কলেজের শিক্ষাকালীন সবাইকেই আউটডোরে নানা কিছু চর্চা করতে হয়। পরিবেশ, মানুষ, ঘরবাড়ি এবং নানা রকম জন্তু জানোয়ার ইত্যাদি। সুনীল দাস ঘোড়া আঁকার আগে গরু-মোষ এ সমস্ত আঁকতেন। খাটালে খাটালে ঘুরতেন। জীবজন্তু আঁকার একটা নেশা পেয়ে বসেছিল। পরে এল ওই গতিবান জন্তু, ঘোড়া। মাউন্টেড পুলিশের স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী ঘোড়া। তারপর দীর্ঘ আস্তাবল জীবন। এ বিষয়ে সুনীল দাস সম্পর্কে সবাই এত জানেন যে আমি পাঠকের সময় নষ্ট করব না। উনি বহু হাজার ঘোড়া এঁকেছেন পাঁচ থেকে ছয়ের দশকে। তাছাড়াও সারা জীবন ওঁর সংগ্রাহকদের আবদার মিটিয়েছেন ঘোড়া এঁকে। ব্যাপারটা অস্থিমজ্জায় এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত সুনীল দাস হয়ে উঠেছিলেন, ঘোড়া দাস।
৩৭.
আমাদের শিল্পচর্চার প্রায় শুরু থেকে এই সেদিন পর্যন্ত বাংলা শিল্প জগতে আমাদের একজন দাদা ছিলেন, তিনি– সুনীল দাস। নামটা শোনামাত্র সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে ‘মাস্তানি‘ এবং ‘দাদাগিরি‘ দুটো শব্দই মানুষটির সম্পর্কে প্রয়োগ করা চলে। তাঁর চেহারার মধ্যেও একটা সত্যিকারের মাস্তানের মতো সাজগোজ নজরে পড়ত। পাড়ার মাস্তানের আদলে ডান হাতের কবজিতে একটি মোটাসোটা বালা। অনুচ্চ নির্লোম বক্ষ এবং স্ফীত উদরের ওপর শার্টের একটি বা দু’টি বোতাম সর্বক্ষণই খোলা থাকত, আর গলা থেকে ঝুলত একটি চকচকে হার। মুখখানা ততোধিক শান্ত এবং সদাহাস্যময়। চোখদুটো সর্বক্ষণই একটা অনুসন্ধানী আর আচরণে, চলন-বলনে ভীষণ অন্তর্মুখী। ওঁর আসল মাস্তানি, দাদাগিরি কিংবা দাপট অন্যখানে, সে কথা সবাই জানেন।
দাদার যা কিছু মাস্তানি যা কিছু দাপট, সেগুলো ওই শান্ত শরীর দিয়ে হাত বেয়ে প্রকাশ পেত কাগজে বা ক্যানভাসে। সেখানে পেনসিল বা তুলির আঁচড় যেন ক্ষতবিক্ষত করত ছবির পটকে। সুনীল দাসকে কাছ থেকে যাঁরা কাজ করতে দেখেছেন, তাঁরা সবাই জানেন যে ওঁর সারা শরীর কিন্তু ততটা নড়ত না, যতটা ছটফট করত হাত। উনি ক্যানভাসের সামনে থাকতেন মগ্ন, শুধু কবজি থেকে হাতের আঙুলগুলো কিলবিলিয়ে উঠত, যেন আঙুলগুলো থেকে কখনও কখনও বেরিয়ে আসত বিদ্যুতের ঝলক।
কলেজের শিক্ষাকালীন সবাইকেই আউটডোরে নানা কিছু চর্চা করতে হয়। পরিবেশ, মানুষ, ঘরবাড়ি এবং নানারকম জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি। সুনীল দাস ঘোড়া আঁকার আগে গরু-মোষ এ সমস্ত আঁকতেন। খাটালে খাটালে ঘুরতেন। জীবজন্তু আঁকার একটা নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। পরে এল ওই গতিবান জন্তু, ঘোড়া। মাউন্টেড পুলিশের স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী ঘোড়া। তারপর দীর্ঘ আস্তাবল জীবন। এ বিষয়ে সুনীল দাস সম্পর্কে সবাই এত জানেন যে আমি পাঠকের সময় নষ্ট করব না। উনি বহু হাজার ঘোড়া এঁকেছেন পাঁচ থেকে ছয়ের দশকে। তাছাড়াও সারা জীবন ওঁর সংগ্রাহকদের আবদার মিটিয়েছেন ঘোড়া এঁকে। ব্যাপারটা অস্থিমজ্জায় এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে, শেষপর্যন্ত সুনীল দাস হয়ে উঠেছিলেন, ঘোড়া দাস।
……………………………………………..
শিল্পের ইতিহাসে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বারবার একটি বিষয়েই ফিরে গেছেন– একটি মোটিফ, একটি রূপ, একটি আবেগ– যা তাঁদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ভারতীয় শিল্পী সুনীল দাস তেমনই একজন, যিনি ঘোড়া ও ষাঁড়ের মাধ্যমে নিজের শিল্পজগৎ নির্মাণ করেছেন। তাঁর ছবির প্রতিটি রেখায় ছিল এক রকমের বুনো গতি, দমনহীন শক্তি এবং বেঁচে থাকার এক আর্তি।
…………………………………………………..
সুনীল দাসকে আমরা ভারতের আধুনিক চিত্রকলার এক উজ্জ্বল তারকা হিসেবেই দেখে আসি। উনি অভিব্যক্তিবাদী। ওঁর মুখে শুনেছি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অন্য স্বভাবের। মনের ভেতর যেন ছিল এক অদম্য ঝড়। তাঁর আঁকার ধরনে ছিল সেই ঝড়ের ছাপ– গতি, শক্তি এবং সাহস।
শিল্পের ইতিহাসে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বারবার একটি বিষয়েই ফিরে গেছেন– একটি মোটিফ, একটি রূপ, একটি আবেগ– যা তাঁদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। ভারতীয় শিল্পী সুনীল দাস তেমনই একজন, যিনি ঘোড়া ও ষাঁড়ের মাধ্যমে নিজের শিল্পজগৎ নির্মাণ করেছেন। তাঁর ছবির প্রতিটি রেখায় ছিল এক রকমের বুনো গতি, দমনহীন শক্তি এবং বেঁচে থাকার এক আর্তি।
সুনীল দাসের কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর কথা। পিকাসোও ষাঁড়কে বারবার আঁকতেন, যেন সেই পশুর চোখে ও মাংসে তিনি খুঁজে পেতেন মানুষের ক্রোধ, ভয়, সাহস ও অস্তিত্বের যুদ্ধ। ঘরের কাছে মকবুল ফিদা হুসেনের কথাও মনে আসে। একই মোটিফ, কিন্তু প্রতিবার নতুন আলোয়, নতুন রঙে, নতুন অভিজ্ঞতায়।
শিল্পী কখনও এক জায়গায় থেমে থাকেন না। তিনি যেমন কিছু আঁকড়ে ধরে রাখেন, তেমনই নিজেরই ভেতরে হারিয়ে যেতে চান। সুনীল দাস আপেল আঁকলেন, স্প্যান ম্যাগাজিনের পাতায় আঁকলেন রেখাচিত্র, করলেন কোলাজ, দাদাইস্টদের মতো নানা বস্তু সেঁটে দিলেন ক্যানভাসে, এমনকী যৌনতা বিষয়েও খোলামেলা ছবি এঁকেছেন অনেক। এগুলো কি শুধুই শিল্পসফলের কিংবা যশের লোভ? নাকি নিজের মাঝেই নিজেকে মাঝেমাঝে চিনতে না পারার ক্লান্তি? একদিকে তিনি নিজের আঁকা ষাঁড়ের মতোই দৃঢ়, আবার অন্যদিকে, ভেতরে প্রবলভাবে কাঁপছিলেন, খুঁজছিলেন নিজেকে। তাঁর শিল্প শুধু বিষয়ভিত্তিক নয়, বরং মানসিক অবস্থার প্রতিফলনও।
কাছ থেকে যে আমরা দেখতে পেয়েছি সুনীলদাকে, তার কতগুলো দিকের একটা হল ‘সোসাইটি অফ কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দল। যে দলের সবাই হিরো, যে যার নিজস্ব দক্ষতা এবং শিল্পকর্মের সৃজনশীলতায়। একটা অদৃশ্য কম্পিটিশন যেন চলত আর আমরা ছাত্ররা, দর্শকরা সমৃদ্ধ হতাম, শিক্ষিত হতাম। কলকাতায় তখন সাতের দশকে একটা নতুন রকম কর্মকাণ্ডের সূচনা হচ্ছে, সেটা হল শিল্পের কর্মশালা বা শিল্পশিবির। অদ্ভুত সুন্দর ব্যবস্থা, পেশাদার শিল্পী কীভাবে কাজ করেন তা দর্শক, ছাত্র এবং শিল্পপ্রেমিকরা সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছেন।
শিক্ষার্থী-দর্শক-শিল্পপ্রেমি
পরবর্তীকালে যখন আমরা ছাত্রাবস্থা কাটিয়ে উঠে পেশাদারিত্বের মধ্যে ঢুকেছি, তখন এই ধরনের কর্মশিবিরে অংশ নিতে শুরু করেছি দেশে এবং বিদেশে। বয়সভেদটা অনেক কমে গিয়ে সব বয়সের শিল্পীদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সেরকমই একটা সময়ে সুনীলদার সঙ্গে শিল্পশিবিরে অংশ নেওয়ার দু’-একটা গল্প বলি।
সেবারে আমরা আছি দাদার সঙ্গে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে একটি চমৎকার ছোট্ট সবুজ দ্বীপের মধ্যে। মরিশাস। সমুদ্রতল থেকে আগ্নেয়গিরির লাভা উঠে এসে মাথা উঁচু করে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার বছর পরে যে দেশ, তার রূপ বর্ণনা করার পরিসর এখানে আমার নেই। শুধু একটা কথাই মনে হল, কোনও কিছু সুন্দর হতে অনেকটা সময় লাগে। পৃথিবীতে নীল এবং সবুজের সমাহারে যত কিছু রং হতে পারে, তার সবকিছুরই ক্যাটালগ যেন মরিশাসের চারপাশের সমুদ্রের জল। সমুদ্রতটে ছিল দুধ সাদা বালি। বালি কী, সেটাও শিখেছিলাম প্রথমে এখানেই। বহু বছরের সামুদ্রিক কোরাল, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদির দেহাবশেষের কণা জলে ভেসে ভেসে তৈরি হয়েছে যে বস্তু, সেটাই দুধ-সাদা বালি।
সেদিন কাঠগোলাপের ডালে বসেছে সন্ধের পানের আসর। নিচু গাছের ডালে ডালে যে যার গ্লাস নিয়ে আড্ডা। চার-পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে সুনীলদাও একজন গেছো দাদা। অদ্ভুত সান্ধ্য দৃশ্য। পাশে বিশাল রাতের সমুদ্র থেকে সুন্দর হাওয়া। আমরা যে কটেজগুলোয় আছি, তার পাশে অনেকগুলো গাছ, আর তারই মধ্যে বুড়ো, বড়সড় এই কাঠগোলাপের গাছটি। মরুভূমি সমান মরিশাস দ্বীপে সমস্ত কিছুই মানুষ অন্য জায়গা থেকে বয়ে এনেছে। সেবারে সঙ্গে ছিলেন রামেশ্বর ব্রুটা, রাধাকৃষ্ণাণের মতো ডাকসাইটে শিল্পীরা। এমন মুহূর্তে প্রাণ খুলে নানা কিছু ব্যক্তিগত, অপ্রকাশিত গল্প শুনতে পাওয়া যায়। আবার এই ধরনের শিবিরে অনেক নতুন ঘটনার গল্পও তৈরি হয়, যেগুলোর কিছু কিছু আমরা সযত্নে অপ্রকাশিত রাখার চেষ্টা করি।
পরের শিবির দুবাইয়ে। একেবারেই অন্যরকম। মরিশাস, দ্বীপটুকু ছাড়া চারিদিকেই যেমন মহাসমুদ্রে শুধু জল আর জল, তেমনই দুবাই অত্যাধুনিক শহর। কী নেই সেখানে, তার চারিদিকে ধূ ধূ মরুভূমি আর সমুদ্র, দুটোই আছে। দুবাইয়ের শিবিরে সুনীলদার সঙ্গে পাশাপাশি ছবি এঁকেছি কয়েকদিন। ২০-২৫ জনের দলে যোগেনদা, মানে শিল্পী যোগেন চৌধুরীও ছিলেন আমাদের সঙ্গে সেবারের শিবিরে।
রাতে সমুদ্রের বুকে বিলাসবহুল বোটে প্রমোদভ্রমণ। আর মনে পড়ছে, দুবাইয়ের মস্ত অনুভূতি মরুভূমির বালিয়াড়ি। মরুভূমি দেখা মানে বিশাল আকাশও দেখা। দিনে, রাতে, নানা ঋতুতে, নানা তিথিতে তার নানা রূপ। আমরা একবার গেছিলাম বালিয়াড়ি দেখতে বেশ কয়েকটি জিপে করে। বালিয়াড়িতে ঢোকার কিছুক্ষণ আগে টায়ারের হাওয়া কমিয়ে নিতে হয়, টায়ারকে নরম করে রাখতে হয়, যাতে বালির ওপরে চলার সময়ে চাকাটা বালিকে ধরে ধরে এগোতে পারে।
বালিয়াড়িতে যে বালির পাহাড়, সেটা হাওয়াতে হাওয়াতে একটা জায়গার বালি অন্যদিকে জমা হতে হতে একটা এমন পাহাড়, যার একদিকে উঁচু অন্যদিকে খাদ। হাওয়ায় বালি উড়ে উড়ে পাহাড়টাও কখনও কখনও জায়গা পরিবর্তন করে। বালির পাহাড় ধ্বসে গাড়ি উল্টে যায় মাঝেমাঝেই। যেন জলের মধ্যে ডুবে যাওয়ার মতো। সেটা একটা খেলাও বটে। আমাদের একটা জিপ উল্টেছিল এবং যোগেনদার দামি বড় লেন্সওয়ালা ক্যামেরাটা চামড়ার ব্যাগ-সমেত বালির তলায় হারিয়ে গেল। পরে যখন পাওয়া গেল, ভেতরে খুব বালি ঢুকে গিয়েছিল সেটা মনে পড়ছে।
দুবাইয়ে প্রতিদিনের সান্ধ্য আড্ডা তো আছেই, কোনও কোনও সন্ধ্যায় শিল্পরসিক, স্থানীয় শিল্পী এবং বিশেষ অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বড় জনসভায় শিল্প আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়। তেমনই এক আলোচনাসভায় একদিন আমার পালা পড়ল সুনীল দাসের শিল্পকর্ম নিয়ে বলার।
সুনীলদার আস্তাবলে ঘোড়া ড্রইং করার যে গল্প শুনেছি, তারই একটি নাট্যরূপ দিয়ে ফেললাম। পরিবেশন করেছিলাম যথাসম্ভব কম কথা আর মাইম মানে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে। শুধু অঙ্গভঙ্গি এবং হাত-পায়ের মুদ্রা, মুখের অভিব্যক্তির জোরেই আমার বক্তব্য পেশ করা আর কী!
সুনীলদার ঘোড়া পর্যবেক্ষণ এবং তাদের মুভমেন্ট এবং শেষপর্যন্ত শিল্পীর অঙ্গ চালনায় ছবিতে প্রয়োগ ইত্যাদির যে ধাপগুলো, সেগুলো দেখানোর জন্য সামনে কাগজ বা ক্যানভাস না রেখে আমি হাওয়াতে একটা কাল্পনিক ছবির পট তৈরি করেছিলাম। আসলে সুনীলদার মুখে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাঁর বর্ণনাগুলো শুনে শুনে এমনই মুখস্ত হয়ে গেছিল, সেগুলো নিয়ে একটা নাট্যরূপ দেওয়া আমার কাছে মজার কাজ হল। একটু বিস্তারিত বলি।
একদম শুরুতে শান্তভাবে শুধুমাত্র দেখা। অর্থাৎ সুনীলদার যে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে গরু-মোষের খাটাল ইত্যাদি থেকে, সেখান থেকে এসে এই ঘোড়া পর্যবেক্ষণ করার অংশটা। তফাতটুকু ধরা। গরুর নাক-চোখ, মোষের চোখ মুখ আর ঘোড়ার শরীরের অংশ যে এক নয়, সেটা বোঝা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের খুঁটিনাটি, অ্যানাটমি ইত্যাদি ছোট ছোট করে স্টাডি করা।
পরের ধাপে চলন। মুখ-গলার এদিকে-ওদিকে নানা বাঁক। ওপরে দেখছে, নিচে দেখছে, খাবার খাচ্ছে। সমস্ত জন্তুদের কান নেড়ে মশা মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি ছাড়াও ওটা এক ধরনের জড়তা কাটানোর আঙ্গিকও। ঘোড়া সেগুলো যখন করছে তার ওই মুভমেন্টের সঙ্গে হাতের কবজি ঘুরিয়ে পেনসিল ধরে হাওয়াতে কাগজের ওপরে ড্রয়িং হচ্ছে, কিন্তু কাগজে পেনসিল ঠেকছে না। কাগজে না ঠেকিয়ে একটু ওপরে হাওয়াতে যেন ড্রইং হচ্ছে। ইনভিজিবল ড্রয়িং। চোখ থাকছে ঘোড়ার মুখের দিকে। যখন সে গলা নিচু করছে ড্রইংটা হাওয়াতে ডানদিক থেকে বাঁদিকে দ্রুত নিচে, যেই ভঙ্গি পালটাল ঘুরিয়ে আবার ওপরে। কান যখন নাড়া দিচ্ছে তখন সে কানের গতি মিলিয়ে আঙুলের গতি। আবার মাথাটা বেন্ড করে নিচের দিকে মাটি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে যখন, সেইখানে হাত ঘুরে যাওয়ার সময় হঠাৎই একবার কখনও কাগজে পেনসিল ঠেকিয়ে লাইন পড়ে গেল।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মুভমেন্টগুলোর ছন্দকে অভিনয়ের মতো, নাচের মতো, তবলা বাজানোর মতো, গানের গলা সাধার মতো অনর্গল করে যাওয়া। দীর্ঘদিন করতে করতে সুনীলদার ভাষায়– তিনি প্রায় ঘোড়া হয়ে উঠেছেন। উনি তখন ঘোড়ার দিকে তাকিয়ে, কাগজের দিকে না তাকিয়ে ড্রয়িং করতে পারছেন। ধরতে পারছেন ঘোড়ার অভিব্যক্তিগুলো তাঁর রেখায়।
শেষটা হচ্ছে নাটকের ক্লাইম্যাক্স। আমাদের পেনসিলের ড্রয়িং করার যে ক্ষমতা, সেখানে যদি শুধু আঙুলের ব্যবহার করি তাহলে আমরা ২ ইঞ্চি বা ৪ ইঞ্চি, যদি কবজির ব্যবহার করি তাহলে এক ফুটের মতো লম্বা লাইনগুলো নিয়ে খেলতে পারি। যদি দু’-হাত বাড়িয়ে দিই শরীরের দু’পাশে, তাহলে আমার শরীরের যা সাইজ, তাতে দেখা গেল ফুটপাঁচেক লম্বা সব মিলিয়ে। অর্থাৎ, আমি যদি ডানদিকের শেষ পেনসিলের ডগা থেকে একটা লাইন টেনে আমার সামনে দিয়ে এসে বাঁদিকের শেষ পর্যন্ত বডিটা ঘুরিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে চার পাঁচ ফুটের একটা লম্বা লাইন টানতে পারব একটানে।
আবার আমি যদি পা-টা দু’-ফুট ফাঁক করে দাঁড়াই এবং হাত দুটো দু’পাশে লম্বা করে দিই এবং আমার শরীরটা যদি ডানদিকে বাঁকিয়ে, বাঁ পা-টা উঁচুতে হাওয়ায় রেখে ডানদিকে এক পায়ের ওপরে ভর করে যদি ডানদিকে শরীরটা বাঁকাই আরও দু’-ফুট বেড়ে যেতে পারে। সেখান থেকে লাইনটা টেনে শরীরটাকে যখন মাঝখানে সোজা এল, তারপরে যদি না থেমে বাঁ পায়ের ওপর ভর করে যাই, তাহলে দেখা যায় ৪-৫ ফুটের জায়গায় ৬-৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা লাইন হয়ে যেতে পারে।
রেওয়াজের ফলে শিল্পীর নিজের অ্যানাটমিকে বশে আনা আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত ধরনের কারিগরি বুদ্ধি ও ক্ষমতা তৈরি হয়। একটা অদ্ভুত ধরনের চলন-বলনে আমার শরীরের সঙ্গে আমারই মজার সম্পর্ক। এটা আমি করে দেখিয়েছিলাম নাটকের আকারে, মাইমের ইল্যুশনে যেমন আমরা করি, ঠিক সেইভাবে। কল্পনায় হাওয়াতে বিরাট বড় একটা ১২-১৫ ফুট ক্যানভাসকে ধরে, তার ওপরে আমি একটানে একটি ১০ ফুটের ঘোড়ার ড্রইং করতে পারি। দেখা গেল, লেজ থেকে পিঠ, কাঁধ, গলা বেয়ে একেবারে নাকের ডগা পর্যন্ত একটা গ্যালোপিং ঘোড়ার ড্রইং একটানে করা সম্ভব।
আমার আনন্দ, সেই শিল্প-আলোচনা বনাম নাটক সেদিন মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন সুনীলদা, যোগেনদার মতো আরও বিশিষ্ট শিল্পীরা এবং কলারসিক অতিথিরা। অনেকেরই মনে হয়েছিল ঘোড়া আঁকার হাঁড়ির খবর পেয়ে গেলাম। কিন্তু না, সুনীল দাসের মতো ঘোড়া আঁকা সহজ নয়। সুনীলদা এই কাণ্ডটা করেছেন পাঁচের দশক থেকে সারাটা জীবন। অতঃপর, কয়েকদিন ধরে লোকের মুখোমুখি ফিরতে লাগল সে গল্প।
সুনীল দাসের ঘোড়ার ড্রইংয়ে কিন্তু সরলরেখার স্থান নেই। সবই বক্ররেখা। যাকে আমরা বলি, লিরিক্যাল লাইন। অথচ পশ্চিমের ধাঁচে, আধুনিক শিল্পে যে স্ট্রাকচার, ছবির জমিকে ধরে রাখার কথা বারবার বলা হয়েছে সেটাও পাচ্ছি পুরোপুরি। সেটা কী করে হল? আসলে ওঁর ছবিতে থাকত একটা ধাক্কা। ভীষণ বড় রকমের আঘাত। এই আঘাতটাই একটা মস্ত স্ট্রাকচারের কাজ করেছে। তারপরে তাকে টিউন করার জন্য তার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু লাইন, অকারণ। হাতের কাঠকয়লার কালি মুছে দেওয়া কাগজে কখনও বা। কাগজের চারপাশের বর্ডারকে মান্যতা দিয়ে সবটাই ছবির অংশ হয়ে যেত। আমাদের সংসারের মা-মাসিদের রান্নার সময়ে যেমন মশলা বাটার শিল ধোয়া জল কখনও দিয়ে দিচ্ছেন কড়াইতে কিংবা মশলা ঘাঁটা হাতের আঙুলগুলো ধুয়ে একটু জল দিয়ে দিলেন রান্নায়, তেমনই। এই যে হাতের গুণ সেইটা সুনীলদার ছিল সহজাত। একটি পশুর পাশবিক তেজ, তার শক্তি আর তার শরীরের চলনের মধ্যে ললিত ছন্দ, দুয়ে মিলে সুনীল দাসের ছবির কাঠামো তৈরি হয়েছে।
জীবনের কাঠামো নড়বড়ে হতে থাকল একসময়। শেষের দিকে মানুষটা স্তিমিত হতে থাকলেন। দাদার মনটাও কেমন বদলে যেতে দেখলাম। উনি কোথাও কোনও শিল্প-বিষয়ক কথা বলতে গেলে, ছোটদের এগজিবিশন দেখতে গেলে, শিল্প প্রতিষ্ঠান বা স্কুল-কলেজ ইত্যাদি পরিদর্শনে গেলে খামে ভরে কিছু টাকা নিয়ে যেতেন। ‘কিছু ভালো আর্ট মেটেরিয়াল কিনে নিও’ অথবা ‘শুনলাম তোমার খুব অভাব’ ইত্যাদি বলে হাতে গুঁজে দিতেন টাকা ভর্তি খাম। সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস-এর জন্য জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটা গাড়িই কিনে ফেললেন।
ঠিক এখন আর অমন পছন্দসই শিল্পী-দাদার পিছনে ঘুরঘুর করার ব্যাপারটা নেই। সব শিল্পীরাই, ছোট বড় যেই হোক, তাদের নিজস্ব ক্ষমতার দাদাগিরি শুরু হয়েছে। এখন শিল্পীরা নিজের দায়িত্বে নিজেরাই স্বয়ং-সম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। শুধু শেষ লাইনে বলতে চাই, শিল্পী সুনীল দাস ছিলেন, এক পাথরের মতো মোটিফে স্থির, আবার এক নদীর মতো বহমান।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৩৬। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমারের বাংলার হরফ সংস্কারের কাজই সত্যজিৎকে টাইপোগ্রাফি চর্চার দিকে ঠেলে দিয়েছিল
পর্ব ৩৫। যদি সত্যিই কোনও কিছুকে ভালোবাসো, তবে সাহসী হও– বলেছিলেন ড. মুকেশ বাত্রা
পর্ব ৩৪। শক্তিদার ব্র্যান্ড কী? উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বাংলায় কোনও ব্র্যান্ড হয় না’
পর্ব ৩৩। পত্রিকা পড়তে ছোটদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়, খেয়াল রাখতেন নীরেনদা
পর্ব ৩২ । কে সি দাশের ফাঁকা দেওয়ালে আর্ট গ্যালারির প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন বীরেনদা
পর্ব ৩১। কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে, আমার জন্য তেজপাতা আর পাঁচফোড়ন নিয়ে এসেছিলেন অহিদা
পর্ব ৩০। হাতের লেখা ছোঁয়ার জন্য আপনার ছিল ‘ভানুদাদা’, আমাদের একজন ‘রাণুদিদি’ তো থাকতেই পারত
পর্ব ২৯। পুবের কেউ এসে পশ্চিমের কাউকে আবিষ্কার করবে– এটা ঢাক পিটিয়ে বলা দরকার
পর্ব ২৮। অন্ধকার নয়, আলো আঁকতেন গণেশ পাইন
পর্ব ২৭। প্রীতীশ নন্দীর চেয়েও কলকাতা ঢের বেশি চেনা অমিতাভের!
পর্ব ২৬। রুদ্রদা, আপনার সমগ্র জীবনযাত্রাটাই একটা নাটক, না কি নাটকই জীবন?
পর্ব ২৫। ক্ষুদ্রকে বিশাল করে তোলাই যে আসলে শিল্প, শিখিয়েছিলেন তাপস সেন
পর্ব ২৪: নিজের মুখের ছবি ভালোবাসেন বলে জলরঙে প্রতিলিপি করিয়েছিলেন মেনকা গান্ধী
পর্ব ২৩: ড. সরোজ ঘোষ আমাকে শাস্তি দিতে চাইলেও আমাকে ছাড়তে চাইতেন না কখনও
পর্ব ২২: মধ্যবিত্ত সমাজে ঈশ্বরকে মানুষ রূপে দেখেছেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল