সে সময় অনেক ঘুড়ি বিশারদ, ঘুড়ির মাঞ্জা বিশারদের মতো বাজি বিশারদও থাকত। ওদের কেউ বলল, ‘সালফার বেশি।’ একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাগ কত?’ বাবলু বলে, ‘বলব কেন?’ বিশারদ বলল, ‘ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়।’ বাবলু অবাক! ‘কী করে জানলেন?’ উনি বললেন, ‘২২ বছর তুবড়ি বানাই। মিত্তির বাড়ির তুবড়ি কম্পিটিশনে ১১ বার ফার্স্ট। ৩২ ফুট পর্যন্ত হাইট উঠিয়েছিলাম। লাল-সাদার সঙ্গে নীল-সবুজ ফুলকি দিতে পারি।’ বাবলুদা বলেছিল, ‘আপনার ভাগটা তাহলে আমাকে দিন।’ সেই ভদ্রলোক বলেছিল, ‘হাঁ করে ইল্লি বলো দেখি!’
১৯.
‘বাজি’ শব্দটার মানে অভিধানে যাই থাকুক না কেন, কিছু অবিশ্বাস্য বা আশ্চর্য বা অসাধারণ কিছু বোঝাতে বাজি শব্দটি ব্যবহার করি। ভেলকি ধরনের কিছু বোঝাতে চাই। ভোজবাজি, রংবাজি, ঢংবাজি, চরকিবাজি, মেয়েবাজি, নক্শাবাজি এসবে বাজি যুক্ত হয়েছে যেন বিষয়টাকে আন্ডারলাইন করতে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ‘বাজিকরণ’ নামে একটা অধ্যায় আছে, যেখানে যৌবন অক্ষুণ্ণ রাখার প্রচেষ্টা আছে। মোদ্দাকথা যা হয় না, বা দেখা যায় না, তাকে দেখানোর নাম বাজি। আতসবাজি হল আলোর কারুকাজ। ‘আতস’ শব্দটা বাদ দিয়ে যদি শুধু ‘বাজি’ বলি, সাধারণভাবে আমরা আতসবাজিই বুঝব।
আজকাল আতসবাজি দেখে আমরা আর আশ্চর্য হই না। এটা বুড়ো বয়সের দোষের কারণে নয়, বাচ্চারাও তেমন আশ্চর্য হয় না, যেমন আমাদের শৈশবে আমরা হতাম। কারণ বাচ্চারা ওদের জন্মের পর থেকেই আলোর নানারকম ডিগবাজি দেখছে। খেলনার হাঁস প্যাঁক করলেই আলো জ্বলছে পেটে। লাট্টু ঘোরালেই রঙিন আলো জ্বলছে ভিতরে। বলের ভিতরে আলো, বল লাফায়, আলোও রঙ পালটায়। এলইডি বাতির মালা দেওয়ালির সময় ঘরে ঝুলছে, ক্ষণে ক্ষণে রং পালটাচ্ছে। এসব চিনা-মাল ছোটবেলা থেকেই চেনা হয়ে যাচ্ছে। এত রঙের খেলা দেখা শিশুরা চরকিবাজি কিংবা রঙমশালে আশ্চর্য হবে কেন? এখনকার বাচ্চারাও আনন্দ পায় হয়তো, কিন্তু আমরা যতটা আনন্দ পেতাম, এখনকার শিশুরা ততটা আনন্দ পায় বলে মনে হয় না।
আমার বাল্যবয়সের বাজি পোড়ানোর কাল জাবর কাটতে মন চায়, আরও বেশি মনে পড়ে বাজি বানানোর রোমাঞ্চ। যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানে আমার চেয়ে দু’-তিন বছরের বড় এক সহ-ভাড়াটিয়া ছিল। ‘বাবলুদা’ বলে ডাকতাম। একবার বাবলুদা গেরুয়া পরা, কপালে চন্দন-তিলক কাটা এক বাবাজিকে ধরে নিয়ে এল। বাবলুদার কেমন যেন মামা হন তিনি। পূর্বাশ্রমে তিনি বাজি বিশারদ ছিলেন, ভাগ্নের কাছে বলেছিলেন। ভাগ্নে বাবলুদা সেই গুপ্তবিদ্যা ভিক্ষা করেছিল। ভাগ্নের প্রার্থনা মামা ফেলতে পারেননি। বাবলুদার এই মামা বাবাজিকেই আমি ‘বাজি বাবাজি’ বলছি এখন।
প্রথমদিনেই বাজি বাবাজি একটা ফর্দ লিখে দিয়েছিলেন। সেই ফর্দে ছিল কাঠকয়লা– কুলকাঠ হলে সবচেয়ে ভালো, গন্ধক, সোরা লোহাচুর, অ্যালুমিনিয়াম-চুর। বলেছিলেন, এনে রোদ্দুরে দিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে, তারপর মিহি করে বেটে নিয়ে এক্কেবারে পাউডার করে নিতে হবে। শ্যামবাজারে বেশ কয়েকটা দোকানে বাজির মশলা বিক্রি হত। যে পরিমাণ লিখে দিয়েছিলেন বাবাজি, তেমনটা কিনলাম। রোদ্দুরে শুকোলাম, কিন্তু বাটব কী করে? বাবলুদা পারে না। আমার কথা ছেড়েই দিলাম। বাবলুদার দিদি পারে, কিন্তু বাটনা-বাটার শিলনোড়া কোথায়? রান্না করার শিলে এসব তো বাটা যায় না।
কাছেই গৌড়ীয় মঠে বাবলুর মামা থাকতেন। বাবলুদা সমস্যার কথা বলতে, উনি বাতলে দিলেন হামানদিস্তায় গুঁড়ো করা সম্ভব। তবে শিলনোড়ার মতো হবে না। উনি একটা হামানদিস্তাও জোগাড় করে দিয়েছিলেন। আমি ও বাবলুদা ঠকর ঠকর করতে করতে সারাটা দুপুর ধরে গুঁড়ো করতে লাগলাম। বিকেলে বাবাজি পরিদর্শনে এলেন। বললেন এবার পরিষ্কার কাপড়ে ছেঁকে নিতে হবে। সেরকম এক খণ্ড কাপড়ও আমাদের উপহার দিলেন। আমরা দু’জনে কাপড়ের দুই খণ্ড ধরে থাকলাম, বাবাজি একটা একটা করে মশলা ঢেলে হাতে নাড়তে থাকলেন। কাপড়ের ওপরে যা পড়ে রইল। ওগুলো আবার গুঁড়ো করা, এবং ছ’ঘণ্টা কড়া রোদ্দুরে রাখার কড়া নির্দেশ দিয়ে, বাবলুদার মায়ের হাতে করা পরোটা-পান্তুয়া খেয়ে বিদায় নিলেন।
এই বাজি বানানোর জন্য উপকরণ কেনার পয়সা মূলত বাবলুদার ঘট-ভাঙা পয়সাতেই হয়েছিল। আমি শুধু শ্রমদান করেছিলাম সেবার।
পরদিন বাজি বাবাজি আসেননি। মশলা রোদ্দুর খেয়েছে। তার পরদিন এলেন। এবার মশলা মেশানো হবে। এটাই তো আসল। দীক্ষা দেবার মতোই বাবাজি বাবলুদার কানে কানে কী একটা বললেন। বাবলুদা মাথা নাড়ল। বাবাজি ঝোলা থেকে একটা ছোট্ট দাঁড়িপাল্লা বের করলেন। এটাকে ‘নিক্তি’ বলে। আর একটা রুপোর টাকা, একটা আধুলি ও সিকি। এই গোপন কর্মটি এবার হবে। আমি উত্তেজনায় কাঁপছি। বাবলুদা আমাকে বলল, ‘তোকে এবার একটু বাইরে যেতে হবে। আমার মামা আমাকে ফরমুলা বলে দিচ্ছে, তোকে বলব কেন?’
বাইরে চলে এলাম। ঘর বন্ধ হল। কাঠকয়লা, গন্ধক, সোরা ইত্যাদি মেশানো হল। তারপর দরজা খোলা হল। এবার তুবড়ির খোলে ঠাসতে হবে। খুব ভালো করে ঠাসতে হবে। বুড়ো আঙুল দিয়ে। কাঠকয়লার কালো রং, হলুদ গন্ধক এবং সাদা সোরাকে ঢেকে দিয়েছে। লোহা এবং অ্যালুমিনিয়াম-চূর্ণও আছে। ছোট-ছোট মাটির খোলে খুব কষে মশলা ভরলাম। ঠাসতে ঠাসতে আঙুল ব্যথা হয়ে গেল। তারপর এঁটেল মাটি দিয়ে পিছনটা আটকে দিলাম। নির্দেশ হল, আবার পরেরদিন রোদ্দুরে দিতে হবে।
আমরা ২৪-টা তুবড়ি বানিয়েছিলাম। সেই খোলগুলো ছিল এক ছটাকি খোল। বেশ কিছুটা মশলা বেঁচে গিয়েছিল, বাবাজি মামা ওগুলো আলাদা আলাদা ঠোঙায় ভরে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘কিছুদিন পরই তো রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব, তখন এসব লাগবে।’ এখানে আমার কিছু বলার ছিল না। এটা ওদের মামা-ভাগ্নের ব্যাপার। আমি তো কেবল শ্রমদানই করেছি। একটা টেস্ট হল। পোখরানে ভারতের আণবিক বোমা পরীক্ষার অনেক আগে, ১৯৬৪ সাল নাগাদ। আমার দ্বাদশ বর্ষের বালকজীবনে এক অভিনব শিহরণ। একটু ঝিরিঝিরি করে দু’-আড়াই ফুট ফুলকি উঠেই দমাস করে ফেটে গেল। দ্বিতীয়টিও তাই। পাড়ার এক দাদা বলল, ‘বেশি ঠাসতে নেই। ঠাসা বেশি হয়ে গেছে।’ তবে তো এটা আমার দোষ। ঠাসার দায়িত্বে তো আমিই ছিলাম। তবে ১২-১৪-টা ফাটেনি। সেগুলো ১০-১২ ফুট মতো উঠেছিল। একটা তো প্রায় দোতলা সমান। খুব ধোঁয়া হচ্ছিল।
সে সময় অনেক ঘুড়ি বিশারদ, ঘুড়ির মাঞ্জা বিশারদের মতো বাজি বিশারদও থাকত। ওদের কেউ বলল, ‘সালফার বেশি।’ একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাগ কত?’ বাবলু বলে, ‘বলব কেন?’ বিশারদ বলল, ‘ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়।’ বাবলু অবাক! ‘কী করে জানলেন?’ উনি বললেন, ‘২২ বছর তুবড়ি বানাই। মিত্তির বাড়ির তুবড়ি কম্পিটিশনে ১১ বার ফার্স্ট। ৩২ ফুট পর্যন্ত হাইট উঠিয়েছিলাম। লাল-সাদার সঙ্গে নীল-সবুজ ফুলকি দিতে পারি।’ বাবলুদা বলেছিল, ‘আপনার ভাগটা তাহলে আমাকে দিন।’ সেই ভদ্রলোক বলেছিল, ‘হাঁ করে ইল্লি বলো দেখি!’
এই বচনটি এখন উঠে গেছে। হাঁ করে যেমন ‘ইল্লি’ উচ্চারণ করা অসম্ভব, তেমনই এসব গুপ্ত ফরমুলা বলাও অসম্ভব। ওই যে– ‘আট-তিন-পাঁচ-দেড়…’। এর মানে হল, ওজন হিসেবে আট ভাগ সোরা, তিন ভাগ কাঠকয়লা, পাঁচ ভাগ গন্ধক, দেড় লোহা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমার হালকা গোঁফের বয়সে ‘ট্রায়াল এরর’ পদ্ধতিতে বেশ ভালো কোয়ালিটির তুবড়ি বানিয়েছিলাম। ফরমুলা? বলব কেন?
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
১৮: নামের আগেপিছে ঘুরি মিছেমিছে
১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম
১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল
১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী
২৫ বৈশাখের সময় যেমন অনেক সময়েই সঞ্চালক হিসেবে থেকেছি স্টুডিও-তে, কখনও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কখনও রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠান দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে বলেছি রবীন্দ্রনাথের কথা, পড়েছি তাঁর রচনা থেকে, ঠিক সেই ‘গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড’ পদ্ধতিতে পুজোর বৈঠক সম্প্রচারিত হত।