কীর্তনখোলা থেকে কীর্তিপাশা নৌকায় আধবেলার পথ। খ্যাতনামা বাঙাল ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী সমৃদ্ধিশালী কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ির সন্তান। তপন রায়চৌধুরীর জীবন কেটেছে ইতিহাস চর্চায়, অধ্যয়নে, অধ্যাপনায় এবং রচনায়। এখন কীর্তিপাশায় তাঁদের বংশের কেউ নেই। রয়েছে তাঁদের জমিদারি হিসসার এক খণ্ডহার বা ধ্বংসস্তূপ। রয়েছে তাঁদের কীর্তি ও কিংবদন্তি। তপন রায়চৌধুরীর ঠাকুরদার বড় ভাই রোহিনীকুমার সেন ছিলেন একজন ইতিহাস-সচেতন লেখক। বরিশাল জেলার ইতিহাস নিয়ে তিনিই প্রথম একটি বই লেখেন– ‘বাকলা’ নামে।
১১.
নদীর নাম কীর্তনখোলা। এপারে বরিশাল শহর। ওপারে কাউয়ার চর। বরিশালের পূর্ব নাম ছিল ‘বাকলা’। প্রাচীন নাম চন্দ্রদ্বীপ। বরিশাল জেলার আরেক নাম ছিল ‘বাকরগঞ্জ’। এই শহরের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের এবং পুরো দেশের সংযোগের প্রধান মাধ্যম নদী। এই কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে সন্ধ্যায় একা হেঁটে বেড়াতেন কবি জীবনানন্দ দাশ।
এই শহরে বৃহৎ স্টিমারঘাট রয়েছে। বাস স্ট্যান্ড রয়েছে। এয়ারপোর্ট রয়েছে। কিন্তু কোনও রেল স্টেশন নেই। বরিশালকে রেললাইন দিয়ে ঘেরা প্রায় অসম্ভব। এই শহরকে ঘিরে আছে নদী। আর দূরে সমুদ্র ও সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস-সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বরিশাল বিভাগের জন্য মায়ের ভূমিকা পালন করে এই সুন্দরবন।
বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার একটি গ্রাম কীর্তিপাশা। এই কীর্তিপাশার বুকের ভেতরে বয়ে চলছে ধানসিড়ি নদী। এই জেলায় রয়েছে সুগন্ধা, সাঙ্গর, বিষখালী, গাবখান, জাংগালিয়া, বাসণ্ডা, গুরুদাম, সুতালড়ী ও কালিজিরা নদী। বিষের নামে নদীর নাম। অথচ সেই বিষখালী নদীতে পাওয়া যায় সবচেয়ে স্বাদু ইলিশ মাছ। বরিশাল নদীর দেশ। বরিশাল বালাম চালের দেশ। ঝালকাঠির পূর্ব নাম ছিল মহারাজগঞ্জ। কৈবর্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই জেলার নামকরণের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। অতীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের নগর হিসেবে পরিচিত ছিল এই জেলা।
গ্রামের নাম কীর্তিপাশা। কীর্তনখোলা থেকে কীর্তিপাশা নৌকায় আধবেলার পথ। খ্যাতনামা বাঙাল ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী সমৃদ্ধিশালী কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ির সন্তান। তপন রায়চৌধুরীর জীবন কেটেছে ইতিহাস চর্চায়, অধ্যয়নে, অধ্যাপনায় এবং রচনায়। এখন কীর্তিপাশায় তাঁদের বংশের কেউ নেই। রয়েছে তাদের জমিদারি হিস্সার এক খণ্ডহার বা ধ্বংসস্তূপ। রয়েছে তাঁদের কীর্তি ও কিংবদন্তি। তপন রায়চৌধুরীর ঠাকুরদার বড় ভাই রোহিণীকুমার সেন ছিলেন একজন ইতিহাস-সচেতন লেখক। বরিশাল জেলার ইতিহাস নিয়ে তিনিই প্রথম একটি বই লেখেন– ‘বাকলা’ নামে।
কীর্তিপাশার জমিদারগণের পূর্বজরা ছিলেন পেশায় বৈদ্য। তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল বিক্রমপুর পরগনার অন্তর্গত পোড়াগাছা গ্রাম। কীর্তিপাশা জমিদারগণের অনুগ্রহে তাঁদের বড় হিস্সার বাড়ির নিকটে কীর্তিপাশা বাজার, পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত তপন রায়চৌধুরীর প্রপিতামহ-র নামে ‘কীর্তিপাশা প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়েছে। এই বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে পরিচিতি লেখক মিহির সেনগুপ্ত। কীর্তিপাশার পাশের ‘কেওড়া’ গ্রাম মিহির সেনগুপ্তের জন্মস্থান।
জমিদার বাড়ির সম্মুখে বড় দিঘির পারের প্রাসাদের একাংশ পরিচালিত হচ্ছে ‘কমলিকান্দর নবীন চন্দ্র বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ হিসেবে। এই স্কুলটি শুরুতে অন্য এলাকায় ছিল, নদী ভাঙনের কারণে কীর্তিপাশার এই ভবনে স্কুলটি স্থানান্তর করা হয়। ছোট হিস্সার জমিদার বাবু শশীকুমার রায়ের বাড়ির সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ঝালকাঠি নার্সিং কলেজ’। পাশ দিয়ে বয়ে চলছে কীর্তিপাশা খাল। গাবখান নদী থেকে কীর্তিপাশা পর্যন্ত একটি খাল ও রাস্তা প্রস্তুত করেন বড় হিস্সার জমিদার নবকৃষ্ণ রায়চৌধুরী।
তপন রায়চৌধুরীর জন্ম মামাবাড়ি কুমিল্লায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে বরিশাল শহর। কীর্তনখোলা নদীর প্রবল স্রোতে পার ভাঙে প্রতি বর্ষায়। বরিশাল শহরের দিকটা রক্ষা করার জন্য ব্রিটিশ আমলে শহর রক্ষা বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। বাঁধটি বর্তমানে ‘বান্দ’ রোড নামে পরিচিত। এই বান্দ রোডের সহকারী ভূমি অফিসের জায়গায় একসময়ে ছিল ‘নাবালক লজ’।
তপন রায়চৌধুরী বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট হওয়ার কারণে তাঁর ছবিও ছাপা হয় দৈনিক পত্রিকায়। সেই ছবি দেখে বিয়ের জন্য কয়েক বাড়ির পাত্রীপক্ষ যোগাযোগ করেন নাবালক লজ-এর বাড়িতে। শৈশবের বন্ধু অক্সফোর্ড মিশনের ব্রাদার কেটলিকে সঙ্গে নিয়ে বরিশাল শহর থেকে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতেন কীর্তিপাশার বাড়িতে। তপন রায়চৌধুরী কৈশোরে প্রথম যাঁর প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর নাম লায়লা, লায়লার পিতা ছিলেন ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ বিপ্লবী শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ।
১৯৩১ সালের দিকে বাবার হাত ধরে পাঁচ বছর বয়সে বরিশাল থেকে প্রথম কলকাতায় আসেন তপন রায়চৌধুরী। নদীর দেশের মানুষ উঠে আসেন ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেন– কলকাতায়; পিসেমশাই কিরণশঙ্কর রায়ের বাড়িতে। কলকাতা শহরে এসে জীবনে প্রথম লিফট দেখেন। একটা ঘর নাকি অনায়াসে ওপরে উঠে যায়, নিচে নেমে আসে। কীর্তনখোলার ঢেউয়ের মতো এই লিফটের ওঠানামার স্মৃতি বুকের ভেতর থেকে যায় আজীবন। দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসে থাকেন চার বছর (১৯৩৩-’৩৭)। ’৩৭ সালে দেশে ফিরে গিয়ে ফের আবার কলকাতায় আসেন ১৯৪১ সালে। এই আসা-যাওয়ার কারণ পড়াশোনা। বরিশাল জিলা স্কুল বাদে কলকাতা পর্বে– জগবন্ধু স্কুলে পাঠের সূচনা, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজের ডাফ হোস্টেল, প্রেসিডেন্সি কলেজ। দেশভাগের পরের বছর বরিশাল ছেড়ে যান। অনেক বছর পর কলকাতা থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে বাঙালের বিলেত যাত্রা। অক্সফোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া। এরপর বহুপথ বহুদেশ ঘুরে ৫২ বছর পর টুরিস্ট হিসেবে ঘুরতে আসেন জন্মভূমি বরিশালে। ঘুরে দেখেন পৈতৃকভূমি কীর্তিপাশা। খুঁজে দেখেন ‘নাবালক লজ’ ও কীর্তনখোলা নদী।
… দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১০: মৃণাল সেনের ফরিদপুরের বাড়িতে নেতাজির নিয়মিত যাতায়াত থেকেই তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার জীবন শুরু
পর্ব ৯: শেষবার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে জানলায় নিজের আঁকা দুটো ছবি সেঁটে দিয়েছিলেন গণেশ হালুই
পর্ব ৮: শীর্ষেন্দুর শৈশবের ভিটেবাড়ি ‘দূরবীন’ ছাড়াও দেখা যায়
পর্ব ৭: হাতে লেখা বা ছাপা ‘প্রগতি’র ঠিকানাই ছিল বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টনের বাড়ি
পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন
পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন
পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন
পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’
পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে
পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির
আশ্রমজীবনকে বিদেশিরা সহজেই আপন করে নিতেন। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ নজর ছিল তাঁদের প্রতি। রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কত বিদেশি আসে এখানে নিজের ঘর ছেড়ে। দেখিস তারা যেন সেটি অনুভব না করে। আশ্রমে যেন তারা ঘর পায়।’