ঋতুদা মানে আমাদের ঋতুদার শাড়ি-গয়নায় সজ্জিত চেহারাটা হজম করতেই অসুবিধে হত। যেমন হয়েছিল তারা বাংলা-র বড়কর্তা বুদ্ধদেব গুহর মেয়ের বিয়েতে। ঋতুদা একটা জমকালো চুড়িদারের মতো পোশাক পরেছিল, সঙ্গে ওড়না ও পাগড়ি। আমায় দেখে বলল, ‘আয়, একটা ছবি তুলি।’ লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে ঋতুদার মনের মধ্যে যে অন্য একটা মন আছে , সেটা বুঝেও বুঝতে চাইতাম না। সমাজের চোখে পোশাকের একটা টাইপ আছে। হিসেব এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেল সব গন্ডগোল পাকিয়ে যায়। টি-শার্ট আর জিন্স পরা ঋতুদাকে এই পোশাকে অচেনা লাগছিল। যেন মনে হচ্ছিল লোকটা বদলে গিয়েছে!
৫০.
সব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না একটা জ্যান্ত মিউজিয়ামে বাস করার। ঋতুদার হয়েছিল। একটা বাড়ির ভেতর যে কত জিনিস জোগাড় করা যায়, এমন কম্পিটিশন হলে ঋতুদা নির্ঘাত ফার্স্ট হত! এ ব্যাপারে ঋতুদার আজীবনের সঙ্গী ছিল দিলীপ। একটা খেটো শার্ট আর ঢোলা হাফপ্যান্ট পরে বাইরের ঘরে বসে থাকত দিলীপ। গিল্ডের কার্ডহোল্ডার ছিল সেটিং ডিপার্টমেন্টের। পরে পুরোদমে ভিড়ে গিয়েছিল ঋতুদার সঙ্গে।
দিলীপের বাংলা ভাঙাভাঙা ছিল, খুব সম্ভবত বিহার যোগ, একটা অদ্ভুত ডায়ালেক্টে কথা বলত। ঋতুদার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সখ্য, ‘তুমি’ করে বলত। ঋতুদা (Rituparno Ghosh) বলল, ‘দিলীপ, ৮ নম্বর ঘর থেকে কালো টেম্পল পাড়টা বের কর…’। অমনি সে গিয়ে তিন-চারটে একই রকমের শাড়ি বের করে আনত। ঋতুদার ভাষায়, ‘ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে।’ কোনও জিনিস বুঝতে পারছে না এ’রমটা কম হত, কিন্তু না বুঝতে পারলে দিলীপও রেগে যেত! ঋতুদাকে, রেগে গিয়ে ‘আপনি’ বলত তখন। ‘আপুনি ভুল বলচেন…’ বলার পর একচোট তক্ক বাঁধত জোর! যতই তক্ক লাগুক, দিলীপ ছিল ঋতুদার অগতির অবগতি। ঋতুদা মিউজিয়ামের কিউরেটর হলে, দিলীপই তার দ্বাররক্ষী।
মজার ছলেই ঋতুদা একবার জানিয়েছিল, তার গয়নাপ্রীতির কথা। সিনেমার নায়িকারা যত গয়না পরে আসলে সবই যে ঋতুদার, সেটা শুনে অবাক হয়েছিলাম বিস্তর।
‘বলো কী! সব তোমার?’
ঋতুদা হাসত। ‘শাড়িগুলোও আমার।’
‘কী করো অত জিনিস নিয়ে?’
‘কিছুই করি না, কখনও ইচ্ছে হলে পরব ভবিষ্যতে।’
এসব কথোপকথন যখন চলছে, তখনও আমি রোদ না-আসা গলির একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। শুনলে কে জানে কেন, একটু ভয়-ভয় লাগত। ঋতুদা মানে আমাদের ঋতুদার শাড়ি-গয়নায় সজ্জিত চেহারাটা হজম করতেই অসুবিধে হত। যেমন হয়েছিল তারা বাংলা-র বড়কর্তা বুদ্ধদেব গুহর মেয়ের বিয়েতে। ঋতুদা একটা জমকালো চুড়িদারের মতো পোশাক পরেছিল, সঙ্গে ওড়না ও পাগড়ি। আমায় দেখে বলল, ‘আয়, একটা ছবি তুলি।’ লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে ঋতুদার (Rituparno Ghosh) মনের মধ্যে যে অন্য একটা মন আছে , সেটা বুঝেও বুঝতে চাইতাম না। সমাজের চোখে পোশাকের একটা টাইপ আছে। হিসেব এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেল সব গন্ডগোল পাকিয়ে যায়। টি-শার্ট আর জিন্স পরা ঋতুদাকে এই পোশাকে অচেনা লাগছিল। যেন মনে হচ্ছিল লোকটা বদলে গিয়েছে!
আমরা নিজেরাও আমাদের চারপাশের মানুষ সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ধারণা গড়ে নিই। সেই ধারণাকে ঘিরে একটা বেড়া তৈরি করি। সেখান থেকে কেউ একটু এদিক-ওদিক হলেই মুশকিল! ঋতুদা, আমাদের ঋতুদা– সে সারাক্ষণ নানা বৌদ্ধিক আড্ডার শিরোমণি, তাকে সেটুকু দেখতেই আমি স্বচ্ছন্দ, হিসেবের বাইরে হলে, মেলাতে অসুবিধে। ঋতুদার যে একটা অন্য মন থাকতে পারে, ভেবেই দেখিনি কখনও। সত্যি বলতে কী, ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন জনপ্রিয় হল, সে সময়, তাকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ কম পেয়েছে সাধারণ মানুষ। পত্রপত্রিকায় লেখা আর কাগজে ছবি– এ দেখে আসল মানুষের হদিশ পাওয়া শক্ত। ঋতুপর্ণর কথা বলার ধরন যে একেবারে আলাদা, তেমন ‘পুরুষালি’ নয়, এই ফিসফাস শুরু হয় ‘এবং ঋতুপর্ণ’ অনুষ্ঠান আর নানা টিভি ইন্টারভিউ থেকে। সেই শুরু। তারপর থেকে সে ফিসফাস গসিপদানবে পরিণত হয়েছে। যত কিছুই গসিপরস থাক, ঋতুদার প্রতি মানুষের ভালবাসা ছিল অবিমিশ্র, লোকটাকে তারা বিরল এক শিল্পী বলেই জেনেছিল।
…………………………….
ঋতুদার যে একটা অন্য মন থাকতে পারে, ভেবেই দেখিনি কখনও। সত্যি বলতে কী, ঋতুপর্ণ ঘোষ যখন জনপ্রিয় হল, সে সময়, তাকে চাক্ষুষ দেখার সুযোগ কম পেয়েছে সাধারণ মানুষ। পত্রপত্রিকায় লেখা আর কাগজে ছবি– এ দেখে আসল মানুষের হদিশ পাওয়া শক্ত। ঋতুপর্ণর কথা বলার ধরন যে একেবারে আলাদা, তেমন ‘পুরুষালি’ নয়, এই ফিসফাস শুরু হয় ‘এবং ঋতুপর্ণ’ অনুষ্ঠান আর নানা টিভি ইন্টারভিউ থেকে। সেই শুরু। তারপর থেকে সে ফিসফাস গসিপদানবে পরিণত হয়েছে।
…………………………….
ঋতুদার ব্যক্তিগত জীবনের দু’টি স্পষ্ট পর্যায়। মা চলে যাওয়ার আগে ও পরে। মাসিমাকে খুব অল্প দেখেছি আমি। দু’-একবার তাঁর হাতের রান্না খেয়েছিলাম মাত্র। ঋতুদা আলাপ করিয়ে দিয়েছিল, সেই প্রথম স্নেহকোমল, বুদ্ধিমান একজোড়া চোখ ভালোভাবে আমার দিকে তাকাল। ঋতুদার অবিশ্বাস্য একটা টান ছিল মায়ের প্রতি। তার সবটা না জানলেও এটুকু জানতাম, মা চলে গেলে ঋতুদার সব যাবে। হলও তাই। মায়ের মৃত্যু ঋতুদা কখনই মেনে নিতে পারেনি। এক অপ্রকাশিত ঋতুপর্ণর জন্ম যেন তার পর থেকে।
বহুদিন পর হঠাৎ একদিন গিয়েছি ঋতুদার বাড়ি। যত সিনেমা নিয়ে কথা বলতে চাই ঋতুদা তত এড়িয়ে যায়।
‘আরে কী নতুন প্ল্যান করছ তো বলো?’
সিনেমা ছাড়িয়ে ঋতুদার তখন আশ্চর্য সব ভেঞ্চার। ‘শোন, আমি ডাইনি ক্লাবের সম্মাননীয় সদস্য হয়েছি।’
ফ্যাক করে হেসে ফেলেছিলাম। ‘শেষে তুমি ডাইনি হয়ে গেলে?’
‘হইনি, তবে হব।’
‘বলো কী? মেম্বারশিপের সঙ্গে ঝাঁটা ফ্রি দেয় বুঝি?’
এইসব যতই ইয়ার্কি মারি, কোথায় একটা খচখচ করে মন। যে-মানুষটা চাইলেই অপূর্ব সব সিনেমা উপহার দিতে পারে, হঠাৎ এইসব বাই তার কেন উঠছে? ঈপ্সিতা বলেছে, ‘ভালো পারফর্ম করলে একটা গ্লোব দেবে।’ আমায় ঝাড়া একঘণ্টা তারপর শুনতে হল, ডাকিনীবিদ্যার গুণাগুন। কী যে বিরক্ত লাগছিল! এই সব কাল্ট, অকাল্ট– সবই আমার কাছে খুব ডিফিকাল্ট। ঋতুদাকে হঠাৎ করে খুব অচেনা লাগতে শুরু করল।
আর একটা ভয় ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে পাকাচ্ছিল। কোন এক অবাস্তবের জীবন বেছে নিচ্ছে ঋতুদা? চেনা ছকের বাইরে কোন খেলায় সে মত্ত? সিনেমা-টিনেমা ছেড়ে ঝাঁটাহাতে নব্যডাকিনী একদিন উধাও হয়ে যাবে না তো আকাশপথে?
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪৯: ‘আদরের নৌকো’ গানটার ভিডিও করার খুব ইচ্ছে ছিল ঋতুদার
পর্ব ৪৮: মঞ্চে চিফ গেস্ট ঋতুদা অটাম সোনাটা নিয়ে কথা বলছে, অথচ দর্শক গান শোনাটাই মনে করছিল জরুরি
পর্ব ৪৭: কথায় কথায় আরব সাগরের রেফারেন্স টানা দেখে বিলক্ষণ বুঝতে পারছিলাম, ঋতুদাকে বম্বে টানছিল
পর্ব ৪৬: কোনও টক শো’য় অতিথি অনুষ্ঠান শেষ করছে– এমন ঘটনা শুধু ‘এবং ঋতুপর্ণ’তেই ঘটেছিল
পর্ব ৪৫: চিত্রনাট্যের বাইরের এক সংলাপ আমাদের নগ্ন করে দিয়ে গেল
পর্ব ৪৪: একবারও মনে হয়নি, ‘চোখের বালি’তে অ্যাসিস্ট না করে কিছু মিস করছি
পর্ব ৪৩: শুভ মহরৎ-এ আমার ভদ্রতা আর প্রেমে দাগা, বন্ধুরা মেনে নিতে পারেনি
পর্ব ৪২: ‘অসুখ’-এ গৌরী ঘোষের চরিত্রে গলা দিয়েছিল ঋতুদা নিজে
পর্ব ৪১: ঋতুদার ভেলকিতে খুনের থেকেও প্রেমের জখম বড় হয়ে দাঁড়াল
পর্ব ৪০: আমার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিল সইফ আলি খান
পর্ব ৩৯: নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?