রবীন্দ্রনাথ বলছেন, নিষ্ঠাও যেন নিন্দাগ্লানির ভিতর থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারে, এমনই তার শক্ত প্রাণ। একটানা প্রান্তরের একঘেয়েমি যাত্রীকে আরও ক্লান্ত করে। সার্থকতার কল্পিত রূপ মরীচিকার মতো যেন পথ ভোলাতে আসে, সতর্ক বাহনটি যাত্রীকে বহন করে চলতেই থাকে। অথচ, দুঃখদিনের মরুপথের এই একমাত্র সঙ্গিনী যাত্রাপথের শেষে কোনও স্বীকৃতি দাবি করে না, কোনও অহংকারও করে না, নিজেকে আড়ালেই রাখে।
১৭.
‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে পরপর দুটি ছোট নিবন্ধের শিরোনাম ‘নিষ্ঠা’ এবং ‘নিষ্ঠার কাজ’। দুটি একই তারিখের অভিভাষণ, হয়তো মুদ্রণের সময় দুটি ভাগে ছাপা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিষ্ঠার তুলনা করেছেন মরুবাহন উটের সঙ্গে আর নিষ্ঠার সার্থকতা বোঝাতে বলেছেন অভিযাত্রী কলম্বাসের কথা।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, যে কোনও সাধনায় যখন সাফল্য বা সিদ্ধির আভাস পাওয়া যায়, তখন সেই আনন্দে সাধনার পথচলা সহজ হয়, শ্রান্তি দূর হয়। ‘কিন্তু সাধনার আরম্ভেই সেই সিদ্ধির মূর্তি তো নিজেকে এমন করে দূর থেকেও প্রকাশ করে না। অথচ পথটিও তো সুগম পথ নয়। চলি কিসের জোরে?
এই সময়ে আমাদের চালাবার ভার যিনি নেন তিনিই নিষ্ঠা। ভক্তি যখন জাগে, হৃদয় যখন পূর্ণ হয়, তখন তো আর ভাবনা থাকে না; তখন তো পথকে আর পথ বলেই জ্ঞান হয় না, তখন একেবারে উড়ে চলি। কিন্তু ভক্তি যখন দূরে, হৃদয় যখন শূন্য, সেই অত্যন্ত দুঃসময়ে আমাদের সহায় কে? তখন আমাদের একমাত্র সহায় নিষ্ঠা। শুষ্ক চিত্তের মৃতভারকে সেই বহন করতে পারে।’
এই শুষ্ক চিত্তের মৃতভার যেন মরুভূমি আর নিষ্ঠা যেন সেই মরুভূমির পথের বাহন উট। আহার্য নেই, পানীয় নেই, তবু সে বহন করে নিয়ে চলেছে। বালির বিস্তার ক্রমাগত তপ্ত হয়ে উঠছে, তবু সে নিঃশব্দে চলেছে। মনে হয় যেন এ মরুপথের শেষ কোথাও নেই, মনে হয় যেন মৃত্যু ছাড়া গতি নেই, তবু এই সহিষ্ণু বাহনটির চলা বন্ধ হয় না। আবার উট যেমন কাঁটাঝোপের থেকেও নিজের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে পারে, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, নিষ্ঠাও যেন নিন্দাগ্লানির ভিতর থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারে, এমনই তার শক্ত প্রাণ। একটানা প্রান্তরের একঘেয়েমি যাত্রীকে আরও ক্লান্ত করে। সার্থকতার কল্পিত রূপ মরীচিকার মতো যেন পথ ভোলাতে আসে, সতর্ক বাহনটি যাত্রীকে বহন করে চলতেই থাকে। অথচ, দুঃখদিনের মরুপথের এই একমাত্র সঙ্গিনী যাত্রাপথের শেষে কোনও স্বীকৃতি দাবি করে না, কোনও অহংকারও করে না, নিজেকে আড়ালেই রাখে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নিষ্ঠা আর কি করে? ‘নিষ্ঠা যে কেবল আমাদের শুষ্ক কঠিন পথের উপর দিয়ে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে চালনা করে নিয়ে যায় তা নয়, সে আমাদের কেবলই সতর্ক করে দেয়।’ আমাদের জীবনের সাধনায় প্রেমের প্রাজ্ঞতা এলে মাত্রাবোধ স্বাভাবিক হয়ে আসে। সৌন্দর্যের মধ্যে জীবনকে সহজ আমরা নিয়মিত করতে পারি। কিন্তু রিক্ততার দিনে ছন্দপতন সহজে হয়। অসতর্ক স্খলনের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নিষ্ঠা আর কি করে? ‘নিষ্ঠা যে কেবল আমাদের শুষ্ক কঠিন পথের উপর দিয়ে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে চালনা করে নিয়ে যায় তা নয়, সে আমাদের কেবলই সতর্ক করে দেয়।’ আমাদের জীবনের সাধনায় প্রেমের প্রাজ্ঞতা এলে মাত্রাবোধ স্বাভাবিক হয়ে আসে। সৌন্দর্যের মধ্যে জীবনকে সহজ আমরা নিয়মিত করতে পারি। কিন্তু রিক্ততার দিনে ছন্দপতন সহজে হয়। অসতর্ক স্খলনের সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেখানে চলার কথা থেমে থাকি, যেখানে থামার কথা চলার বেগ বাড়িয়ে ফেলি। নিষ্ঠা আমাদের সতর্ক করে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, রোদের তেজ বেড়ে যাবার আগে যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। দেখিয়ে দেয়, জলের পাত্রের ফুটো দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে, পিপাসার জল ফুরিয়ে যাবে।
সাধনার পথে নিষ্ঠার এই নিত্য-সতর্কতার স্পর্শ আমাদের আনন্দময় ভরসা যোগায়। বিশ্বাস যোগায়। যে বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ বলছেন, কলম্বাসকে শক্তি যুগিয়েছিল। ‘গম্যস্থানের প্রতি কলম্বাসের বিশ্বাস যখন সুদৃঢ় হল তখন নিষ্ঠাই তাঁকে পথচিহ্নহীন অপরিচিত সমুদ্রের পথে প্রত্যহ ভরসা দিয়েছিল।’ তাঁর নাবিকদের সকলের বিশ্বাস তাঁর মতো দৃঢ় ছিল না, সমুদ্রযাত্রায় তাদের তাই নিষ্ঠাও ছিল না। সাফল্যের প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে তারা অবসাদে, সন্দেহে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কলম্বাসের নিষ্ঠা বাইরের কোনও সার্থকতার চিহ্ন দেখতে না পেয়েও চলার পথে অবিচল ছিল। শেষ পর্যন্ত যখন তীরের চিহ্ন দেখা দিল, তখন সকলের কাছ থেকে এল অভিনন্দনের জয়ধ্বনি। যে কোনও সাধনার পথে প্রথম অবস্থায় সহায় থাকে না কেউ। সত্যবিশ্বাসের প্রমাণ নিজের কাছেই যখন সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়, অন্যের কাছে তা ধরে দেখানোও যায় না। সেই সন্দেহ আর বিরুদ্ধতার দিনে নিষ্ঠা যেন আমাদের সঙ্গ ত্যাগ না করে, সেই প্রার্থনা রবীন্দ্রনাথের।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
‘যখন তীর কাছে আসবে, যখন তীরের পাখি তোমার মাস্তুলের উপর উড়ে বসবে, যখন তীরের ফুল তরঙ্গের উপর নৃত্য করবে, তখন সাধুবাদ আর আনুকূল্যের অভাব থাকবে না; কিন্তু ততকাল প্রতিদিনই কেবল নিষ্ঠা – নৈরাশ্যজয়ী নিষ্ঠা, আঘাতসহিষ্ণু নিষ্ঠা, বাহিরের-উৎসাহ-নিরপেক্ষ নিষ্ঠা, নিন্দায় অবিচলিত নিষ্ঠা– কোনোমতে কোনো কারণেই সে নিষ্ঠা যেন ত্যাগ না করে– সে যেন কম্পাসের দিকে চেয়েই থাকে, সে যেন হাল আঁকড়ে বসেই থাকে।’
(চলবে)
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব