার জবাব।
রাহুল বলল, ‘আগে এখনও এঁকে হাসপাতাল নিয়ে চলো। আর ওই মহিলার খোঁজে ফোর্স নামাও।’
(চলবে)
…পড়ুন কুসুমডিহার কাব্য-এর অন্যান্য পর্ব…
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২৩: শঙ্কর বারিকের স্ত্রী ছায়া মাহাতো ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২২: গুন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাওবাদীরা, কুসুমডিহায় মনোবল বাড়ছে মানুষের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২১: কুসুমডিহা এক বুক আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২০: মানুষকে একজোট করতে চায় রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৯: দূত এবং দূতের দূত মারফত খবর গিয়েছে কুসুমডিহায়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৮: টিলার ওপরের মহিলাদের নিয়ে পুলিশের কৌতূহল প্রবল
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৭: পল্টু জবার পিছনে খরচ বাড়িয়ে ইদানীং এদিক-ওদিক হাত পেতে ফেলছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৬: কমরেড ব্রহ্মা কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৫: প্রতিমাকে পাওয়া গেল কুসুমডিহায়, মিথ্যে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসি হয়েছে তাঁর বরের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৪: এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১৩: কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১০: শান্ত কুসুমডিহা এখন হিংস্র হয়ে ফুঁসছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৭: কুসুমডিহাতেই দেখিয়ে দেব আমরা মরে যাইনি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৬: পরিচয় যত বাড়ছে, সুমিত অনুভব করছে এলাকা গরম হচ্ছে
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৫: পশ্চিমগড়ের মৃতদেহর খবর এখনও কলকাতা সংস্করণে জায়গা পায়নি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৪: সভা আর প্রচার মানেই বন্দুক ধরা নয়
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ৩: ‘বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি’
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ২: সিস্টেমের দোষেই কুসমডিহাতে ফের অমঙ্গলের পদধ্বনি, সুমিতকে বোঝাল রেশমি
কুসুমডিহার কাব্য পর্ব ১: জঙ্গলমহলের কুসুমডিহার নতুন পোস্টমাস্টার সুমিত, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারবে!
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।