এত বছর ধরে লেখা বানু মুস্তাকের অজস্র গল্প থেকে ১২টি গল্প সবে বেরিয়েছে পেঙ্গুইন থেকে। অনন্য ইংরেজি অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্থির। প্রতিটি গল্পের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মুসলমান পরিবারে মুসলমান পুরুষের হাতে মুসলমান নারীর পীড়ন, নারীর আর্তনাদ, নারীর প্রতিবাদ ও নারীর জয়। একটি গল্পে ঈশ্বরকে বলা হচ্ছে, হে ভগবান, একটিবার তুমি নারী হয়ে জন্মাও। বুঝবে কাকে বলে জীবন যন্ত্রণা!
৪১.
১৯৯০ থেকে ২০২৩– ৩০ বছরের বেশি পথ, ভাবনা, অনিশ্চয়তা, শ্রম ও প্রত্যয়। কিন্তু এত বছর ধরে বানু মুশতাকের লেখার টেবিল একই জায়গায়, বলে যাচ্ছে একই কথা। বানুর মনের মধ্যে একটা ঘর আছে। সেই ঘরের একটি মাত্র জানলা। যে জানলায় শুধু সূর্যাস্ত হয়। সূর্যোদয় দেখেনি কোনও দিন ওই জানলা।
বানু মুশতাক যখনই মনের মধ্যে ওই ঘরের জানলায় চোখ রাখে, তখনই তাঁর লেখার টেবিলের গায়ে এসে পড়ে ডুবসূর্যের বিদায়ী বিষণ্ণ রাঙা। আর লেখার টেবিল সেই আলো বুকে নিয়ে বানুকে বলে, আমার বুকে খোদাই করা এই রাঙা থেকে শুষে নাও তোমার লেখার বিষয় ও ভাষা। তোমার ভাবনা ও প্রসার। বানু, তোমাকে লিখতে হবে শুধু তোমার মতো মুসলমান মেয়েদের অপমান, অসম্মান, বেদনা ও বিপ্লবের গল্প। তারা অনেক মেয়ে হয়েও একটি মেয়ে। সেই মেয়ে তুমি। সব গল্প যেন হয়ে ওঠে তোমারই গল্প। আর তোমার গল্প লিখবে সেই ভাষায়, যে ভাষায় তুমি কথা বলো। সাহিত্যের ভাষা নয়। প্রাণের ভাষা। রক্ত মাংসের জ্যান্ত ভাষা!
বানু মুশতাক ঠিক তাই করেছেন। লেখার টেবিলের কথা শুনেছেন। লেখার টেবিলের উপদেশ খোদাই করে নিয়েছেন তাঁর চেতনায়। তিনি লিখেছেন শুধু মেয়েদের গল্প। দক্ষিণ ভারতের মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মুসলমান মেয়েদের জীবন যন্ত্রণা, একাকিত্ব, বঞ্চনা ও লড়াইয়ের কথা। পুরুষশাসিত সমাজ-সংসার কী বিপুল বিরোধী তাদের! কিন্তু বানু মুশতাক তাঁর লেখার টেবিলের আদেশ শুনেছেন। কোনও গল্পে লেখেননি নারীর পরাজয়ের কথা। কোনও একটি মেয়েরও হেরে যাওয়ার গল্প লেখেননি তিনি।
লেখার টেবিলের আরও একটি পরামর্শ মেনে চলেছেন বানু। তিনি ৩০ বছর বয়সে কন্নড় ভাষায় গল্প লিখে একটু নাম করতে শুরু করেন। টেবিল তখনই তার কানে কানে বলে একদিন, এই যে তোমার নামটাম হচ্ছে, দেখো, মাথা না ঘুরে যায়। খ্যাতির লোভে ভুল পথে পা বাড়িও না। মনে রেখো, তোমার লেখার বিষয় দক্ষিণ ভারতের ঘরে ঘরে সাধারণ মুসলমান মেয়েদের মুসলিম পুরুষের হাতে লাঞ্ছনা, যাতনা, অপমান। ১৯৯০ থেকে ২০২৫– এই দীর্ঘ সময় ধরে বানু মুশতাক তাঁর লেখার বিষয় থেকে সরে যাননি।
………………………………..
বানু মুশতাক লিখেছেন শুধু মেয়েদের গল্প। দক্ষিণ ভারতের মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মুসলমান মেয়েদের জীবন যন্ত্রণা, একাকিত্ব, বঞ্চনা ও লড়াইয়ের কথা। পুরুষশাসিত সমাজ-সংসার কী বিপুল বিরোধী তাদের! কিন্তু বানু মুশতাক তাঁর লেখার টেবিলের আদেশ শুনেছেন। কোনও গল্পে লেখেননি নারীর পরাজয়ের কথা। কোনও একটি মেয়েরও হেরে যাওয়ার গল্প লেখেননি তিনি।
………………………………..
এত বছর ধরে লেখা বানু মুশতাকের অজস্র গল্প থেকে ১২টি গল্প সবে বেরিয়েছে পেঙ্গুইন থেকে। অনন্য ইংরেজি অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্থির। প্রতিটি গল্পের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মুসলমান পরিবারে মুসলমান পুরুষের হাতে মুসলমান নারীর পীড়ন, নারীর আর্তনাদ, নারীর প্রতিবাদ ও নারীর জয়। একটি গল্পে ঈশ্বরকে বলা হচ্ছে, হে ভগবান, একটিবার তুমি নারী হয়ে জন্মাও। বুঝবে কাকে বলে জীবন যন্ত্রণা!
এই বই প্রকাশিত হয়েই বাজিমাত করেছে। ২০২৫ এর আন্তর্জাতিক বুকার প্রাইজ পেলেন বানু মুশতাক। তিনি রাতারাতি আন্তর্জাতিক সেলেব! পৃথিবী জুড়ে বিক্রি হবে তাঁর ১২টি গল্প নিয়ে এই বই– ‘হার্ট ল্যাম্প’। এই প্রথম কোনও ছোটগল্পের বই বুকার পেল। এই পুরস্কারের অর্থ মূল্য প্রায় ৫৭ লক্ষ টাকা। এই পুরস্কার বানু ভাগ করে নেবেন অনুবাদক দীপার সঙ্গে। ‘খবরটা পেয়ে আপনার কেমন লাগছে? কোনওদিন কি আশা করেছিলেন, আপনি পাবেন প্রায় ৫৭ লক্ষ টাকার এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার?’ লন্ডনে পুরস্কার নেওয়ার সময় এই প্রশ্নের মুখে পড়লেন প্রায় ৭৭ বছরের বানু মুস্তাক। চোখ বুজে মনের ঘরের মধ্যে সেই লেখার টেবিলটিকে স্মরণ করলেন তিনি। এবং মুহূর্তে তাঁর মুখে উচ্চারিত হল এই বাক্য: ‘This moment feels like a thousand fireflies lighting up a single sky!’
‘হার্ট ল্যাম্প’ ইতিমধ্যেই কলকাতার বইবাজারের হৃদয় আলো করে বিরাজ করছে। প্রতিটি গল্পই রত্ন: ‘রেড লুঙ্গি’, ‘ব্ল্যাক কোবরাস’, ‘হাই হিলড শু’, ‘ফায়ার রেন’, ‘বি এ উওমান ওয়ান্স ওহ্ লর্ড’, ‘এ ডিসিশন অফ দ্য হার্ট’, ‘দ্য শ্রাউড’, ‘এ টেস্ট অফ হেভেন’, ‘স্টোন স্ল্যাবস ফর শাহিস্থা মহল’ এবং ‘হার্ট ল্যাম্প’।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৪০: গোয়েটের ভালোবাসার চিঠিই বাড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সুইসাইড প্রবণতা
পর্ব ৩৯: লেখার টেবিল বাঙালির লাজ ভেঙে পর্নোগ্রাফিও লিখিয়েছে
পর্ব ৩৮: বঙ্গীয় সমাজে বোভেয়ার ‘সেকেন্ড সেক্স’-এর ভাবনার বিচ্ছুরণ কতটুকু?
পর্ব ৩৭: ভক্তদের স্তাবকতাই পাশ্চাত্যে রবীন্দ্র-কীর্তি স্থায়ী হতে দেয়নি, মনে করতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী
পর্ব ৩৬: একাকিত্বের নিঃসঙ্গ জলসাঘরে মারিও ভার্গাস লোসা যেন ছবি বিশ্বাস!
পর্ব ৩৫: জীবনের বাইশ গজে যে নারী শচীনের পরম প্রাপ্তি
পর্ব ৩৪: যা যা লেখোনি আত্মজীবনীতেও, এইবার লেখো, রাস্কিন বন্ডকে বলেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৩৩: ফিওনার সেই লেখার টেবিল মুছে দিয়েছিল মেয়েদের যৌনতা উপভোগের লজ্জারেখা
পর্ব ৩২: বাঙালি নয়, আন্তর্জাতিক বাঙালির সংজ্ঞায় স্পিভাক এসে পড়বেনই
পর্ব ৩১: প্রতিভাপাগল একটি বই, যাকে দিনলিপি বলে সামান্য করব না
পর্ব ৩০: পতিতালয়ের সেই লেখার টেবিল জাগিয়ে তুলেছিল ইসাবেলের হৃদয়-চেতনা
পর্ব ২৯: পাথরে প্রাণ আনে যে টেবিলের স্পর্শ
পর্ব ২৮: নিজের টেবিলকে কটাক্ষ করি, কেন অ্যানে মাইকেলসের মতো লিখতে পারি না?
পর্ব ২৭: নারীর রাগ-মোচনের কৌশল জানে মিলান কুন্দেরার লেখার টেবিল!
পর্ব ২৬: ভালোবাসা প্রকাশের সমস্ত শব্দ পেরিয়ে গিয়েছিল এলিয়টের লেখার টেবিল
পর্ব ২৫: যে টেবিলে জন্ম নেয় নগ্নতা আর যৌনতার নতুন আলো
পর্ব ২৪: প্রেমের কবিতার ভূত জন ডানকে ধরেছিল তাঁর উন্মাদ টেবিলে, মোমবাতির আলোয়
পর্ব ২৩: যে টেবিল আসলে বৈদগ্ধ আর অশ্লীলতার আব্রুহীন আঁতুড়ঘর!
পর্ব ২২: মহাবিশ্বের রহস্য নেমে এসেছিল যে টেবিলে
পর্ব ২১: গাছ আমাদের পূর্বপুরুষ, লেখার টেবিল বলেছিল হোসে সারামাগোকে
পর্ব ২০: টেবিলের কথায় নিজের ‘হত্যার মঞ্চে’ ফিরেছিলেন সলমন রুশদি
পর্ব ১৯: প্রতিভা প্রশ্রয় দেয় অপরাধকে, দস্তয়েভস্কিকে শেখায় তাঁর লেখার টেবিল
পর্ব ১৮: বিবেকানন্দের মনের কথা বুঝতে পারে যে টেবিল
পর্ব ১৭: ‘গীতাঞ্জলি’ হয়ে উঠুক উভপ্রার্থনা ও উভকামনার গান, অঁদ্রে জিদকে বলেছিল তাঁর টেবিল
পর্ব ১৬: যে লেখার টেবিল ম্যাকিয়াভেলিকে নিয়ে গেছে শয়তানির অতল গভীরে
পর্ব ১৫: যে অপরাধবোধ লেখার টেবিলে টেনে এনেছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে
পর্ব ১৪: লেখার টেবিল গিলে নিচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফের লেখা ও ভাবনা, বাঁচার একমাত্র উপায় আত্মহত্যা
পর্ব ১৩: হ্যামনেট ‘হ্যামলেট’ হয়ে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল, জানে সেই লেখার টেবিল
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল