জীবন গিয়ে হয়তো বয়সের স্টেশনে দাঁড়ায় কোথাও, নদীর কিন্তু থেমে যাওয়া নেই। গাঙুর হয়েছে কখনও কাবেরী, কখনও বা মিসিসিপি, কখনও রাইন কখনও কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি…। শিল্পীর জীবন নদীর মতোই বহমান, ঠিকানাহীন। তার উৎস কিংবা বয়সে কী আসে যায়! জনগণ যদি জানেও বা সুমনের পঁচাত্তরণ, পঁচাত্তর কি জানে সুমনের গান? জানে, এই লোকটা বয়সছাড়া এক পাগলপারা? জানে, এই লোকটা দোনলা নোটেশন বোঝাই করে আস্তানা গেঁড়েছে বৈষ্ণবঘাটায়? এ কোন জনপদ, কোন বৈষ্ণবের ঘাট?
সবে তখন সুমনে পেয়েছে। ট্রাপিজের দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো এক মঞ্চ থেকে অন্য সদন– লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে যৌবন বিতাচ্ছি। নিত্যনতুন সব গানের মোড়ক খুলছে, যেন ভানুমতীর খেল! মনখারাপ করা বিকেলে জিরেন নিলাম, দূরে কোথাও বৃষ্টি হওয়ার মতো শিরশিরে হাওয়া তখন গায়ে-মাথায়-মনে, সরগরম কিন্তু বাইরে রাস্তা, পানের দোকান, রেডিওতে হঠাৎ একটা পুরনো গান– এই অবধিও ঠিক আছে, গোধূলির মরা আলো বেয়ে দু’-এক পশলা মেঘ– হঠাৎ শুনি শান্ত নদীটি পটে আঁকা– আরে, আসল গানটা যেন টুক করে ভেসে পড়ল দোদুল্যমান সালতিতে… একটা অবাক করা শান্ত নদী এসে বিষ্টিটিষ্টি সব জুটিয়ে কী কেলেঙ্কারিটাই না করল! মনখারাপ করা একলা বিকেলের সঙ্গে দুম করে যেন ভাব হয়ে গেল ওই শান্ত নদীটার। দুলকি চালে চলতে থাকা গানখানি কেমন অযাচিত স্থির জল পেয়ে গেল পথের বাঁকে।
নিরুদ্বিগ্ন বিকেল আর অলসমধুর এক গতি– যা সুমন পেড়ে নামিয়েছিলেন বাঙালিয়ানার সাবেকি তাক থেকে। আমার নয়ন দু’টি শুধুই তোমারে চাহে/ ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে– সেই ব্যথাবাদলের দু’-এক ফোঁটা গিয়ে মেশে মনখারাপের খুনখারাপি বিকেলে। যেখানে মলিন শহরের ট্রামলাইন ধরে বয়ে চলে শান্ত নদী চিরকালীন। এই জলজ্যান্ত নদীটা কোথায় পেলেন সুমন? শিরা-উপশিরার মতো ডালপালা মেলে কোন অলিন্দে মিশেছিল নদী? অনেকটা কবীর সুমনের জীবনের মতো? এক নদী থেকে আরেক নদীতে এগিয়ে চলা?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সুমন জার্মানি ছেড়ে পৌঁছেছেন আমেরিকা। বাড়ি নিলেন যেখানে, তার পাশেই একটা নদী। নাম– পোটোম্যাক। স্থানে-অস্থানে মার্কিনি আরও কত নদীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে সুমনের। কী সুন্দর একটা গল্প বলেছিলেন। ‘একবার ফ্লোরিডা থেকে বস্টন যাচ্ছি, পাশে পাশে চলেছে ছোট্ট একটা নদী। গ্রে হাউন্ড বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নদী চলেছে। কিছু দূর গিয়ে দেখি একটা বোর্ডে লেখা– দ্য রিভার সরো। নদীর নাম দিয়েছে দুঃখ!’ রবিঠাকুর কি দেখা পেয়েছিলেন নদীটার?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বহুকাল আগে একটা বিজ্ঞাপনচিত্র করেছিলাম তাঁর সঙ্গে। গল্পে গল্পে উঠে এসেছিল নদীমাতৃক এক বেড়ে ওঠার কাহিনি। ওড়িশায় জন্ম সুমনের। কাঠঝুরি নদীর গায়ে। সে নদীর চরে বেড়াতে, খেলতে যেতেন সুমন। যার কাঁধে চেপে যেতেন তার নাম হর, সুমনদার ভাষায় ‘বাপের বয়সি এক বন্ধু’। সাড়ে চার বছর যখন বয়স চলে এলেন কলকাতায়। বন্ধু হল নতুন এক শান্ত নদী। অবশ্য সে হুগলি নদীর মেজাজ ও গরিমা ছিল আলাদাই। সুমনদার স্মৃতিচারণে, ‘ম্যান অফ ওয়ার জেটি’তে যখন প্যাসেঞ্জারস লাইনার এসে ভিড়ত। তিন শতকের শহরে তখন ঘাটের গল্প বলছেন সুমন। নৌকো ছিল, নৌকো আছে, নৌকো যায়– তিনরকমের ক্রিয়াপদে যেন স্মৃতিবিস্মৃতির নাব্যতা। সুমন ছেড়ে গিয়েছেন এক-একটা নদীকে। নদীরা কখনও ছাড়েনি সুমনকে। চলে গেলেন ‘ভয়েজ অফ জার্মানি’, নতুন এক জীবনের খোঁজে। ‘ব্যাগেজ’ বলতে আর পাঁচটা বাঙালির মতোই, একঝাঁক কলকাতাহারা মনখারাপগুচ্ছ। ফলে রাইন নদীর ধারে চুপ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হত বইকি!
আস্তে আস্তে প্রবাস সয়েছে। দেশ থেকে দেশান্তর। সুমন জার্মানি ছেড়ে পৌঁছেছেন আমেরিকা। বাড়ি নিলেন যেখানে, তার পাশেই একটা নদী। নাম– পোটোম্যাক। স্থানে-অস্থানে মার্কিনি আরও কত নদীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে সুমনের। কী সুন্দর একটা গল্প বলেছিলেন। ‘একবার ফ্লোরিডা থেকে বস্টন যাচ্ছি, পাশে পাশে চলেছে ছোট্ট একটা নদী। গ্রে হাউন্ড বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নদী চলেছে। কিছু দূর গিয়ে দেখি একটা বোর্ডে লেখা– দ্য রিভার সরো। নদীর নাম দিয়েছে দুঃখ!’ রবিঠাকুর কি দেখা পেয়েছিলেন নদীটার? এই সেই অশ্রু নদী নয় তো! এমন সব নদী হঠাৎ হঠাৎ ফেরে সুমনের গানে। কোথাকার জল কোথায় এসে যে গড়ায়!
জীবন গিয়ে হয়তো বয়সের স্টেশনে দাঁড়ায় কোথাও, নদীর কিন্তু থেমে যাওয়া নেই। গাঙুর হয়েছে কখনও কাবেরী, কখনও বা মিসিসিপি, কখনও রাইন কখনও কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি…। শিল্পীর জীবন নদীর মতোই বহমান, ঠিকানাহীন। তার উৎস কিংবা বয়সে কী আসে যায়! জনগণ যদি জানেও বা সুমনের পঁচাত্তরণ, পঁচাত্তর কি জানে সুমনের গান? জানে, এই লোকটা বয়সছাড়া এক পাগলাপরা? জানে, এই লোকটা দোনলা নোটেশন বোঝাই করে আস্তানা গেঁড়েছেন বৈষ্ণবঘাটায়? এ কোন জনপদ, কোন বৈষ্ণবের ঘাট? সুমন জানেন, এ ঘাট থেকেই ভেসেছিল বেহুলার ভেলা। সুমন জানেন, আসলে চলে যাওয়া বলে কিছু নেই, ফেরাতে চাইলে সব ফেরে, এমনকী, প্রাণও– এই নশ্বর জীবনের ধর্ম নিস্তরঙ্গ বয়ে চলা।
সুমন জানেন কিছু কিছু নদীর নাম। অথবা জানেন না। ভালবাসার মতো নদীরাও তাঁকে বড় হতে দেয়নি, দেবে না কখনও।
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় দরিদ্র শ্রেণি আর সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে।