
মেসি এন্টারটেনার নন। তিনি পারফর্মার। চিত্রনাট্য অভিনীত জীবন তাঁর নয়, ডিফেন্ডারের পা কোনও কল্পিত স্ক্রিপ্ট মেনে চলে না! মেসি যে খেলাটা খেলেন, সেটা জনমত নির্ভরশীল নয়। প্রখর বাস্তব। রুক্ষ সত্যের পৃথিবী। অতএব দিন শেষে তাঁরও একটা দায় থাকে, সূক্ষ্ম হলেও থাকে।
২৯.
লিওনেল মেসির মধ্যে অ্যাদ্দিন বেশ একখানা ব্যাপার ছিল। দৈব-দৈব। ঘোর-ঘোর। ঈশ্বর-ঈশ্বর। মায়া-মায়া। এক অপার্থিব আলোকবর্তিকা যেন আগলে রাখত আর্জেন্টিনা ফুটবলের রাজপুত্রকে। রাখত লিখছি কারণ, বিগত দিন কয়েক ধরে সে জ্যোতি আর দেখতে পাচ্ছি না! অনুভব করতে পারছি না। কোথাও যেন কিছু একটা হয়েছে, কোথাও তাল কেটেছে, মোহ টাল খেয়েছে। এবং সব হয়েছে বা হচ্ছে, তাঁর ভারত সফর শেষে।

এই ফাঁকে লিখে ফেলি, ব্যক্তিগতভাবে আর্জেন্টিনা পূজারি হলেও আমি উগ্র মেসি-উপাসক না। বরং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আমায় টানেন বেশি, আকর্ষণ করেন বেশি। কিন্তু সে তো নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিগত ভালো লাগা-খারাপ লাগার জায়গা। তাতে মেসি নিয়ে বিশ্ব মতবাদ কিংবা বাস্তব সত্যের বাস্তুভিটে, কিছুই বদলায় না। এটা অনস্বীকার্য যে, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির লিওনেল কালজয়ী প্রতিভা, ফুটবলের যুগ পুরুষ। স্বয়ং ঈশ্বর যাঁর বাঁ পা-খানি অনেক সময় নিয়ে, যত্ন নিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যা দিয়ে আপন খেয়ালে মাঠ-ঘাটে ছবি আঁকেন তিনি, শিল্পের রং-তুলিতে, দেব-বাগিচার ক্যানভাসে।
জানি না, সহমত হবেন কি না? হয়তো হবেন। হয়তো হবেন না। হয়তো বা কুপিতও হবেন। কিন্তু মেসির ভারত-সফর উত্তর সময়ে একটা জিনিস বারবার মনে হচ্ছে। মেসি আমাদের মতো মধ্য মেধার শ্রেণির বড় কাছাকাছি চলে এলেন। তালুবন্দি হয়ে পড়লেন! ধরা-ছোঁয়া কিংবা সাধ্য-সীমানার বাইরে তিনি আর থাকলেন না। আসলে মেসির ভারত সফরে শুধুমাত্র যুবভারতীর বিশৃঙ্খলা ছিল না। অগোচরে আরও একটা জিনিস প্রবলভাবে ছিল। ক্ষমতা-অর্থের যৌথ উচ্ছৃঙ্খলতা। যার পেশি শক্তির জোরে, বিশ্বজয়ী ফুটবলারের পাশে দাঁড়িয়ে অনায়াসে চবর-চবর করে চুইংগাম চিবনো যায়। মেসির মহানতার প্রতি ন্যূনতম দৃকপাত না করে, তাঁকে সামান্যতম সম্মান না করে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবীশের স্ত্রী অম্রুতা, মেসি নাকি পাড়ার মন্টু, সে দিন ঠিক কার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন– বিশেষ বোঝা যায়নি। ঠিক তেমনই, বনতারায় হাতির সঙ্গে মেসিকে ফুটবল খেলিয়ে, কোন উদ্দেশ্য সাধন হয়েছে, জানি না।

নয়াদিল্লির অনুষ্ঠান আবার আইসিসি চেয়ারম্যান জয় শাহ-র উপস্থিতিতে পুরোদস্তুর আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রোমোশনাল ইভেন্টে পরিণত হয়েছিল! না, একবারও যুবভারতীকে আড়াল করতে চাইছি না। যুবভারতীর মেসি-অনুষ্ঠান ঘিরে যা হয়েছে, তা চরমতম বিশৃঙ্খলা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে জঘন্য অন্যায়। কিন্তু ভারতে বাদবাকি জায়গার মধ্যে একমাত্র হায়দরাবাদ বাদ দিলে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে কিছু না কিছু দৃষ্টিকটু কীর্তিকলাপ ঘটেছে। যা খাটো করে দিয়েছে, লিওনেল মেসি নামক এক ফুটবল-ধ্রুবতারার উপস্থিতিকে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বোধহয়, সূচি বদলে বনতারায় মেসির আকস্মিক আগমন। আম্বানিদের তাঁকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে ঢাক না-বাজিয়েও বলে রাখি, ‘এলএম ১০’ যে দিল্লি থেকে ফেরার ফ্লাইট না ধরে আচমকা জামনগরের বনতারার উদ্দেশে যাত্রা করছেন, খবরখানি করেছিল এ অধম। জানতে পারি, বনতারায় এক রাত থাকার জন্য ১০০ কোটি টাকার প্রস্তাব গিয়েছে মেসির কাছে। যা গ্রহণ করতে তিনি দ্বিরুক্তি করেননি। কিন্তু যাওয়ার পর যা যা ঘটতে দেখলাম, পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি এখনও।

বাঘ-সিংহ দেখানো, তার ছবি তোলা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু মেসির বলে শট মেরে-মেরে হাতির কাছে পাঠানো? শিবের মাথায় তাঁর জল ঢালা? উপুড় হয়ে সিদ্ধিদাতা গণেশকে প্রণাম করা? কেউ কেউ বলতে পারেন, শিবের মাথায় মেসি জল ঢেলেছেন তো কী হয়েছে? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে? উত্তরে বলব, তলিয়ে ভাববেন একবার বিষয়টা। মহাদেব, সিদ্ধিদাতা গণেশ, দুর্গা-কালী, আমাদের আরাধ্য দেব-দেবী। আমরা যাঁদের ভক্তিভরে উপাসনা করি, পুজো করি। যা করি, অন্তর থেকে। কিন্তু লিওনেল মেসি কি বনতারায় পদার্পণের আগে পর্যন্ত জানতেন, সনাতনী সংস্কৃতিতে মহাদেবের মাহাত্ম্য কী? আচ্ছা চলুন, ধরেও নিলাম, জল ঢালার আগে শিব সম্পর্কে তাঁকে সমস্ত বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেসির মনে ভক্তির সঞ্চার ঘটেছিল। তা হলে সেটাকে একান্ত ব্যক্তিগত রাখা যেত। আমার পুজো, আমার আচ্চা, আমার ভক্তি, আমার উপাসনা তো একান্তই আমার। বারোয়ারি নয়। তা হলে মেসির শিবের মাথায় জল ঢালার ছবি-ভিডিও প্রকাশ্য করে দিকে-দিকে সোশাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল কেন? কোন যুক্তিতে? এটা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রচার নয়? ব্যক্তিগত মুহূর্তকে সার্বজনীন করে দেওয়া নয়? অর্থের বড়াই করে বোঝানো নয় যে, ১০০ কোটি টাকা দিয়েছি, দ্যাখো মেসিকে দিয়ে আমরা যা ইচ্ছে, যা মন চায়, করাতে পারি!

এটাও বুঝে পেলাম না, মেসিও বা এ সমস্ত নির্বিরোধে মেনে নিলেন কেন? জানি তাঁর ভক্তরা বলবেন, অপরাধটা কোথায়? ভারতে তিনি ফুটবল খেলতে আসেননি। ফুটবল-ধর্মপ্রচারেও আসেননি। তিনি এসেছিলেন, অর্থ রোজগার করছে। তাঁকে এনে ব্যবসায়ীরা রোজগার করেছেন। তিনিও করেছেন। এবং বেশ করেছেন। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু তার পরেও ভুল-ঠিকের একটা সীমান্তরেখা থাকে। ‘পারসেপশন’ বলে একটা বস্তু থাকে। যার ঊর্ধ্বে ওঠা না ওঠা, সম্পূর্ণ ব্যক্তিবিশেষের সিদ্ধান্ত। মেসি ঠিক মনে করেছেন, তাই সমস্তে সায় দিয়েছেন। কিন্তু ‘পারসেপশন’-এর ওপর তাঁর অধিকার নেই। সেটা আবার জন-চিন্তার দরবার।
আম্বানির ছেলের বিয়েতে নেচে শাহরুখ খান একবার তীব্র সমালোচিত হয়েছিলেন। যদিও তাতে দোষের কিছু পাইনি। শাহরুখ এন্টারটেনার। বিনোদন প্রদান করাই তাঁর কাজ। তাঁর পেশা। তা সে পর্দায় হোক বা মঞ্চে। কিন্তু মেসি এন্টারটেনার নন। তিনি পারফর্মার। চিত্রনাট্য অভিনীত জীবন তাঁর নয়, ডিফেন্ডারের পা কোনও কল্পিত স্ক্রিপ্ট মেনে চলে না! মেসি যে খেলাটা খেলেন, সেটা জনমত নির্ভরশীল নয়। প্রখর বাস্তব। রুক্ষ সত্যের পৃথিবী। অতএব দিন শেষে তাঁরও একটা দায় থাকে, সূক্ষ্ম হলেও থাকে। তাই আপনি মানুন কিংবা না মানুন। বিশ্বাস করুন বা না করুন। ভারতে মেসি-সফর অজান্তে একটা বার্তা দিয়ে গিয়েছে।
সঠিক দর পেলে ফুটবল-ঈশ্বরও বিক্রি হন। অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ভাবে বিক্রি হন!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২৮: ব্রিগেডে গরিব মার খেলে কলকাতার এখনও শ্বাসকষ্ট হয়
পর্ব ২৭: রিলের পুজোয় রিয়েল পুজোর গন্ধ নেই!
পর্ব ২৬: আমার মূর্তির অনতিদূরে যদি রমার একটা মূর্তি করা যায়
পর্ব ২৫: তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলাদেশি’ ভাষায় ‘সোনার বাংলা’, আর বাংলায় ‘জনগণমন’ লিখেছিলেন?
পর্ব ২৪: বর্ষাকাল মানেই বাঙালির কনফিউশনের বন্যা!
পর্ব ২৩: ও ক্যাপ্টেন! মাই ক্যাপ্টেন!
পর্ব ২২: শচীন-বিরাটরা আসেন-যান, ভারত থেকে যায়
পর্ব ২১: কিং কোহলি দেখালেন, ধৈর্যের ফল বিরাট হয়
পর্ব ২০: মনকে শক্ত করো টেস্ট, রাজা আর ফিরবেন না
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved