আমার গালে একটা ঠাসিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে করছে। কেন লিখতে পারি না অ্যানের মতো হৃদয় খুঁড়ে উপড়ে আনা কবির গদ্য। নেচার ডিকটেটস দ্যাট আ ফ্লেম অ্যান্ড ইটস ফিউএল সোর্স নেভার টাচ। দ্য রিলেশনশিপ অফ ফ্লেম টু উইক নো ডিফারেন্ট দ্যান দ্যাট অফ সোল টু বডি। আহা। এই কবিই আমার হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছেন তাঁর লেখার টেবিলে বসে পাওয়া কবিতার এই ক’টি পঙক্তি ।
২৮.
যাঁরা এখনও অ্যানে মাইকেলস-এর ( Anne Michaels) কোনও বই পড়েননি, তাঁদের প্রথমেই বলি, অ্যানে এক অসাধারণ কানাডিয়ান লেখক। তিনি কবি। তিনি ঔপন্যাসিক। তিনি গদ্য লেখেন কবিতায়। কবিতা লেখেন গদ্যে। তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস হেল্ড ( Held ) লেখা এমন গদ্যে, যা আপনাকে আটকে দেবেই। মুগ্ধতায় আটকে দেবে। স্বপ্নে ও স্মৃতিতে থামিয়ে দেবে। মনকেমনে জড়িয়ে দেবে। আপনি তাই পাকে পাকে বন্দি হয়ে বলতে বাধ্য হবেন, হেল্ড! আধেক ধরা পড়েছি গো আধেক আছে বাকি– তেমনটা নয়। একেবারে পূর্ণগ্রাস। অন্তত আমার অবস্থা তাই। আমি অবিশ্যি এই ৭০ ছুঁই ছুঁই বিদূষীর প্রণয়েও পড়েছি। এমন মায়াবী কেশরাশি কল্পনায় দেখেছি। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। মাইকেলস এর চুল ঠিক তাই। যে নারী এমন লিখতে পারেন, ভাষায় আনতে পারেন এমন থামিয়ে দেওয়ার, এমন আটকে রাখার, এমন পূর্ণগ্রাসের সৌভিকতা, তাঁর রূপ সাগরে ডুব না দিয়ে পারিনি। আর সত্যি বলছি, পেয়েছি অরূপ রতন।
খুব সহজ করে একেবারে ভিতরের কথাটা বলছি এবার। অ্যানে মাইকেলস-এর লেখার বিষয় দু’টি। ঘুরে ফিরে আমার দু’টি সবথেকে প্রিয় বিষয়ে তিনি ফিরে ফিরে আসেন। কী কবিতায়, কী গদ্যে। তিনি বারবার ফিরে আসেন স্মৃতির ঠিকানায়। গণ-স্মৃতি। এবং ব্যক্তিগত স্মৃতি। আর যে-বিষয়টি তিনি সব লেখায় আঁকড়ে আছেন সেটি, নস্টালজিয়া। ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে। ফিরে যেতে না পারার বেদন। মনকেমন। মাইকেলস-এর ভাষায় একবারে নিজস্ব নিভৃত স্মৃতির একটা উদাহরণ দিই। তাহলে কেন এই নারী আমার সবটা গিলে ফেলেছেন, অনুভব করবেন। On a battlefield John lies in the aftermath of a blast, unable to move or feel his legs. As the snow falls, he is lost to memory – a chance encounter in a pub by a railway, a hot bath with his lover on a winter night, his childhood on a faraway coast.
যতবার পড়ি, আটকে যাই। যেভাবে গুপি-বাঘার গানে আটকে যায় সময়, ক্ষণ, স্পন্দন, চলাচল। কিন্তু মাইকেলস স্মৃতি, সময়, অতীত, নস্টালজিয়া নিয়ে খেলেন আরও মারাত্মক খেলা। তাঁর লেখায় বর্তমানে ঘটে আচমকা অতীতের আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ! অতীতের লাভা আগ্নেয় বেগে জাপটিয়ে ধরে ঘটমান বর্তমানকে। But the past erupts insistently into the present, as the century unfolds!
মারাত্মক লেখা। আমাদের নিয়ে যায় বিপজ্জনক কিনারে। ‘হেল্ড’ উপন্যাসে এই কবি ঔপন্যাসিক যে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন সেটা এইরকম, A fragmented tale of love, memory and time shuffled the hopes and dreams of four generations. ব্রিজ খেলতে যত সহজে তাস শাফলের অতি কঠিন কাজটি করে ফেলি আমরা, কানাডার কবি ঔপন্যাসিক করেছেন তাঁর হেল্ড নভেলে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও উপন্যাস সম্পর্কে যে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেই কথাই বলেছেন বিদেশি সমালোচক অ্যানের লেখা প্রসঙ্গে। Her writing is always personal, hypersensitive and profoundly interior.
চাবি-শব্দটা হল– ইন্টেরিয়র। এই মেয়ে তাঁর লেখার জন্য হৃদয় খুঁড়ে বেদনার দান তুলে আনেন কবিতায়, গদ্যে, তাঁর যে কোনও হৃদয় আভাসে। আমি কানাডায় তাঁর লেখার ঘরে লেখার টেবিলটি কল্পনা করার চেষ্টা করি। ভাবতে চেষ্টা করি কত বছর কত নিঃসঙ্গ সময় তিনি কী গভীর অন্তরঙ্গতায় কাটিয়েছেন ওই টেবিলটার সঙ্গে। হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে কত রক্তাক্ত শব্দ, বাক্য, ইশারা, ব্যঞ্জনা তিনি পেতে দিয়েছেন, না দিয়ে পারেননি, ওই টেবিলটার বুকে।
…………..
মারাত্মক লেখা। আমাদের নিয়ে যায় বিপজ্জনক কিনারে। হেল্ড উপন্যাসে এই কবি ঔপন্যাসিক যে ভূমিকম্প ঘটিয়েছেন সেটা এইরকম, A fragmented tale of love, memory and time shuffled the hopes and dreams of four generations. ব্রিজ খেলতে যত সহজে তাস শাফলের অতি কঠিন কাজটি করে ফেলি আমরা, কানাডার কবি ঔপন্যাসিক করেছেন তাঁর হেল্ড নভেলে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও উপন্যাস সম্পর্কে যে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেই কথাই বলেছেন বিদেশি সমালোচক অ্যানের লেখা প্রসঙ্গে। Her writing is always personal, hypersensitive and profoundly interior.
…………..
অ্যানের হেল্ড উপন্যাসের ছোট্ট একটা অংশ বাংলায় অনুবাদ করার চেষ্টা করছি। অপচেষ্টাও বলা যায়। এই চেষ্টা কিন্তু আমার অপদার্থকতাকে তিরস্কার! কেন লিখতে পারি না এই কানাডিয়ান কবি-ঔপন্যাসিকের মতো? কটাক্ষে তাকাই আমার লেখার টেবিলটার দিকে। তারপর আমার বারবার পড়া প্রিয় ইংরেজি বাক্য সারি, কী অপরূপ সুন্দর কী বলব, বাংলায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি:
হেলেনা বোর্ডে রং লাগাতে শুরু করে। সে রং লাগাতে থাকে যতক্ষণ না বোর্ডটা হয়ে ওঠে রাতের চতুষ্কোণ। অথবা ততক্ষণ সে রং লাগায় যতক্ষণ তার না মনে হয় বোর্ডটাই চৌকো রাত্তির। তারপর সেই প্রসারিত রাতের চৌকো শরীরে সে খুব ছোট্ট এক ড্রপ রং লাগায়, পেনসিলের শিসের ডগার থেকেও ছোট। অনেক দূরে জ্বলছে এমন এক দীপের আলোকবিন্দুর মতো ছোট। তারপর সেই সুদূর আলোর বিন্দুতে সে নিয়ে আসতে থাকে প্রায় অদৃশ্য দ্যুতির এক মাত্রা। প্রথম দেখলে শুধু কালো। তারপর সে আঁকতে চেষ্টা করল দীপের শিখা আর পলতের মধ্যে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফারাকটুকু থাকে সেইটে ওই ঘোর অন্ধকারের গায়ে ফুটিয়ে তোলার। কারণ ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফাঁকটুকু আসলে এক গভীর খাদ, অনন্তকালের এক অনিবার্য ছেদ, যার মূলে আছে প্রকৃতির এই ইচ্ছে, আগুনের শিখা এবং সেই শিখাকে জ্বালিয়ে রাখার উৎস যেন কোনও সময়েই পরস্পরকে স্পর্শ না করে। তারপর এই চেষ্টাটা তাকে পেয়ে বসল। হয়ে দাঁড়াল তার ‘অবসেশন’। সে আঁকতে চেষ্টা করেই যেতে লাগল, শরীর আর আত্মার মাঝখানে অদৃশ্য ছেদটুকু।
আমার গালে একটা ঠাসিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে করছে। কেন লিখতে পারি না অ্যানের মতো হৃদয় খুঁড়ে উপড়ে আনা কবির গদ্য। নেচার ডিকটেটস দ্যাট আ ফ্লেম অ্যান্ড ইটস ফিউএল সোর্স নেভার টাচ। দ্য রিলেশনশিপ অফ ফ্লেম টু উইক নো ডিফারেন্ট দ্যান দ্যাট অফ সোল টু বডি। আহা। এই কবিই আমার হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছেন তাঁর লেখার টেবিলে বসে পাওয়া কবিতার এই ক’টি পঙক্তি।
One new poem invites me to his home/ while an old one shares her inheritance with me.
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..
পার্থক্য উল্লেখ করার মতো। যে নতুন কবিতা কবিকে বলল, আমার বাড়িতে এসো, সে পুরুষ। আর পুরনো কবিতা যে কবির সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে তার উত্তরাধিকার, সে নারী। ইংরেজি ভাষায় কত সহজে কবিতার আপাত লিঙ্গভেদ বোঝানো গেল। বাংলায় এত সহজে বোঝানো যেত কি? তাছাড়া একটি জরুরি প্রশ্ন এসেই পড়ে, বাংলায় বা সংস্কৃতে কবিতাকে কি নারী হয়ে জন্মাতেই হবে? আপাতত আমি ‘হেল্ড’ এই প্রশ্নে!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল