পতৌদি আর শর্মিলার আমন্ত্রণে তাঁদের প্রাসাদে লাঞ্চ করতে গিয়েছে ঋতুদা। রাজসিক ভোজনের পর, ফেরার রাস্তায় ঋতুদা বুঝতে পেরেছে তার হাতের অমূল্য আংটিটা উধাও। ফের প্রাসাদে ফিরেছে ঋতুদা আংটি খুঁজতে। প্রায় সবাই মিলে অনেক খুঁজেও যখন মিলছে না বস্তুটি, তখন ঋতুদার মনে হয়েছে, খেয়ে হাত ধোবার সময় এটা ঘটেছিল। প্রাসাদের বেসিনের গর্তে সেটা গলে যেতে পারে। ঋতুদার অনুমান সঠিক ছিল। কলের মিস্ত্রি এসে পাইপ কেটে সে আংটি উদ্ধার করে। শর্মিলা ঠাকুর এ ঘটনার পর আর ঋতুদাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন কি না জানা নেই।
৪০.
অভিনেতাদের যে একটা আলাদা ব্যাপার, ‘শুভ মহরৎ’ করতে করতেই বুঝেছি। সিনেমার ইউনিট খুব বুদ্ধিমান, প্রথমেই মেপে নেয় কার কতটা রোল বা স্ক্রিন শেয়ার। সেই অনুযায়ী খাতির বাড়তে থাকে। কস্টিউমে আছি বলে একজন এসে একটা অ্যাপ্রন পরিয়ে দেবে, আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা হবে– মনে হবে যেন পাঁচতারা বিলাস। খুব অবাক হতাম যখন প্রতিদিন লাঞ্চে আমায় মাছ, মাংস, ডিম– সব একসঙ্গে খেতে দিত। প্রথমে লজ্জা লাগত, পরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।
ঋতুদার টিম ছিল দারুণ। প্রত্যেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা রসিকতায় জমিয়ে রাখত শুটিং। এ সিনেমায় একটা বড় রোল ছিল সুমন্ত মুখোপাধ্যায় মানে মন্টুদার। আবার এ ছবির সে সহযোগী পরিচালকও বটে। মন্টুদার থেকে শিখেছিলাম, চিত্রনাট্য কীভাবে পড়ে শোনাতে হয় বাকিদের। মন্টুদা ঋতুদার অভিনয়ের মাপ জানত। ফলে কতটা বাড়বে বা কমবে– খুব সুন্দর রেগুলেট করত। আর খুব পিছনে লাগত ঋতুদার। রাখীদির বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বেড়ালটাকে নিয়ে প্রচণ্ড ভয় দেখানো হত ঋতুদাকে। তার আগে জানতাম না ঋতুদার ঘোরতর বেড়ালফোবিয়া। ঋতুদা ভয়ংকর রকমের চিৎকার করত বেড়াল কাছে এলে। এমনকী অভীকদা, যে কাজ ছাড়া কিছু বুঝতই না প্রায়, সেও মুচকি মুচকি হাসত এই হট্টমেলার শুটিংয়ে।
একটা জিনিস বুঝছিলাম, ক্রমশ কৃতজ্ঞ হচ্ছিলাম ঋতুদা কাছে, কী ‘তিতলি’ কী ‘শুভ মহরৎ’– আমার সিনেমার প্রতি অনুরাগ আরও বাড়তে শুরু করল। আর এটাও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, অভিনয় ব্যাপারটার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ক্যামেরার পিছনটা– সিনেমা মানে ডিরেক্টর। তার চোখ, তার ভিশন। যদি কিছু বলতে চাই, ওই অ্যাকশন কাট-ই হল মূলধন। অবশ্য সিনেমা বানাতে আর একটা মূলধনও লাগে, লগ্নি না হলে সেই পরম লগ্নই বা আসবে কী করে?
ইউনিটে সবাই গল্প-আড্ডায় মেতে থাকলেও, একজন ছিলেন একটু আলাদা। তিনি বেগমসাহেবা– শর্মিলা ঠাকুর। খুব কমদিন মুখোমুখি হয়েছি সেটে– গল্পটায় যতটাই কাছাকাছি ছিলাম আমরা, শুটিং শিডিউলে ততটাই দূরে। তবু একদিন ব্রেকে সবার জন্য ফিশফ্রাই এসেছে– রসিয়ে খাচ্ছে সবাই, শর্মিলা ঠাকুর বললেন– একটু টার্টার সস হবে? প্রথম হাসি পেয়েছিল, পাড়ার দোকানের ফ্রাই-তে টার্টার সস চাইলে, দোকানদার লুঙ্গি তুলে পালাবে, পরক্ষণেই মনে পড়ল, উনি বেগম এবং ঠাকুর– এসব চাওয়া ওঁকেই মানায়।
ঋতুদার সঙ্গে রিঙ্কুদির দারুণ দারুণ গল্প। তারই একটি বলি। পতৌদি আর শর্মিলার আমন্ত্রণে তাঁদের প্রাসাদে লাঞ্চ করতে গিয়েছে ঋতুদা। রাজসিক ভোজনের পর, ফেরার রাস্তায় ঋতুদা বুঝতে পেরেছে তার হাতের অমূল্য আংটিটা উধাও। ফের প্রাসাদে ফিরেছে ঋতুদা আংটি খুঁজতে। প্রায় সবাই মিলে অনেক খুঁজেও যখন মিলছে না বস্তুটি, তখন ঋতুদার মনে হয়েছে, খেয়ে হাত ধোওয়ার সময় এটা ঘটেছিল। প্রাসাদের বেসিনের গর্তে সেটা গলে যেতে পারে। ঋতুদার অনুমান সঠিক ছিল। কলের মিস্ত্রি এসে পাইপ কেটে সে আংটি উদ্ধার করে। শর্মিলা ঠাকুর এ ঘটনার পর আর ঋতুদাকে নেমন্তন্ন করেছিলেন কি না জানা নেই। তবে ঋতুদা রিঙ্কুদি বলতে অজ্ঞান ছিল।
টেনশনে ছিল রাখী ও শর্মিলার দ্বৈরথ নিয়ে। ‘দাগ’ ছবির সেটে কোনও একটা গন্ডগোল হয়েছিল এই দুই লেজেন্ডের। সে ঘটনার পর মুখ দেখাদেখি ছিল না। ঋতুদার পক্ষেই সম্ভব এমন অসম্ভবকে সত্যি করা। ফলে কলকাতা ছবির শুটিং থেকেই ফুটছিল। ‘শুভ মহরৎ’ হিট হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা।
ছবির জোজোকে ছেলেবেলায় ভীষণই ভালবাসত শর্মিলা অভিনীত চরিত্রটি। যদিও ছবিতে একবারও মুখোমুখি হয় না এই দু’জন। কিন্তু একটা ফোটোগ্রাফের প্রয়োজন ছিল ব্যাপারটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য। কম বয়সের শর্মিলা, কোলে ছেলেবেলার জোজো– এমন একটা স্মৃতির ফ্রেম দরকার ছিল। শর্মিলাদি যে ছবিটা দিয়েছিলেন, সেখানে তার কোলে ৬ বছরের সইফ আলি খান। ‘শুভ মহরৎ’ নিয়ে স্রেফ এই একটা বিরাট বুক ফোলানো রেলা– আমার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিল খোদ সইফ আলি খান!
দিনে দিনে সময় এগিয়ে এল সেই ডেঞ্জারাস সিনের। টোটা আর নন্দিতা এসেছে আমার ঘরে। বুঝতে না পেরে তোয়ালে পরে দরজা খুলে দিচ্ছি। গোটা ইউনিট পিছনে লাগছিল। মন্টুদা ‘ভয় পাস না’ বলে প্রচণ্ড জোরে কষি বেঁধে দিয়েছিল। সমস্যাটা অন্যত্র ছিল। আমি নিপাট উত্তর কলকাতা সাত লক্ষ ছয়। বাড়ির রীতি অনুযায়ী গামছাই ব্যবহার করে এসেছি চিরটাকাল। ফলে তোয়ালের ওজনটা নিয়ে টেনশন ছিল। আর গামছায় যেভাবে গিট্টু বাঁধা যায়, তোয়ালেতে যায় না। নানা টেনশনে মন্টুদাকে তিনবার বাঁধিয়েছি। নন্দিতা সে সময় একবার ঘরে কী একটা দরকারে ঢুকছিল বলে এমন তাকিয়েছি, সরি সরি, বলে আর সে পথ মাড়ায়নি।
আমার বাড়ির সেটটা পড়েছিল দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত বাড়িতে। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া একটা সুন্দর ছাদ ছিল। ঘরে নন্দিতার নানা পোজের ছবি ঝোলানো হয়েছিল। ছবিগুলো কে তুলেছিল মনে নেই, কিন্তু অপূর্ব তুলেছিল। বেশ কিছু বছর আগে সেই ফোটোগ্রাফার আমায় লগ শিটটা পাঠান। কত কী মনে পড়ে গেল ছবিগুলো দেখে। পরের বার দেখা হলে নন্দিতাকে ছবিগুলো দেব– আর খুব গল্প করব ঋতুদার পাগলামি নিয়ে।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৯: নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?