অভিনেতাদের শট দেখিয়ে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ঋতুপর্ণ ঘোষ। আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে নন্দিতার সঙ্গে শ্যাডো করে দেখাল। দেখলি কীভাবে গেলাম? আমি বিড়বিড় করে বললাম, দেখেছি, তবে তোমারটাও ধরেনি কিন্তু। আর একটুক্ষণ রাখলেই ধরবে। ঋতুদার দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে চেষ্টা করলাম এবং ব্যর্থ হলাম। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মুখে সাদা কাঠি গুঁজে কাছাকাছি আসছে এবং বকুনি খাচ্ছে– এই খেলা আরও সাত-আটবার চলল। ঋতুদার মেজাজ এবার তিরিক্ষি। ঋতুদা কঠিন মুখ নিয়ে বলল, এটা অত্যন্ত ইমপর্ট্যান্ট শট এ ছবির, আর এভাবেই নেব আমি। ওরা বোকার মরণ, তাই পারছে না।
৪১.
‘শুভ মহরৎ’-এর শুটিং শেষের দিকে। এই যে একটা নতুন খেলনাবাটি খেলায় মেতেছিলাম এতগুলো দিন, শেষের দিকটায় মনখারাপই লাগত। এটাই হয়তো শুটিংয়ের ম্যাজিক, মনে হয় অন্য এক গ্রহে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। ডিওপি অভীকদার একটা মস্ত গুণ– শিডিউলে যদি ২৫ দিন ধরা থাকে, ২২ দিনে শেষ হবেই। ঋতুদারও আশ্চর্য কনফিডেন্স অভীকদার ওপর– অভীক যখন আছে, আগেই শেষ হবে। একটা শটে আমি আর নন্দিতা অবশ্য বিস্তর ভুগিয়েছিলাম। শুভ মহরতের সবচেয়ে হিট ডায়লগ কী ছিল? নন্দিতার বলা– দু’জনকে কি একসঙ্গে ভালবাসা যায়? গোটা ছবি জুড়ে, আমার-টোটার আর নন্দিতার ত্রিকোণটা একেবারেই সাবপ্লট, মূল কাহিনি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু ওই যে, ঋতুদার ভেলকি– খুনের থেকেও প্রেমের জখম বড় হয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি ভটভটিওলা না পুলিশ– কোনদিকে ঝুঁকবে, এই টালমাটালে অমন অব্যর্থ সংলাপ– দু’জনকে কি একসঙ্গে ভালবাসা যায়? ওই সময় তেমন কিছু ভালো না লাগলেও, এখন বুঝি, সংশয়টা পোস্টমডার্নীয়। ডবল টাইমিং যাকে বলে। গাছেরও, তলারও। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শুভানুধ্যায়ীরা সহানুভূতি আর বন্ধুরা প্যাক দিয়েছিল আমায়, কিন্তু আমি মিনমিন করে বলেছিলাম– ওই যে, মল্লিকা বলল, দু’জনকে একসঙ্গে কীসব যেন…। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি, গোঁড়া না মানে লজিক। ফলে ব্যর্থ প্রেমের তোয়ালে পরে আমি বাড়ি বাড়ি সিমপ্যাথির জানলা খুলে বেড়াই। সকলকে বলি, একটা দারুণ শট ছিল শুভ মহরতের ওই দৃশ্যে, যা বাদ যায় অ্যাক্টরদের অপারগতায়। কেউ শুনতে চায় না সে গল্প। সেই অনলকাঠির করুণ ছোঁয়ার এপিসোডই তবে লিপিবদ্ধ হোক আজ।
এই দু’জনকে ভালবাসাবাসির কথা-টথার শেষে ঋতুদা এক অভিনব দৃশ্যের পরিকল্পনা করেছিল। কেমন সে দৃশ্য? ফ্রেমের এককোণ দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে নেমে আসবে নন্দিতার মুখ, অন্য প্রান্ত থেকে সিগারেট মুখে আমি ঢুকে, আমারটা জ্বালিয়ে নেব। সিনেমার পরিভাষায় ক্লোজ টাইট কম্পোজিশন। কিন্তু আমাদের কাছে ব্যাপারটা ক্লোজ এবং অতি টাইট দাঁড়িয়ে গেল। ঋতুদার ভাবনায়, এই অগ্নিসংযোগের বহুবিধ অর্থ থাকতে পারে। সম্পর্কে হালকা ঘৃতাহুতি দেবে এই আগুন ছোঁয়া, এগিয়ে আসার ভঙ্গিটা চুম্বনের কিন্তু আসলে ছুতোটা সিগারেট ধরানোর– এইসব নানা উদ্দেশ্য-বিধেয়-সমাস-কারক। প্রথমে আমারও ব্যাপারটা মজারই লাগছিল। সংলাপ তো নেই, জাস্ট আগুন ধরানো। এই ধরনের দৃশ্য করতে গেলেই পেটের ভেতর হাসি ভসভসিয়ে ওঠে, কিন্তু কোনওরকমে কনুইয়ে রামচিমটি দিয়ে শট দিতে গেলাম।
প্রথম শটে আমার সিগারেট গিয়ে সজোরে ধাক্কা দিল নন্দিতার সিগারেটে, ওর মুখ থেকে ফস করে পড়ে গেল নিচে। ঋতুদা বলল, ‘উফ্ফ আস্তে আস্তে এগো’। লজ্জার একশেষ। ঠিকই তো, এভাবে হুট করে মুখ নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি মোটে। আবার রোল ক্যামেরা, অ্যাকশন। এবারে বিপত্তি ঘটল নন্দিতার। সিগারেটে সিগারেটে টোকা খেয়ে ওরটা পড়ে গেল মাটিতে। জ্বলন্ত সিগারেট, হইহই, আগুন নেভানো। আবার চালু হল সিন। প্রথম দু’বারে ধ্যাড়ানোয় দু’জনেই সাবধানী। সন্তর্পণে যেতে যেতে একটা টাইমে বুঝতে পারলাম আমাদের সিগারেটরা কখন একে অপরকে টপকে চলে গিয়েছে। গোটা ইউনিট হাসতে লাগল। ঋতুদার কপালে ভাঁজ। একটা সামান্য কাজ, সেটুকুও করতে পারছিস না তোরা। আমি সিগারেট খাই না। কিন্তু এক মুহূর্তে এটা করে দিতে পারি।
অভিনেতাদের শট দেখিয়ে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ঋতুপর্ণ ঘোষ। আমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে নন্দিতার সঙ্গে শ্যাডো করে দেখাল। দেখলি কীভাবে গেলাম? আমি বিড়বিড় করে বললাম, দেখেছি, তবে তোমারটাও ধরেনি কিন্তু। আর একটুক্ষণ রাখলেই ধরবে। ঋতুদার দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে চেষ্টা করলাম এবং ব্যর্থ হলাম। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মুখে সাদা কাঠি গুঁজে কাছাকাছি আসছে এবং বকুনি খাচ্ছে– এই খেলা আরও সাত-আটবার চলল। ঋতুদার মেজাজ এবার তিরিক্ষি। মন্টুদা বলল, অন্য কোনওভাবে যদি নেওয়া যায় ব্যাপারটা…! ঋতুদা কঠিন মুখ নিয়ে বলল, এটা অত্যন্ত ইমপর্ট্যান্ট শট এ ছবির, আর এভাবেই নেব আমি। ওরা বোকার মরণ, তাই পারছে না।
এবার সত্যি নার্ভাস হয়ে গেলাম দু’জনে। নন্দিতা বলল, ঋতুদা একটু টাইম দেবে আমাদের, প্র্যাকটিস করব। মিনিট দশেক প্র্যাকটিস সেশন চলার পর, আবার শুরু হল ধোঁয়াবাজি। প্রতিটি অ্যাটেম্পটেই ডাহা ফেল। অভীকদা বিপদতারণ হয়ে দাঁড়াল। বোঝাল, একটা হাত না ইউজ করলে, সিগারেট কোনওভাবেই ধরবে না। ঋতুদা বলল, হতেই পারে না। আমি আর নন্দিতা ভ্যাবলার মতো বসে রইলাম, দেখলাম ইউনিটের সবাই নিজস্ব সঙ্গী বেছে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। শুভ মহরতের শুটিংয়ে আর কোনও শটের পিছনে এতখানি সময় যায়নি। নানা নিরীক্ষার পর, সকলে একমত হল, হাত মাঝখানে না থাকলে, সায়েন্স বলছে, এভাবে ধরে না। ঋতুদা খেপে উঠল, দুটো মুখের মাঝখানে হাত এসে গেলে তো সিনটার ব্যঞ্জনাটাই মাটি। আরও কিছুক্ষণ গুজগুজ করে মিটিং চলার পর, ঘোষণা হল– এ শট হবে না, সিনটাই বাতিল। আমি আর নন্দিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম সুখটান দিতে। ঘটনাচক্রে সেদিন বেশ কিছু কাগজের ফোটোগ্রাফার ছিল। শটটা তাদের ক্যামেরায় ধরা ছিল ভালোভাবে। শুভ মহরৎ তখন রিলিজ করে গিয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় যে রিভিউ বেরিয়েছিল, সেখানে আমার আর নন্দিতার ওই অপ্রকাশিত সিনটার ছবি ছিল। একটা না-হওয়া সিনই ছিল আসল অরিজিনাল সিন। ছবিটা চলে গিয়েছে, অপদার্থ সিগারেট বাটগুলো, এমনকী ঋতুদাও, শুধু তামাকপাতার গন্ধ আর ধোঁয়ার উত্তাপটা রয়ে গেল আজও। যে আগুন ধরাতে পারিনি, তার ফুলকি এখনও মায়াময়।
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪০: আমার ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিল সইফ আলি খান
পর্ব ৩৯: নন্দিতার জন্য নার্ভাস ছিলাম না, রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিলাম
পর্ব ৩৮: টোটার দেওয়া ডায়েট চার্ট পেয়ে নিজেকে হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল
পর্ব ৩৭: ফিরে এল কলেজবেলার কমপ্লেক্স– নন্দিতা দাস আমার চেয়ে লম্বা নয়তো?
পর্ব ৩৬: আমার ডিটেকটিভ একজন মহিলা, বলেছিল ঋতুদা
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?