বস্তুত, চোখের বালি থেকে এক অন্য ঋতুপর্ণর যাত্রা শুরু হয়। আমি যে ইচ্ছে করলেই বোম্বেকে কলকাতায় এনে ফেলতে পারি, এমন একটা ক্ষমতার এগজিবিশনের এই সময় থেকেই সূচনা হয়। ঐশ্বর্য সেসময় ভারতের এক নম্বর নায়িকা। তিনি কিনা কলকাতায় শুট করতে আসছেন। চারিদিকে সাজো সাজো রব শুরু হয়ে গেল। এসি মেশিন বসল স্টুডিওয়। জয়শঙ্খ বাজল টলিউডে। এই ধন্য ধন্য পড়ে যাওয়া ঋতুদাকে আমার একটু অচেনা ঠেকল।
৪৪.
ব্ল্যাক ম্যাজিকের চাকরিটা আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। সারাদিন ছিল আমার আর চন্দ্রিলের ভাবার কাজ, মাঝে মাঝে লম্বা মিটিং। কলকাতার বুকে যে এর’ম একটি বিশুদ্ধ চাকরি থাকতে পারে, জানা ছিল না। কিছু স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম সেসময়, লিখতে লিখতে ঘুম পেয়ে গেলে ঘুমনোরও একটা বন্দোবস্ত ছিল। অনিন্দিতা, সুদীপা, নন্দিনী ভয়াবহ প্যাম্পার করত সমস্ত সময়, ফেরার পথে অর্ঘ্যকমল মিত্র, মানে অর্ঘ্যদা গাড়ি করে উপলের বাড়ি নামিয়ে দিত। রংগনদা, আমাদের বস, নিজের হাতে মাংস রেঁধে খাওয়াত। অপূর্ব সব পার্টি হত সিইও জয়দেবদার বাড়িতে– বাঁধন ছাড়া অথচ ওরকম প্রোডাক্টিভ অফিস আর দেখিনি কখনও। সকালে অফিস পৌঁছেই লেবুর জল খেতাম, দিনে চারবার কফি, মেশিনের কফি– সব ফ্রি ছিল। ইটিভি-তে চলত ব্ল্যাক ম্যাজিকের মাইলস্টোন প্রোগ্রাম– রোজগেরে গিন্নি। মূলত মেয়েরাই অ্যাঙ্কর করত সেটি। বিশেষ দু’টি এপিসোড হয়েছিল ছেলেদের অ্যাঙ্কর করে। সেই দুই এপিসোডের একজন অ্যাঙ্কর ছিল মীর। আরেকজন আমি। হাওড়ার কাছে একটা বাড়িতে শুটিং হয়েছিল, অনির্বাণ ছিল পরিচালক। দেখলাম, অ্যাঙ্কারিং করা বেশ ঝকমারির কাজ। পাড়ার অনেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। এঁরা সবাই আমার না, শুভঙ্করের ফ্যান– ফলে ‘শুভ মহরৎ’-এর একগাদা গল্প বলতে হয়েছিল। নতুন অফিসের ব্যস্ততায় ঋতুদাকে ফোন করা হয়নি বেশ কিছুদিন। ঋতুদা, বাড়িতে ফোন করেছিল শুনেছি। একদিন ফোন করলাম। ঋতুদা বলল, ‘‘শোন, এবার আমি ‘চোখের বালি’ করতে চলেছি, তুই পারবি তো? সব কাজ ছেড়ে করতে হবে কিন্তু! আমার ফিল্ম ক্যারিয়ারে সবচে’ ইমপরট্যান্ট ফিল্ম।’’
আমার তখন ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাজটা এত ভালো লাগছে, নতুন সব বন্ধুত্ব, বেড়ানো, শান্তিনিকেতনে আউটিং– আমি চুপ করে রইলাম। ঋতুদা যা বোঝার বুঝল। ‘এটা কিন্তু তোর কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অভিজ্ঞতা হতে পারত। দেখিস ভেবে।’
আমি করলাম না কাজটা, সেই আমি, সেই প্রথম ঋতুদার অবাধ্য হলাম। করলাম না ‘চোখের বালি’। আসলে একটা অন্য বিরক্তিও কাজ করেছিল আমার ভেতর। ঋতুদার বিনোদ চরিত্রে নন্দিতাকে বাদ দিয়ে ঐশ্বর্যকে কাস্ট করাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। তর্ক করেছি এই নিয়ে! কিন্তু ঋতুদা নিজের অবস্থানে অনড় ছিল। নন্দিতা প্রচণ্ড শক্ড হয়েছিল। কারণ ওর কাস্টিংটা পত্র-পত্রিকায় বেরিয়ে গিয়েছিল। প্রসেনজিৎ ‘মহেন্দ্র’ ঠিক আছে, কিন্তু ঐশ্বর্য রাইয়ের কাস্টিং পছন্দ হয়নি আমার। কোথাও মনে হয়েছিল, গ্ল্যামারের কাছে ঋতুপর্ণ আত্মসমর্পণ করলেন।
বস্তুত, চোখের বালি থেকে এক অন্য ঋতুপর্ণর যাত্রা শুরু হয়। আমি যে ইচ্ছে করলেই বোম্বেকে কলকাতায় এনে ফেলতে পারি, এমন একটা ক্ষমতার এগজিবিশনের এই সময় থেকেই সূচনা হয়।
ঐশ্বর্য সেসময় ভারতের এক নম্বর নায়িকা। তিনি কিনা কলকাতায় শুট করতে আসছেন। চারিদিকে সাজো সাজো রব শুরু হয়ে গেল। এসি মেশিন বসল স্টুডিওয়। জয়শঙ্খ বাজল টলিউডে। এই ধন্য ধন্য পড়ে যাওয়া ঋতুদাকে আমার একটু অচেনা ঠেকল। আমার একবারের জন্যও মনে হয়নি, ‘চোখের বালি’তে অ্যাসিস্ট না করে আমি কিছু মিস করছি।
অভিজিৎ চৌধুরীর ‘পাতালঘর’-এর পর, ব্ল্যাক ম্যাজিক তখন প্রোডিউস করছে মলয় ভট্টাচার্যর নতুন ছবি। মলয়দার প্রথম ছবি ‘কাহিনী’ দেখে আমরা প্রত্যেকেই তাঁর ফ্যান। পরের ছবি নিয়ে বিপুল আগ্রহ ছিল সবার। ‘কাহিনী’ থেকে বেরিয়ে একদম অন্য জাতের এক কমেডি করবেন বলে মনস্থির করলেন মলয়দা। ‘তিন এক্কে তিন’ বলে একটি ছবি। ব্ল্যাক ম্যাজিকের সব কিছুর নেপথ্যে ছিল অর্জুন গৌরিসারিয়ার বড় একটা ভিশন। অর্জুন মূলত বসের অফিস সামলাত। কলকাতার অফিস দেখাশোনার জন্য অর্জুনের স্ত্রী নীতি দায়িত্ব নিল। নীতির খুব ইচ্ছে ছিল ‘তিন এক্কে তিন’-এ আমি অ্যাক্টিং করি। কনীনিকার বিপরীতে তাঁর ক্যাবলা আধুনিক গায়ক বরের চরিত্র। ছবির শেষে, সে ব্যান্ড গায়ক হয়ে যাবে। আবার একটা ওইর’ম চরিত্র। ব্যাজার মুখে অডিশন দিলাম। ভাগ্য ভালো– মলয়দার পছন্দ হল না। ফলে, রেহাই পেলাম সে যাত্রায়। বরং মলয়দা উৎসাহী ছিলেন, চন্দ্রবিন্দুকে দিয়ে গান করানোর ব্যাপারে। পুরোপুরি মিউজিকের দায়িত্বে ছিল ব্ল্যাক ম্যাজিকে প্রায় দিনই আড্ডা মারতে আসা ‘চিরদীপ’– পরে অবশ্য ও ‘ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত’ বলেই পরিচিতি পায়।
দুরন্ত বেগে ব্ল্যাক ম্যাজিকের দিন কাটছিল। সেই সঙ্গে চন্দ্রবিন্দুর অনুষ্ঠান বাড়ছিল হইহই করে। খবর কাগজের পাতায়, প্রায়দিন নিজের ছবি দেখতে পাই। পার্টিতে যাওয়া শিখছি একটু একটু করে। প্রায় দিনই বাড়ি ফিরি মাঝরাত পেরিয়ে। নেশার রাস্তা দু’ভাগ হয়ে যায়, একদিক দিয়ে কখনও ফিরি, অন্যদিক নিলে আর ফিরতে পারি না কোনও দিন। এই সময়টায় আমার জীবন অনেকটাই উত্তাল। ঋতুদার চেয়ে অনেক অনেক দূরে। তবু কখনও কখনও ঋতুদার ফোন বাজে। উপলের বাড়ি সেদিন। চোখের বালির শুটিং চলছে তখন। ‘কাল তুই আর উপল প্লিজ আয়, একটা সিনে থাকবি’– আমাদের দু’জনেরই ঘোর অনীহা স্টুডিও যাওয়ায়। এলে কিন্তু একটা আশ্চর্য কিছু দেখতে পাবি। ‘কী? ঐশ্বর্যসোরাস?’ ‘না, একজন সম্পূর্ণ নগ্ন মেয়ে।’ ‘বলো কী!!! সে কী করছে?’ ‘কেন তোদের সঙ্গে অভিনয় করবে।’ কট করে ফোনটা কেটে দিল ঋতুদা।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪৩: শুভ মহরৎ-এ আমার ভদ্রতা আর প্রেমে দাগা, বন্ধুরা মেনে নিতে পারেনি
পর্ব ৪২: ‘অসুখ’-এ গৌরী ঘোষের চরিত্রে গলা দিয়েছিল ঋতুদা নিজে
পর্ব ৪১: ঋতুদার ভেলকিতে খুনের থেকেও প্রেমের জখম বড় হয়ে দাঁড়াল
পর্ব ৪০: আমার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিল সইফ আলি খান
পর্ব ৩৯: নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?