পশুর মতো হাতে-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলা মানবশিশুর পক্ষেও সহজতর, কিন্তু মানুষকে যে মাথা তুলে দাঁড়াতেই হবে। এই খাড়া হয়ে দাঁড়ানোর সাধনাই যেন তার মনুষ্যত্ব-সাধনার প্রথম ধাপ। মাধ্যাকর্ষণের প্রবল টানকে জয় করে দুই পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে বলেই দু’টি হাতকে মুক্ত করে মানুষ পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্বের অধিকার পেয়েছে। আকাশের আলোর মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে বলেই মানুষ অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র অসীম বৃহ্মাণ্ডের সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ উপলব্ধি করে আনন্দিত হয়েছে। এই আনন্দ তার মনুষ্যত্বের গৌরব।
১৯.
মানুষের পক্ষে মানুষ হয়ে ওঠা সব দিক থেকেই কঠিন। গোড়া থেকেই মানুষের পক্ষে কিছুই সহজ নয়। একথা রবীন্দ্রনাথ বলছেন উপাসনাগৃহে ‘দুর্লভ’ অভিভাষণে।
“ঈশ্বরের মধ্যে মনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনে, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, এই কথা অনেকের মুখে শোনা যায়। ‘পারি নে’ যখন বলি তার অর্থ এই, সহজে পারি নে; যেমন করে নিশ্বাস গ্রহণ করছি, কোনো সাধনার প্রয়োজন হচ্ছে না, ঈশ্বরকে তেমন করে আমার চেতনার মধ্যে গ্রহণ করতে পারি নে।”
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছেন মানুষ হয়ে ওঠা যতই কঠিন হোক, তবু মানুষকে তা পারতেই হবে। “যেখানে সে বলবে ‘আমি পারি নে’ সেইখানেই তার মনুষ্যত্বের ভিত্তি ক্ষয় হয়ে যাবে, তার দুর্গতি আরম্ভ হবে; সমস্তই তাকে পারতেই হবে।”
সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুই পায়ে চলতে শেখা সহজ হয় না মানুষের পক্ষে। বারে বারে পড়তে হয়, আবার উঠতে হয়। অভ্যাস করে যেতেই হয়। পারি না বলে দিয়ে ছাড় পাওয়ার উপায় থাকে না। পশুশাবকের জীবনে এই কঠিন সাধনা নেই। পশুর মতো হাতে-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলা মানবশিশুর পক্ষেও সহজতর, কিন্তু মানুষকে যে মাথা তুলে দাঁড়াতেই হবে। এই খাড়া হয়ে দাঁড়ানোর সাধনাই যেন তার মনুষ্যত্ব-সাধনার প্রথম ধাপ। মাধ্যাকর্ষণের প্রবল টানকে জয় করে দুই পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে বলেই দু’টি হাতকে মুক্ত করে মানুষ পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্বের অধিকার পেয়েছে। আকাশের আলোর মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে বলেই মানুষ অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র অসীম বৃহ্মাণ্ডের সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ উপলব্ধি করে আনন্দিত হয়েছে। এই আনন্দ তার মনুষ্যত্বের গৌরব।
একই ভাবে সমাজের মধ্যে চলাও মানুষকে কষ্ট করে শিখতে হয়। খাওয়া-পরা, শোওয়া-বসা, চলা-বলা, প্রতি পদক্ষেপে কত রকমের নিয়ম সংযম তাকে অভ্যাস করতে হয়। মানুষের সঙ্গে তার আদানপ্রদান সহজ আনন্দের হয়ে ওঠার আগে কত বিরক্তির কারণ হতে হয়, কতরকম দুঃখ অপমানের আঘাত তাকে বহন করতে হয়।
তারপর আসে জ্ঞানের রাজ্যে অধিকার লাভের সাধনা। যা কিছু প্রতিদিন চোখে দেখছি কানে শুনছি, সবকিছুকে সহজ আরামে যেমন দেখছি যেমন শুনছি স্বীকার করে নিলে মানুষের চলে না। সেজন্য বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কত বিরাট আয়োজনের বোঝা সমাজকে বহন করতে হয়। জীবনের প্রথম পঁচিশ-তিরিশ বছর মানুষকে শিক্ষা সমাধা করতেই কাটিয়ে দিতে হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যতই সহজ আর আরামের হোক, তবু পশুর মতো মাটির দিকেই মাথা নামিয়ে না চলার একটা তাগিদ ছিল বলেই মানুষ বহু চেষ্টায় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মাথা তুলে সে পৃথিবীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি, বরং পশুর থেকে তার অধিকার অনেক বড় হয়েছে। জন্তু চার পায়ে চলে বলে হাতের ব্যবহার পায় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘প্রথম থেকেই সহজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে এই প্রবৃত্তি মানুষের পক্ষে এমনি স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, অনাবশ্যক দুঃসাধ্যসাধনও তাকে আনন্দ দেয়। আর কোনও প্রাণীর মধ্যে এই অদ্ভুত জিনিসটা নেই।’ সহজ আরামের যা কিছু, মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী তার ব্যতিক্রমে খুশি হতে পারে না। সকল প্রাণীর জীবনে যা কিছু সাধ্যসাধনা সব প্রয়োজন মেটানোর জন্য, মানুষই কেবল বিনা প্রয়োজনের কঠিন কাজ করে আনন্দ পায়, কাজটা কঠিন বলেই তার আনন্দ। দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ মরু সাগর অতিক্রম করে আনন্দ, কঠিন কঠিন খেলা তৈরি করে আনন্দ। সহজ নয় বলেই যেন সে খেলা মানুষের কাছে সুখের, আমোদের।
যতই সহজ আর আরামের হোক, তবু পশুর মতো মাটির দিকেই মাথা নামিয়ে না চলার একটা তাগিদ ছিল বলেই মানুষ বহু চেষ্টায় আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মাথা তুলে সে পৃথিবীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি, বরং পশুর থেকে তার অধিকার অনেক বড় হয়েছে। জন্তু চার পায়ে চলে বলে হাতের ব্যবহার পায় না। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, বিষয়ী লোক সংসারে চারপায়ে চলে, ভাল করে কিছু দিতেও পারে না, নিতেও পারে না। সংসারের প্রয়োজনের মাটি থেকে মাথা তুলতে না পারলে দেওয়ার শক্তি, নেওয়ার শক্তি পূর্ণতা লাভ করে না। ত্যাগের শক্তিতেই মানুষকে বড় হতে হয়, ‘পারি না’ বলা চলে না। ত্যাগের শক্তিই সৃষ্টিশক্তি। ‘যে সৃষ্টিকর্তা সে আপনাকে সর্জন করে, আপনাকে ত্যাগ করেই সে সৃষ্টি করে।’
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রবিবার ডিজিটাল
………………………………………
‘আমরা কেবলই সংসারের দিকে মাথা রেখে সমস্ত জীবন ঘোর বিষয়ীর মতো ধুলা ঘ্রাণ করে করেই বেড়াতে পারব না– অনন্তের মধ্যে, অভয়ের মধ্যে, অশোকের মধ্যে মাথা তুলে আমরা সরল হয়ে উন্নত হয়ে সঞ্চরণ করব। যদি চাই করি, তবে সংসার থেকে আমরা ভ্রষ্ট হব না বরঞ্চ সংসারে আমাদের অধিকার বৃহৎ হবে, সত্য হবে, সার্থক হবে। তখন মুক্তভাবে আমরা সংসারে বিচরণ করতে পারব বলেই সংসারে আমাদের যথার্থ কর্তৃত্ব প্রশস্ত হবে।’
(চলবে)
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করে
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।